ওলিউর রহমান।।
লাইলাতুল কদর। পবিত্র রমযান মাসের একটি রাত। এ রাতের প্রেক্ষাপট নিয়ে স্বতন্ত্র একটি সূরা নাযিল হয়েছে। মহাগ্রন্থ আল কুরআনের দু’টি সূরায় এ রাতের মাহাত্ম্য বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
সূরা দুখানে এ রাতের গুণাগুণ বর্ণনা করে আল্লাহ তাআলা বলছেন, -অর্থ, "আমি এ কিতাব অবতীর্ণ করেছি বরকতময় রাতে। আমি তো সতর্ককারী। সে রাতেই প্রত্যেক চূড়ান্ত বিষয় ( লওহে মাহফুজ থেকে ফেরেশতাদের কাছে) স্থানান্তর করা হয়। আমার আদেশক্রমে। আমি তো প্রেরণকারী। আপনার রবের রহমতে। নিশ্চয় তিনিই সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ"।
সূরা কদরে আল্লাহ তাআলা বিস্তারিত বলেছেন, এ রাতের তাৎপর্য বিষয়ে। এরশাদ করেছেন,( অর্থ) '‘নিশ্চয় এ কুরআন আমি নাযিল করেছি শবে কদরে। আপনি জানেন কি- শবে কদর কী? শবে কদর হাজার মাস থেকে উত্তম। সে রাতে ফেরেশতারা এবং রূহ অবতীর্ণ হয় তাদের রবের নির্দেশে ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত সকল কাজে। শান্তিই শান্তি সে রাত। ফজর পর্যন্ত’'।
সূরা বাকারায় আল্লাহ তাআল শবে কদরের বিশেষ মর্যাদার কারণ উল্লেখ করেছেন (অর্থ) "এটা পবিত্র রমযান মাস। যে মাসে মানুষের হেদায়াত এবং সত্য মিথ্যার পার্থক্যের জন্য কুরআন নাযিল করা হয়েছে"।
আর এটা তো স্বতঃসিদ্ধ কথা যে, কুরআন শবে কদরে নাযিল হয়েছে। সুতরাং যে রাতে মানবতার মুক্তি ও হেদায়েতের জন্য কুরআনের নূর নাযিল করা হয়েছে সে রাত হাজার মাস থেকে উত্তম হওয়া তো স্বতঃসিদ্ধ বিষয়।
এ রাতেই তো দীর্ঘকাল গাফলতের অন্ধকারে আবর্তিত জাতি সত্য-সুন্দরের দিশা পেয়েছে। এ রাতেই প্রথম জীবরীল আলাইহিস সালাম খাতামুল মুরসালীন সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন মহান রবের বাণী – اقرأ باسم ربك الذي خلق –(অর্থ) পড়ুুন, আপনার প্রতিপালকের নামে, যিনি আপনাকে সৃষ্টি করেছেন।
এরপর দীর্ঘ তেইশ বছর ধরে কালামে ইলাহির বারিধারা বারবার বর্ষিত হয়েছে। ওহির বৃষ্টিতে হাজার হাজার বার সিঞ্চিত হয়েছে যমিন। এভাবেই রাসূলের নবুওয়াতের তেইশ বছরে একটু একটু করে পূর্ণতা পেয়েছে দ্বীন আল ইসলাম। যার আলোকে গড়ে উঠেছে মহান শরিয়ত।
কতই না সৌভাগ্য তাদের, যারা কুরআন নাযিলের সেসময়টাকে কাছে থেকে দেখেছেন।
আনাস রাযি. বর্ণনা করেন, রাসূলের ওফাতের পরে একদিন খলিফাতুল মুসলিমীন আবু বকর রাযি. ফারুকে আযম রাযি.কে বললেন, আমাকে উম্মে আয়মনের বাড়ি নিয়ে চল, উমর! রাসূল যেভাবে তার সাক্ষাতে যেতেন আমরাও তার সাথে সাক্ষাত করে আসি। উভয়ে উম্মে আয়মানের বাড়ি পৌঁছে দেখেন, তিনি কাঁদছেন। তাকে বলা হল, আপনি কাঁদছেন কেন? হে উম্মে আয়মান। উম্মে আয়মান বললেন, হায়, ওহি নাযিলের ধারা তো বন্ধ হয়ে গেলো। আনাস রাযি. বলেন, উম্মে আয়মানের কান্না আবু বকর, উমরের মাঝে সংক্রমিত হলো। তাদেরকেও তখন অঝোর ধারায় কাঁদতে দেখা গেলো।
দীর্ঘকাল পর আমরা যখন শবে কদরের তাৎপর্য নিয়ে আলোচনা করতে যাই, কুরআনের এ আয়াতটি আমাদের মনোজগতকে আলোড়িত করে- ولقد كرمنا بني آدم-অর্থাৎ আমি বনী আদমকে সম্মানিত করেছি।
আল্লাহর দেওয়া এ সম্মান বিশেষ কোনো গোষ্ঠী বা নির্দিষ্ট কোনো শ্রেণির লোকদের জন্য নয়। গোত্র এবং শ্রেণির বিভেদ কেবল পরিচিতির জন্য। আল্লাহর কাছে প্রকৃত মর্যাদাবান পরহেযগার ব্যক্তি। কুরআন বলছে, (অর্থ) হে মানব সকল, তোমাদেরকে আমি নারী-পুরুষ এবং বংশ কবিলায় বিভক্ত করেছি কেবল পরিচিতির জন্য। নতুবা আমার কাছে বেশি সম্মান তো তার যে আমাকে বেশি ভয় করে।
কদর নামকরণের কারণ
লাইলাতুল কদরকে কদর বলা হয়েছে, যেহেতু এ রাতেই জগতবাসীর ভাগ্য নতুন করে পরিবর্তন হয়েছে। পাপ-পঙ্কিলতায় নিমজ্জিত জাতি এ রাতেই আলো জ্বলমল পথের সন্ধান পেয়েছে। তাছাড়া পৃথিবীর এক বছরের ব্যবস্থাপনাগত যাবতীয় কার্যাদি এ রাতে নির্ধারণ করা হয়। (ফেরেশতাদের বুঝিয়ে দেওয়া হয়)।
কবে লাইলাতুল কদর
এ নিয়ে বিস্তর মতভেদ রয়েছেন। ইমাম কুরতুবী বলছেন, রমযানের সাতাশ তারিখই সে বরকতময় রজনী।
একাধিক হাদিসে রমযানের শেষের দশকে শবে কদর হওয়ার কথা বলা হয়েছে।
আবু সায়িদ খুদরি রাযি. বলেন, এক বছর আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে রমযানের মাঝের দশকে ইতিকাফ করছিলাম। বিশ তারিখ সকালে খুতবা দিতে গিয়ে বললেন, আমাকে নির্দিষ্ট করে শবে কদরের সন্ধান দেওয়া হয়েছিল। পরে ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে আমাকে দেখানো হয়েছিল, সে রাতে আমি কাদা-পানির মাঝে সিজদা করছি। তোমরা রমযানের শেষ দশকের বিজোড় রাতগুলোতে শবে কদর তালাশ করো।
আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী রহ. বলেন, রাসূলের লাইলাতুল কদরের তারিখ ভুলে যাওয়াতে মন্দের কিছু নেই। আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দাদের কল্যাণের জন্য তারিখটিকে ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। কেননা যদি দিন নির্দিষ্ট হয়ে যেত তাহলে লোকদের মাঝে ইবাদতের ব্যাপারে অলসতা দেখা যেত।
আম্মাজান আয়েশা রাযি. থেকে বর্ণিত, হাদিসে আছে, রাসূল সা. বলেছেন, তোমরা শবে কদর তালাশ কর রমযানের শেষ দশকের বিজোড় রাতগুলোতে। করো রমযানের শেষ দশকের বিজোড় রাতগুলোতে। একাধিক সূত্রে এ হাদিস বর্ণিত হয়েছে। শবে কদরের আলামত প্রসঙ্গে ইমাম কুরতুবি বলেন, সেদিনের সূর্য থাকবে তেজশূন্য। রাতের আবহাওয়া থাকবে নাতিশীতোষ্ণ।
ফজিলত
শবে কদর প্রসঙ্গে সহীহ হাদিসে বর্ণিত ফজিলতগুলো মানুষের আমলের স্পৃহাকে অনেকগুণ বৃদ্ধি করে। বুখারি, মুসলিমে ইরশাদ হয়েছে, যে ব্যক্তি ইমানের সাথে সওয়াবের আশায় শবে কদরে ইবাদত করবে তার পূর্বের সকল গোনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে।
রাসূল সাল্লাল্লাহ আলাইহিস সালাম, জীবনের প্রতিটি কর্মে যিনি আমাদের আদর্শ, শবে কদরের তালাশে খুবই তৎপর থাকতেন সবসময়। আম্মাজান আয়েশা রাযি. বর্ণনা করেন, রমযান মাস শুরু হতেই রাসূল সা. কোমর বেঁধে ইবাদতে লেগে যেতেন। রাত্রি জাগরণ করতেন এবং পরিবারের সদস্যদের জাগিয়ে তুলতেন।
সুতরাং আমাদের জন্য উচিত হবে না, মহিমান্বিত এ রজনীর ব্যাপারে উদাসীন থাকা।আমাদের নবী মুহাম্মদে আরাবী আমাদের জন্য ইতেকাফের উত্তম আদর্শ রেখে গেছেন। রমযানের শেষ দশকে ইতেকাফ করে আমরা সহজেই বরকতময় এ রাতের ফজিলত লাভ করতে পারি।
এনটি