মুহাম্মাদুল্লাহ শাব্বির।।
কুলসুম বারবার শুধু পার্শ পরিবর্তন করছে। এপাশ থেকে ওপাশে। চোখজুড়ে এক ফোঁটাও ঘুম নেই। তাকদীরের উপরতো আর কারও হাত নেই। তাই আল্লাহর ফায়সালার ওপর সন্তুষ্ট থাকতে হবে।
কাল দিন পর পরশু ঈদ! রমযানের ঈদ!! আর মাত্র এক দিন বাকি। অথচ রিফাত সিফাতের জন্য ঈদের জামা কেনা হলো না! আর কি দিয়ে-বা কিনবে কুলসুম, দিন শেষে মালিকের বেঁচে যাওয়া খাবারে কোনও মতো চারজনের মুখে ভাত ওঠে। মাইনে যা পায়, তা স্বামীর ওষুধপথ্যের পেছনে খরচ হয়ে যায়। আর দু'চার টাকা যা বাঁচে, তা দিয়ে এটা ওটা কিনতে হয়। খরচেরতো শেষ নেই। এসব ভাবতে ভাবতে একটা দীর্ঘ শ্বাস বেরিয়ে এলো কুলসুমের ভেতর থেকে।
ঘরে অন্ধকারে ছেয়ে আছে। টিনের ফুটো দিয়ে চাঁদের জোসনা ধেয়ে ধেয়ে আসছে। সে জোসনা পড়ছে কুলসুমের স্বামীর মুখে। কুলসুম স্বামীর মুখে চাঁদের জোসনা দেখে, তার দুঃখ যেন আরও উথলে উঠলো! তার ভেতরে ভীষণ আহ্লাদ জেগে উঠলো। একটু গা ছুঁতে চাইলো। ঘুম ভেঙে যাবে ভেবে আর গায়ে হাত দেয়নি।
ভবিষ্যতের কথা ভাবতেই তার চোখে জলের ধারা নামলো। চোখের জল আর নাকের জল একাকার হয়ে গেলো। সব কিছুইতো ঠিকঠাক ছিলো। অত সুখতো চাইনি! নিয়তির হাতের উপরতো আর কারও হাত নেই। বেচারা রিকশা চালিয়ে যা আনতো তা দিয়ে মোটামুটি সংসার চলতো। তেমন একটা টানাটানি হতো না। যা-দিতো, যা-খাওয়াতো, তা-নিয়ে, তা-খেয়েই তো সন্তুষ্ট ছিলাম।
প্রতিদিনের মতো সে দিনেও রিকসা নিয়ে বের হলো। দুপুর না গড়াতেই ফোন এলো-উনি হাসপাতালে। ট্রাকের সঙ্গে এক্সিডেন্ট। এতে পা দু'টো হারায়। চিরতরের জন্য পঙ্গুত্বকে বরণ করে নিতে হয়। হায় নিয়তি! হায় ভাগ্য!
কুলসুমের স্বামীর এক্সিডেন্ট নিয়ে যত কষ্ট হয়নি, তার চেয়ে বেশি কষ্ট লাগবে যদি ঈদের দিন রিফাত সিফাতের মুখে হাসি না ফুটাতে পারে! তাদেরকে যদি ঈদের দিন নতুন জামা না দিতে পারে!
কুলসুমের মালিকের ছেলে নাহিদ। মাদ্রাসায় পড়ে। পঞ্চম শ্রেণিতে। সেদিন উস্তাদজির মুখে নবীজির গল্প শুনে ছিলো। নবীজি ঈদের দিন কোথাও যাচ্ছিলেন। পথে দু'টি বালককে কান্না করতে দেখলেন। নবীজি বালক দু'টির কাছে গেলেন। কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করলেন। এতে ওরা আরও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করতে লাগলো। নবীজি ওদেরকে কাছে টেনে নিলেন। বুকে সঙ্গে মিশিয়ে নিলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। বুঝে নিলেন ওদের কেউ নেই। হাত ধরে নিজের বাড়িতে নিয়ে এলেন। ময়লা-পুরোনো জামা খুলে, নতুন, ঝমলমে জামা পরিয়ে দেলেন। পেট ভরে খাবার ও মিষ্টান্ন খাওয়ালেন। আর..আর বললেন, আজ থেকে তোমারা নবীপরিবারের সন্তান। আমি তোমাদের বাবা। আর আয়শা তোমাদের মা, 'কেমন ইয়া আবী'!
ছেলে দু'টি এসব পেয়ে, শুনে আনন্দে আত্মাহারা হয়ে গেলো। ওদের চোখে মুখে বিষাদের ছায়া দূর হয়ে, আনন্দের ঝিলিমিলি খেলে গেলো! এর চেয়ে বড় সুখকর বার্তা আর কি হতে পারে যে, ওরা 'নবী পরিবারের সন্তান'! তা-ই ওরা সমস্ত দুঃখ-কষ্ট ভুলে ঈদের আনন্দে মেতে থাকা অন্য ছেলেদের ভীড়ে মিশে গেলো।
নাহিদ উস্তাদজির মুখে অমন কষ্টের কাহিনী শুনে তার হৃদয় গলে গলে যায়। চোখের পাতা ভিজে ওঠে। চোখের সামনে ভেসে ওঠে রিফাত সিফাতের মুখ। আহারে! ওদের বাবার দু'টি পা নেই। কোনও কাজ করতে পারে না। ওদের মা, আমাদের বাসায় কাজ করে। ওরা ঈদের জামা পাবে কোথায়! ওদের বাবারতো অত টাকা নেই যে, ওদেরকে ঈদের জামা কিনে দেবে। ইনশাআল্লাহ! এবার আমি আব্বুকে বলে, আমার জমানো টাকা থেকে ওদেরকে ঈদের জামা কিনে দেবো। আর ঈদের দিন, ওদের সবাইকে আমাদের বাসায় দাওয়াত করবো।
ঈদের আগের দিন, নাহিদরা ঈদের কেনাকাটা করার জন্য মার্কেটে যায়। যার যার পছন্দ মতো জামা কিনছে। নাহিদ করলো কী, নিজের জন্য দু'টো পছন্দ করলো, আর রিফাত সিফাতের জন্য একটা করে পছন্দ করলো। ওর বাবা জানতে চাইলে সব কিছু খুলে বলে। আর বলে, তুমি না কিনে দিতে চাইলে, আমার জমানো টাকা থেকে ওদের জন্য তা কিনে দাও। আরিফ সাহেব ছেলের অমন মহৎ গুণ দেখে যেমন অবাক হলেন, তেমন খুশি হলেন। রিফাত সিফাতের জন্যও কেনা হলো ঈদের নতুন জামা।
এদিকে কুলসুম ভীষণ পেরেশান। মালিক থেকে অগ্রিম বেতন চাইতেও পারছে না। এমনিতে গত মাসে পাঁচশ' টাকা অগ্রিম নিয়েছে। আবার এমাসে নিলে, আগামী মাসে স্বামীর অষুধ কিনবে কি দিয়ে!
আজ চাঁদ ওঠেছে! কাল ঈদ! পাড়ার ছেলেরা হই-হুল্লোড়ে মেতে ওঠছে! রিফাত সিফাতও অন্য ছেলেদের সাথে চাঁদ দেখার আনন্দ করছে! আর ওরাতো জানেই যে ঈদের নতুন জামা এনেছে! কাল ভোরে ভোরে পরিয়ে দেবেন। ঈদের জামা আগে দেখতে নেই। আগে দেখলে যে ঈদের মজা শেষ হয়ে যাবে। তাই ওরা ওই সেদিন কেনার জন্য বলে আর জিজ্ঞেস করেনি। পাছে আবার ঈদের মজা যদি নষ্ট হয়ে যায় এ-ভয়ে!
স্বামী বেচারা কি-ইবা করবে! কুলসুমের মনের অজান্তে হাত চলে যায় নাকে। কুলসুমের শেষ সম্বলটুকু হলো নাকের ফুল! আর যা ছিলো, সবতো স্বামীর চিকিৎসা বাবদ শেষ হয়ে গেছে। পাশের রুমে গিয়ে তা অনেক কষ্টে খুললো! স্বামীকে বললো, তুমি একটু বসো। দেখি ওদের জামা কিনতে পারি কিনা! এ-বলে সবে মাত্র দরজা ভেজাতে যাবে, অমনি পেছন থেকে, তার বেগম সাহেবা ডাক পাড়লো, আমরা তোর বাড়িতে আসছি, আর তুই যে, কোথায় চলে যাচ্ছিস?
-আরে খালাম্মা, আপনি! আসেন আসেন, ভেতরে আসেন! নাহিদকে বললো, বাবা তুমি কেমন আছো?
-আলহামদুলিল্লাহ! আপনি কেমন আছেন?
-আলহামদুলিল্লাহ! আছি বাবা ভালোই আছি!
-রিফাত সিফাতকে যে দেখছি না?
-ওরা বাইরে আছে। মনে হয়, চাঁদ দেখছে।
-খালাম্মা! একটু চা করে নিয়ে আসি!
-আরে নাহ, আমরা মাত্র খেয়ে এলাম। তা তোর স্বামী কোথায়?
-উনি ওই রুমে শুয়ে আছেন। সারাদিন শুয়ে শুয়ে থাকেন। আর নামাজের সময় হলে, ক্র্যাচে নিয়ে ঠুকঠুক করে মসজিদে যান।
-এই শোন, আমরা এসেছি কাল তোদের সবার দাওয়াত আমাদের বাসায়। এ-প্যাকেটগুলোতে তোদের সবার জন্য ঈদের পোশাক। আর ঈদের কিছু দিন পর তোরা আমাদের বাসায় পার হয়ে চলে আসবি। পাশের ঘরটাতে থাকবি। এতে তোদের বাড়ি ভাড়াটা বেঁচে যাবে। আর রিফাতের তো এখন পড়ার বয়স হয়েছে। ওকে নাহিদের সাথে মাদরাসায় ভর্তি করিয়ে দেবো। এসব কিন্তু আমার বাপজানের উছিলায় হয়েছে। ওর জন্য দুআ করবি। আল্লাহ যেন...! উঠিরে। কাল একটু ভোরে ভোরে চলে আসবি, কেমন!
কুলসুম হ্যাঁ না কিছু-ই বলতে পারলো না। শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দৃশ্যগুলো 'উপভোগ' করলো। তাদের চলে যাওয়া পথে চেয়ে আছে, আর তার চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে।
এনটি