মুফতি সৈয়দ নাছির উদ্দীন আহমদ।।
রোযাদার যতই যত্নবান হোক না কেন রোযার মধ্যে কোনো না কোনো ত্রুটি হয়েই যায়-এটা স্বাভাবিক।খানা খাওয়া, পান করা এবং রোযা ভঙ্গকারী বিষয় থেকে বেঁচে থাকা সহজ কিন্তু অনর্থক কথা, বাজে কাজ এবং অনুচিত ও অসমীচীন কথাবার্তা থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকতে পারা যায় না। একারণে রোযার এরকমের ক্ষতি পূরণের জন্য রামাজান মাসের শেষে সাদাকাতুল ফিতর নামে পৃথকভাবে রোযার যাকাত ওয়াজিব সাব্যস্ত করেছে ইসলামী শরীয়াহ।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা: বলেছেন,রাসুল সা: সাদাকাতুল ফিতর জরুরি সাব্যস্ত করেছেন,যা রোযাদারের জন্য বেহুদা কথা ও অশ্লীল কাজকর্ম থেকে রোযাকে পবিত্র করার উপায় এবং মিসকিনদের জন্য খাদ্যের ব্যবস্থা। যেব্যক্তি ঈদের নামাযের পূর্বে সাদকায়ে ফিতর আদায় করে আল্লাহর নিকট তা মকবুল যাকাত বলে গণ্য হয়। আর যে ব্যক্তি ঈদের নামাযের পর আদায় করে তাও সাদাকাসমূহ থেকে একটি সাদাকা হিশেবে পরিগণিত হয়। (আবু দাউদ হাদীস ১৬০৯,ইবনে মাজাহ হাদীস,১৮২৭)
সদকায়ে ফিতরের সংজ্ঞা: আভিধানিক অর্থ, এমন দান যা দ্বারা আল্লাহ্র নৈকট্য লাভের আশা করা হয়। পারিভাষিক সংজ্ঞা: ফিকহবিদ বলেন,ঈদুল ফিতরের দিন ভোরে যে সদকা ওয়াজিব হয় তাকে সাদকায়ে ফিতর বলে। কারো কারো মতে সদকাতুল ফিতর এমন সদকাকে বলে,যা ইবাদত এবং দয়াপরবশতার বন্ধন হিশেবে দেয়া হয়।
সদকায়ে ফিতরের হুকুম যে ব্যক্তি জীবিকা নির্বাহের অত্যাবশ্যকীয় উপকরণ ছাড়া এ পরিমাণ মালের মালিক যার উপর যাকাত ফরজ,তার উপর ঈদুল ফিতরের দিন সাদকায়ে ফিতর আদায় করা ওয়াজিব। (হিদায়াা ১/২০৮)
সদকায়ে ফিতর কখন ওয়াজিব? সদকাতুল ফিতরের সম্পর্ক রোযার সাথে। ঈদের দিন সুবহে সাদিকের সময় হতে সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব হয়। কাজেই রোযা পালন শেষে ঈদের খুশিতে নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক মুসলমানের পরিবারের প্রতিটি সদস্য এমনকি ঈদের দিন সুবহে সাদেকের পূর্বে যে সন্তান জন্মগ্রহণ করবে তার পক্ষ থেকেও তা আদায় করা ওয়াজিব। (ইলমুল ফিকহ ৪/৫১,দারুল উলুম ৬/৩১৩ কিতাবুল ফাতাওয়া ৩/৩৫৪)
সাদকায়ে ফিতর কার পক্ষ থেকে দেওয়া ওয়াজিব? নেসাব পরিমাণ মালের মালিক যিনি,সদকায়ে ফিতর আদায় করা তার পক্ষ থেকে ওয়াজিব।
না-বালিগ সন্তান নিজে মালিকে নিছাব না হলে তার পক্ষ থেকে সাদকায়ে ফিতর আদায় করা পিতার উপর ওয়াজিব। আর সে যদি মালিকে নিছাব হয়,তাহলে তার মাল থেকে সাদকায়ে ফিতর আদায় করতে হবে।(শরহে বেকায়া ১খন্ড সাদকায়ে ফিতর অধ্যায়)
আকিল,বালিগ সন্তানের পক্ষ থেকে সাদকা ফিতর আদায় করা বাবার জন্য জরুরী নয়। কিন্তু সে যদি বাবার লালন-পালনে থাকে আর পিতা তার পক্ষ থেকে আদায় করে দেন তবে তা দুরস্ত বা বৈধ আছে।(বাহরুর রায়িক ২/২৫২, হিদায়া ১/২০৯)(বাদায়েউস সানায়ে ২/৫৩৩-৫৩৬)
নিজ গৃহের কাজের লোকদের পক্ষ থেকে সদকায়ে ফিতর আদায় করা উচিত তবে আবশ্যক নয়।(কিতাবুল ফাতাওয়া ৩/৩৫৭) স্ত্রীর সাদকায়ে ফিতর স্বামীর উপর ওয়াজিব নয়। তবে স্ত্রীর পক্ষ থেকে আদায় করে নিলে আদায় হয়ে যাবে । এতে অনুমতি নিয়ে হোক বা না হোক। (হিদায়া ১/২০৯,দুররে মুখতার ৩/৩৮৫)
যে রোযা রাখেনি তার উপরও সাদকায়ে ফিতর ওয়াজিব হবে যদি সে মালিকে নেসাব থাকে নির্ধারিত সময়ে। (বাদায়েউস সানায়ে ২/৫৩৫, ফাতাঃআলমগিরী ১/১৯২ সদকায়ে ফিতর অধ্যায়)
সদকায়ে ফিতর কখন আদায় করবেন? উত্তম হল ঈদের নামাযের আগে সাদাকাতুল ফিতর আদায় করা । এসময় যদি আদায় না করা হয়,তবে পরে যখন ইচ্ছা আদায় করতে পারবে। পরে যখনই তা আদায় করা হবে আদায় বলে গণ্য হবে,কাযা বলা যাবেনা । (বাদায়ে উস সানায়ে ২/৫৪৬)
সদকায়ে ফিতরের পরিমাণ সদাকায়ে ফিতর সম্পর্কিত হাদীস সমূহে মোট পাঁচ প্রকার খাদ্যের বর্ণনা পাওয়া যায়: যব, খেজুর, পনির,কিসমিস ও গম। সাদাকাতুল ফিতর যব,খেজুর,পনির বা কিসমিস দ্বারা আদায় করলে প্রত্যেকের জন্য এক সা’ দিতে হবে । আর গম বা গমের আটা বা গমের ছাতু দ্বারা আদায় করলে আধা ‘সা’ দিতে হবে।এটা হল ওজনের দিক দিয়ে তফাত। আর মূল্যের দিক থেকে তো পার্থক্য রয়েছে।অর্থাৎ গম,গমের আটা বা গমের ছাতু যদি হয়,তবে তা পৌনে দুই সের সাবধানতাবশত পুরো দুই সের দিতে হবে । এর সমপরিমাণ মূল্যও দেওয়া যায়। আর যদি খেজুর,কিসমিস,যব,যবের ছাতু এসবের কোন একটি দ্বারা ফিতরা দেয়া হয়,তাহলে ৩ কিলো দেড়শ গ্রাম অথবা এর সমপরিমাণ মূল্য দিতে হবে।বর্ণিত যে বস্তুর হিসাবে দেওয়া হোক কিছু বেশি দেওয়াই ভালো। কারণ সামান্য কম হলে ফিতরা আদায় হবেনা। আর বেশি দিলে সওয়াব পাওয়া যায়।(আলমগীরী১/১৯৩ ও শরহেবেকায়া ১খন্ড সাদকায়ে ফিতর অধ্যায়,দারুল উলুুুম ৬/৩২৬)
মুসাফির ব্যক্তি কোন জায়গার হিসাবে ফিতরা দিবে?
মুসাফির ব্যক্তি যদি মালিকে নেসাব হয় তাহলে ঈদের দিন সে যেখানে থাকবে সেখানের মূল্য হিসাবে সাদাকাতুল ফিতর আদায় করবে । (আদ্দুরুল মুনতাকা ১/২২৬)
প্রবাসী মুকীম ব্যক্তি কোন হিসাবে ফিতরা দিবে?
বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশ প্রবাসী কোন ব্যক্তি যদি বাংলাদেশে সাদাকাতুল ফিতর আদায় করতে চান তাহলে যে দেশে অবস্থান করছেন সেখানকার মূল্য হিসাবে তিনি ফিতর আদায় করবেন। এটাই অতি বিশুদ্ধমত । তবে হ্যা বাংলাদেশের মূল্য ধরে দিলেও দেয়া যাবে তা বৈধ আছে। প্রবাসীদের জন্য উত্তম হলো যে দেশের মূল্য হিসাব করা হলে সাদাকা গ্রহণকারী গরীব মিসকিন প্রমূখদের উপকার বেশি হবে সেখানকার মূল্য বিবেচনা করা।
বর্তমানে লন্ডন আমেরিকা সৌদি আরব ইত্যাদি উন্নত দেশেগুলোতে অবস্থানরত প্রবাসীগণ স্বীয় বাংলাদেশে ফিতরা আদায় করতে চাইলে আপনি যে দেশে আছেন সেখানকার মূল্য ধরে টাকা পাঠিয়ে দিবেন।এতে পৌনে দুই সের আটা বা গম ইত্যাদির মূল্য বেশি পরিমাণে আসবে।যা সাদাকা গ্রহণকারীদের জন্য উপকারী।অনুরূপ নিয়মে দেশে অবস্থানরত না-বালিগ সন্তানের পক্ষ থেকেও তাদের ফিতরা প্রবাসী পিতাকে আদায় করতে হবে। (আদ্দুরুল মুনতাকা ১/২২৬, বাদায়েউসসানায়ে২/৫৪৭,ফাতাওয়ারাহিমিয়া৭/১৯৪,১৯৫,দারুল উলুম ৬/৩০৬)
চাউল দ্বারা সাদকায়ে ফিতর: যদি কেউ কৃষিজাত ফসল যেমন ধান-চাউল ইত্যাদি দ্বারা সাদাকাতুল ফিতর আদায় করতে চায় তাহলে এতে ওজন গ্রহনযোগ্য নয়; বরং এক্ষেত্রে মূল্য বিবেচ্য হবে। অর্থাৎ এক ছা’ খেজুর বা আধা ছা’ গমের বাজার দর যা আসে সে মূল্যের ধান-চাউল আদায় করতে হবে। (দুররে মুখতার ৩/৩১৯,ইমদাদুল ফাতাওয়া ২/১০৮)
রামাজানে সাদকায়ে ফিতর আদায় করা? রামাজান মাসে ঈদের দিনের আগে সাদাকাতুল ফিতর আদায় করা জায়েজ আছে। চাই তা রামাজানের যে কোন দিনেই হোক না কেন। (দারুল উলুম ৬/৩০৫)
সাদকায়ে ফিতর কাকে দেওয়া যাবে? সদকায়ে ফিতির এবং যাকাত প্রদানের খাত একই।মোট ৮ ধরণের ব্যক্তিকে যাকাত ও ফিতরা দেয়ার কথা কুরআনে বর্ণিত। যার বিবরণ যাকাতের আলোচনায় করা হয়েছে। অর্থাৎ যেসব খাতে যাকাতের টাকা খরচ করা হয় সেসব খাতে সাদকায়ে ফিতর খরচ করতে হবে। (ফাতাওয়া শামী ৩/৩২৫)
সম্পূর্ণ ফিতরা একজনকে কী দেওয়া যাবে? একজনের ফিতরা একজন ফকীরকে দেওয়া উত্তম। একজনের ফিতরা কয়েকজন ফকীরকে বন্টন করে দেওয়া কমপক্ষে মাকরূহে তানযীহী।
তবে কয়েকজনের ফিতরা একজনকে দেওয়া জায়েজ আছে কোন অসুবিধা নেই । (ফাতাওয়া শামী ৩/৯২১,মাসাইলে রোযা ১৯০ পৃ: দারুল উলুম ৬/৩২৫) মহান আল্লাহ পাক সঠিকভাবে ফিতরা আদায় করার তাওফিক দান করুন । আমীন
লেখক: সিনিয়র শিক্ষক, জামিআ' ফারুকিয়্যাহ সিলেট
-এটি