সালাহুদ্দিন সাঈদ: বাংলাদেশে হাফেজে কুরআনের সংখ্যা অসংখ্য। ছোট শিশু থেকে নিয়ে বৃদ্ধ পর্যন্ত অনেক হুফফাজে কেরাম আছেন এদেশে। এটা আমাদের জন্য অত্যান্ত গর্বের ও আনন্দের। এদেশ হাফেজে কুরআনের দেশে। এদেশের মাটি হাফেজদের পদচারণায় মুখরিত। কুরআনের খাদেমদের পদভারে মুগ্ধ।
ঐশীগ্রন্থ আল কুরআনের পরেই প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদিসের অবস্থান। কুরআনুল কারীমে কোনো সমাধান খোঁজে না পেলে খুঁজতে হয় হাদিসে। বহু মাসআলার মূল বিষয় কুরআনে কারীমে থাকলেও সমাধান দেওয়া হয়েছে প্রিয় নবীর হাদিসে। কিন্তু বাংলাদেশে অসংখ্য হাফেজে কুরআন থাকলেও হাফেজে হাদিস নেই হাতেগোণা একজনও। অসংখ্য হিফজুল কুরআন মাদরাসা থাকলেও হিফজুল হাদিস মাদরাসা নেই একটিও। হিফজুল হাদিসের এই সংকট কাটিয়ে উঠার জন্যই নিজের প্রতিষ্ঠিত মাদরাসায় ‘হিফজুল কুরআনের আলোকে হিফজুল হাদীস’ বিভাগ চালু করেছে দেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় জেলা চাঁদপুরের মহামায়া দারুস সালাম মাদরাসা। অত্যান্ত সফলতার সাথে প্রতিষ্ঠানটি এক বছর অতিবাহিত করার পর এবার পা রাখলো দ্বিতীয় বর্ষে।
নিঃসন্দেহে বলা যায়, মুখস্থের স্থায়ীত্বের জন্য বহু যুগের পরীক্ষিত ও কার্যকরী পদ্ধতির অন্যতম হচ্ছে ‘হিফজুল কুরআন’এর প্রচলিত পদ্ধতি। যা মুসলিম উম্মাহর জন্য স্বতন্ত্র এক গৌরবোজ্জল দৃষ্টান্ত। হিফজুল কুরআনের এ পদ্ধতির অনুকরণেই ‘হিফজুল হাদীসে’র আয়োজন। দারুস সালাম কমপ্লেক্স মাদরাসার পরিচালক মাওলানা আসাদুল্লাহ সুলতান এর বিশ্বাস ও বক্তব্য হচ্ছে- ‘অবশ্যই তা ফলপ্রসূ হবে, হাদিস মুখস্থ করার অন্যান্য পদ্ধতির চেয়ে বেশিই কার্যকরী হবে এবং ব্যাপকভাবে হাদিস মুখস্থের একটি পরিবেশ তৈরি হবে। ইনশাআল্লাহ!’
সেই বিশ্বাস থেকেই দীর্ঘ ৬ বছর অধ্যয়ন, চিন্তা-ফিকির ও গবেষণা করেছেন তিনি। ১ মাস ব্যাপী ১১ জন তালিবে ইলমের মাধ্যমে করেছেন পর্যবেক্ষণও। এমনকি হিজরী (শাওয়াল) ১৪৪১ - (শাবান) ১৪৪২ শিক্ষাবর্ষে ৬ জন তালিবে ইলমের মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনায় এক বছর মেয়াদী ‘হিফজুল কুরআনের আলোকে হিফজুল হাদীসে’র কার্যক্রম ইতোমধ্যে সম্পন্ন করেছে ‘দারুস সালাম কমপ্লেক্স’।
এই ছয় জনের মাঝে আমিও ছিলাম একজন। আলহামদুল্লিাহ! সবক, সাত-সবক ও তামরীনের মাধ্যমে প্রতিটি হাদীস যেন অন্তরে গেঁথে যায় । দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে- ‘আর কখনো ভুলবো না।’ সহপাঠীদের দৈনন্দিনের কথা-বার্তায় যেন মুক্তা হয়ে ঝরে রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) পবিত্র কথামালা? নববী ইলমের সুবাস নিয়ে মননে ফুটে ওঠে ভাবনার ফুল? মুখস্থ হাদিসগুলো হয় আস্থা ও বিশ্বাসের চুড়ান্ত আশ্রয়।
অনেকের কাছে বিষয়টি নতুন মনে হওয়া স্বাভাবিক। তবে না, বিষয়টি নতুন নয়, পুরাতন। অবিশ্বাস্য মনে হলেও সম্ভব। শুধু মস্তিষ্কপ্রসূত ধারণা আর মনের আবেগ নয়, বরং হুফফাজে হাদীস ও আকাবীর-আসলাফের কর্ম-কথার বিশ্লেষণনির্ভর পদ্ধতি হচ্ছে ‘হিফজুল কুরআনের আলোকে হিফজুল হাদীস’।
হাদিসের জগতে প্রশিদ্ধ ব্যক্তিত্ব ইবনে খুজাইমা রহ. (মৃত্যু ৩১১ হি.), ইসরাঈল ইবনে ইউনুস রহ. (মৃত্যু ১৬২ হি.), শাহ ইবনে হাওশাব রহ. (মৃত্যু ১১১ হি.), আবুয যিক্র মুহাম্মদ রহ. (মৃত্যু ৩২০ হি.), হজরত ইবনে কুতাইবা রহ. (মৃত্যু ৩২৪ হি.) এর মত মনীষীগণও ‘হিফজুল করআনের মতই হাদিস মুখস্থ করেছেন’। এমনকি ৫ম খলিফাখ্যাত হজরত ওমর ইবনে আব্দুল আজিজ রহ. (মৃত্যু ১০১ হি.) কর্তৃক নিয়োজিত আফ্রিকার গভর্ণর মুহাদ্দিস হজরত ইসমাঈল ইবনু উবাইদুল্লাহ রহ. (মৃত্যু ১৩১ হি.) বলেছেন: ‘আমাদের উচিত, কুরআন যেভাবে মুখস্থ করা হয়, সেভাবে হাদিসও মুখস্থ করা’। (তারিখে দিমাশ্ক, ৮ম খন্ড)
হয়ত সালাফের যুগের ‘হিফ্জুল কুরআন পদ্ধতি’ এবং এ যুগের ‘হিফজুল কুরআন পদ্ধতি’ হুবহু সাদৃশ্যপূর্ণ নাও হতে পারে। কিন্তু বর্তমান হিফজুল কুরআনের পদ্ধতি তো সুদীর্ঘ সময়ের পরীক্ষিত পদ্ধতি। তাই ব্যবস্থাপকগণ পূর্ণ আস্থার সাথেই দাবী করছেন ‘এই পদ্ধতিতে ‘হিফজুল হাদীস’ এর চর্চা হলেও বিফল হবে না। ইনশাআল্লাহ! এমনকি স্থানীয় ও মুরব্বি উলামায়ে কেরামের অনেকেই ‘হিফজুল হাদীসে’র এই পদ্ধতিটি অবগত হয়ে মুগ্ধ হয়েছেন এবং পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করেছেন।’
ব্যবস্থাপকগণের আস্থা, উলামায়ে কেরামের সমর্থন ও আইম্মায়ে হুফ্ফাজের জীবন-সিঞ্চিত পদ্ধতি সামনে রেখে স্বাভাবিক ও সম্ভাব্য এবং যৌক্তিক ও ভারসাম্যতাপূর্ণ পরিকল্পনায় প্রচলিত হিফজুল কুরআনের আলোকেই, পূর্ণ এক বছর মেয়াদী ‘হিফজুল হাদীসে’র যুগান্তকারী উদ্যোগ, ‘হিফজুল কুরআনের আলোকে হিফজুল হাদীস’-এর শুভযাত্রা।
লেখক: শিক্ষার্থী, হিফজুল হাদীস বিভাগ, দারুস সালাম মাদরাসা, আলুমুড়া, মহামায়া, সদর, চাঁদপুর
এমডব্লিউ/