আব্দুল্লাহ সা’দ।।
আজ ঈদুল ফিতরের চাঁদ উঠবে। তাই পাড়ার ছেলে মেয়েরা সব মাঠে জড়ো হয়েছে চাঁদ দেখার জন্য। খেলার চাইতে পশ্চিম আকাশেই মনোযোগ তাদের বেশী। সাকিবও আছে সবার সাথে। সবার মাঝেই আসন্ন ঈদের চাপা আনন্দ বিরাজ করছে। বাচ্চারা সারা মাঠে ছুটোছুটি করছে। হৈ হুল্লোড় করে মাতিয়ে রাখছে পুরো পরিবেশটা। কিন্তু সাকিব ওদের থেকে আলাদা হয়ে মাঠের এক কোণে চুপচাপ বসে আছে। মুখভার করে বন্ধুদের হুটোপুটি দেখছে। ওর চাহনিতে বিমর্ষ ভাব। কিসের জানি আক্ষেপ ঝরে ঝরে পড়ছে ওর দৃষ্টি থেকে।
সাকিব বন্ধুদের খেলাধুলা দেখছে, কিন্তু ওদের সাথে মিশতে পারছে না। এতোদিনের বন্ধুদের সাথে আজ এক ধরনের অদৃশ্য দুরত্ব অনুভব করছে সাকিব। আসরের পর মাঠে এসে বন্ধুরা সবাই যখন ঈদের জামা নিয়ে বলাবলি করছিল, তখনই তৈরি হয়েছে দুরত্বটা। সবাই কথা বলছে। নিজের নতুন জামার গুণকীর্তন করে বক্তব্য দিচ্ছে। কিন্তু সাকিব চুপ করে আছে। কিছু বলছে না। কারণ ও তো জামা কিনতেই পারেনি। বলবে কি! সাকিবের নিরবতা দেখে বন্ধুরা ওর দিকে কেমন ভিন্ন দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিল। করুণা মাখা দৃষ্টি। কারো কারো চোখে তাচ্ছিল্যও ছিল। এতে সাকিবের খারাপ লাগাগা আরো বেড়ে যায়।
শাকিল তো বিদ্রুপ করে জিজ্ঞেসই করে বসলো, "কিরে সাকিব! কী কিনলি এবার? কিছু বলছিস না যে!" প্রশ্নটা শুনে সাকিবের বুক ধক করে ওঠে। কান্নারা দলা পাকিয়ে গলায় এসে আটকে যায়। ও কোন রকম "না; এমনি, কিছু না" বলে পাশ কেটে আসে।
গতবারের মতো এবারও সাকিব ঈদের জামা কিনতে পারেনি। ওর দরিদ্র বাবা প্রতিদিনের খাবার যোগাতেই হিমশিম খায়।।সেখানে ছেলের ঈদের জন্য নতুন জামা কিনে দেবে কোত্থেকে!
সাকিব পাবে না জেনেও বাবার কাছে একটা পাঞ্জাবি চেয়েছিল। বাবা ওকে জড়িয়ে ধরে শান্তনা ছাড়া আর কিছুই দিতে পারেনি। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বাবা যখন ওকে বলছিল, "একটু সবুর কর বাবা! হাতে টাকা এলেই কিনে দেবো"; এক অবরুদ্ধ উচ্ছাস সাকিবে গলা আটকে দিয়েছিল তখন। মুখ ফুটে কোনো কথা কলতে পারেনি। শুধু চোখ থেকে গড়িয়ে পড়েছিল ক'ফোটা অশ্রু। বাবার অজান্তেই সেটা হাতের উল্টো পিঠে মুছে নেয় সাকিব।
গত ঈদে পুরণো জামা গায়ে দিয়ে সাকিব যখন বাবার সাথে ঈদগাহে যাচ্ছিল, পুরো রাস্তায় এক অদৃশ্য জড়তা যেন জড়িয়ে রেখেছিল ওকে। সবার মাঝে নিজেকে কেমন অসহায় লাগছিল।
সাকিব বুঝতে পারে না, ওর বাবা গরিব এতে দোষের কী আছে? এবার ঈদে নতুন জামা কিনতে পারেনি, তাই বুঝি সবাই ওর দিকে এভাবে তাকাতে হবে! সাকিব চুপচাপ বাবার পিছে পিছে ঈদগাহে যায়। নামাজ শেষে আবার তেমনই ফিরে আসে। আমেজহীন নিরানন্দ সেই ঈদের বাকি দিনটা ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই কাটিয়ে দেয়। এবারও কী তাহলে এমনই হবে? সাকিব আর ভাবতে পারে না। ওর চোখের কোণ ভিজে ওঠে।
আজ রমযানের ঊনত্রিশ তারিখ। চাঁদ উঠবে কি না, এ নিয়ে দোটানা চলছে। উঠতেও পারে, নাও উঠতে পারে। সাকিব চাচ্ছে চাঁদ না উঠুক। উঠলেই যে বিপত্তি। আগামীকাল ঈদ হবে। আর সাকিব পুরণো জামা...।
কী হবে, যদি চাঁদ আর কখনোই না ওঠে! হয়তো কিছুই হবে না। কিন্তু সাকিব বড্ড বাঁচা বেঁচে যাবে। পুরণো জামা গায়ে দিয়ে আর লজ্জা পাবে না। নতুন জামা না পাওয়ার দুঃখে কাঁদতে হবে না। সাকিবের বাবাও ছেলেকে কিছু দিতে না পেরে কষ্ট পাবেন না।
এ সময় সাকিবের ভাবনায় ছেদ ঘটিয়ে কে একজন বেসুরো গলায় চেঁচিয়ে উঠলো, "চাঁদ উঠেছে, চাঁদ উঠেছে, ঐ যে চাঁদ"। আওয়াজটা শুনে সাকিবের কলিজা ছাঁৎ করে উঠলো। বিষাদে ছেয়েগেল ওর সুন্দর কোমল মুখটা। চাঁদের উপর খুব রাগ হলো সাকিবের। কী এমন হয়ে যেত আজ না উঠলে! দেখবে না দেখবে না করেও মাথা ঘুরিয়ে পশ্চিম দিকে তাকালো সাকিব। দেখলো, ঠিক ওর দিকে তাকিয়েই যেন চাঁদটা হাসছে। ক্রুর হাসি।
এনটি