মুফতি আব্দুর রহিম।।
সাম্প্রতিক মাদরাসার একজন শিশু শিক্ষার্থীকে শিক্ষক কতৃক বেধড়ক প্রহারের ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। যা শেষ পর্যন্ত মামলা মকাদ্দমা পর্যন্ত গড়িয়েছে। ইতিপূর্বেও এজাতীয় ঘটনা বহুবার ঘটেছে। শাসনের নামে এজাতীয় প্রহার না শরিয়ত সমর্থিত, না রাষ্ট্র ও সমাজ। কারণ মূলত এটি শাসনেই নয়, বরং শাসনের নামে এটি নির্যাতন। তাই শাসনের পদ্ধতি, আদাব, সীমা অতিরিক্ত শাসনের পরিণতি সম্পর্কে ইসলামি শরীয়ার দৃষ্টি ভঙ্গি নিয়ে কিছু আলোকপাত করা ইচ্ছে করেছি।
শাসনের পদ্ধতি: আমরা অনেকে মনে করি, শাসন অর্থই হচ্ছে মারধর। এছাড়া শাসনের কোন পন্থায়ই বুঝি নেই। অথচ, মারধর হচ্ছে শাসনের সর্বশেষ স্তর যেখানে অন্য কোন পদ্ধতি কার্যকর হয় না সেখানেই মৃদ প্রহারের কথা বলা হয়েছে।
কুরআনে কারীমে এরশাদ হচ্ছে,
وَاللَّاتِي تَخَافُونَ نُشُوزَهُنَّ فَعِظُوهُنَّ وَاهْجُرُوهُنَّ فِي الْمَضَاجِعِ وَاضْرِبُوهُنَّ
অর্থ: আর যাদের মধ্যে অবাধ্যতার আশঙ্কা কর তাদের সদুপদেশ দাও, তাদের শয্যা ত্যাগ কর এবং প্রহার কর। (সূরা নিসা : আয়াত : ৩৪)ৎ
এ আয়াতে আল্লাহ তায়ালা নারীকে শাসনের পদ্ধতি বর্ণনা করে দিয়েছেন যে, এর প্রথম ধাপ হচ্ছে উপদেশ প্রদান করা। এতে কাজ না হলে দ্বিতিয় ধাপ গ্রহণ করতে হবে আর তা হচ্ছে শয্যা ত্যাগ করা। শাসনের ক্ষেত্রে নিজ স্ত্রীর সাথে শয্যা ত্যাগ ক্ষেত্রে বলা হয়েছে। স্ত্রী ছাড়া অন্যদের ক্ষেত্রে উদ্দেশ্য হবে তার - সাথে উঠা-বসা চলা-ফেরা বর্জন করা। এতেও কাজ না হলে তৃতীয় ও সর্ব শেষ ধাপ হচ্ছে মৃদু প্রহার করা। আমরা কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই এই নিয়মের তোয়াক্কা না করে শাসনের জন্য প্রথমেই প্রহার আরম্ভ করি। এটি অনুচিৎ ইসলামি শরিয়তের বাতলানো পন্থার বিপরিত। সকল ক্ষেত্রে ইসলামি নিয়ম-কানুনের প্রতি লক্ষ রাকা উচিৎ। তাতে পরিণাম মঙ্গল জনক হয়ে থাকে। অন্যথায় নেমে আসে বিপদ।
শাসনের কিছু আদব
এক. দশ বছরের পূর্বে শাসন না করা চাই
عَنْ عَمْرِو بْنِ شُعَيْبٍ، عَنْ أَبِيهِ، عَنْ جَدِّهِ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: ্রمُرُوا أَبْنَاءَكُمْ بِالصَّلَاةِ لِسَبْعِ سِنِينَ، وَاضْرِبُوهُمْ عَلَيْهَا لِعَشْرِ سِنِينَ، وَفَرِّقُوا بَيْنَهُمْ فِي الْمَضَاجِعِ
অর্থ: তোমাদের সন্তানদেরকে তোমরা নামাযের নির্দেশ দাও যখন তারা সাত বছর বয়সে উপনীত হয় এবং নামাযের জন্যে তাদেরকে প্রহার কর যখন তারা দশ বছর বয়সে উপনীত হয়। আর তাদের শোয়ার স্থান পৃথক করে দাও।” -[মুসনাদে আহমদ : ১১/৩৬৯]
দুই. কারো সামনে শাসন না করা, কারণ এতে সে লজ্জিত হয়।
عَنْ سُلَيْمَانَ بْنِ بُرَيْدَةَ، عَنْ أَبِيهِ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: ্র وَمَنْ عَيَّرَ مُسْلِمًا فِي خَادِمِهِ وَأَهْلِهِ فَلَيْسَ مِنَّاগ্ধ
অর্থ: সালমান বিন বুরাইদাহ (রা.) তার পিতা হতে তিনি হুজুর সা. হতে বর্ণনা করেছেন, হুজুর সা. এরশাদ করেছেন, যে কোন মুসলমানকে তার চাকর-নওকর ও পরিবারের সামনে অপদস্থ করলো সে আমার উম্মত নয়। -[মুসনাদে রাওয়ানী ১/৬৪]
তিন. খুব জোরে প্রহার করবে না
وقد قال عمر بن الخطاب رضي الله عنه لمن يقوم بضرب طفله لا ترفع إبطك، أي لا تضرب بكل قوتك.
অর্থ: হযরত ওমর রা. এর উক্তি ঐ সব লোকদের জন্য যারা সন্তানদেরকে শাসন করতো “ তুমি সন্তানের উপর বগল উঠাবে না” অর্থাৎ শক্তি দিয়ে প্রহার করবে না। তিনি বলতেন হুজুর সা. হতে এরূপই বর্ণিত হয়েছে। -[গারায়েবুত তাফসীর ও আজায়েবুত তাবীল ২/৭৮৮]
চার. শাসনের স্থলে শাসন করবে, সুতরাং চেহারায়, লজ্জাস্থানে ও মাথায় অর্থাৎ কোন স্পর্শকাতর স্থানে আঘাত করবে না।
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: ্রإِذَا ضَرَبَ أَحَدُكُمْ فَلْيَتَّقِ الْوَجْهَগ্ধ
অর্থ: হুজুর (সা.) এরশাদ করেন : যখন তোমরা কাউকে মারবে তখন মাথায় আঘাত করবে না। (আবু দাউদ : ৪/ ১৬৭)
অন্য রেওয়ায়েতে আছে,
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ عَنْهُ عَلَيْهِ الصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ قَالَ: ্রإِذَا ضَرَبَ أَحَدُكُمْ، فَلْيَتَّقِ الْوَجْهَ وَالْمَذَاكِيرَ
অর্থ: হুজুর (সা.) সীমানার ভিতরে মারধরের আদেশ করেছেন ও বলেছেন, তোমরা চেহারা ও লজ্জাস্থানে মারা থেকে বেঁচে থাকো। -[নসবুর রাইয়াহ : ৩/৩২৪ মিরকাতুল মাফাতিহ ২/ ১৩২]
পাঁচ. রাগাম্বিত অবস্থায় শাসন করবে না
لا تقوم بضرب طفلك وأنت غاضب، لأنك بذلك تفرغ شحنة غضبك وليس تضربه لمعاقبته.
অর্থ: আপনি আপনার সন্তানকে রাগান্বিত অবস্থায় মারবেন না। কেননা তখনতো আপনি নিজের রাগ প্রমশনের জন্য শাসন করছেন, তার সংশোধনের জন্য শাসন করছেননা।
ছয়. সন্তান আল্লাহর দোহাই দিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করলে সাথে সাথেই শাসন ক্ষান্ত করে দিবে।
عَنْ أَبِي سَعِيدٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: ্রإِذَا ضَرَبَ أَحَدُكُمْ خَادِمَهُ فَذَكَرَ اللَّهَ فَارْفَعُوا أَيْدِيَكُمْগ্ধ
অর্থ: হুজুর (সা.) এরশাদ করেছেন, খাদেমকে শাসনকালে সে যদি আল্লাহর নাম নেয়, তবে সাথে সাথে হাত তুলে নিবে। -[মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবাহ : ৫/৫২৯ মেশকাতুল মাসাবিহ ২/ ১০৩]
অতি শাসনের কুফল
১. মানসিক বিকাশের পথ রুদ্ধ করে দেয়
অতি শাসন বাচ্চাদের সাবলীল বিকাশের পথ রুদ্ধ করে দেয়। তার সৃজনশীলতা বিকশিত হওয়ার ক্ষেত্রে বাঁধা সৃষ্টি করে থাকে। সে হীনমান্যতায় ভোগে এবং যেকোন বিষয়েই সিদ্ধান্ত নিতে ভয় পায়। অনেকসময় অনেক শিশু হতাশায় আক্রান্ত হয়ে পড়ে।
২. বাচ্চা ভীরুতা নিয়ে বেড়ে উঠে
অনেকসময় অতিরিক্ত শাসনের ভয় বাচ্চাকে ভীতু বানিয়ে দেয়। সে সারাক্ষণ ভয়ে ভয়ে কাটানোর ফলে ভীরুতা নিয়ে বেড়ে উঠছে। এছাড়াও আপনার প্রতি তার বিরূপ ধারণা জন্ম নিচ্ছে।
৩. বেশি একরোখা আচরণ করে
অনেক সময় অতি শাসনে শিশু বেকে যায়। অবাধ্য আচরণ বেড়ে যায়। জেদ করে একরোখা হয়ে গড়ে উঠে। সে কথা তো মানেই না বরং আরও সহিংস কাজকর্মে জড়িয়ে পড়ে।
৪. শারীরিক শাস্তি বিরূপ প্রভাব ফেলে
বাচ্চাকে বশে আনার জন্য শারীরিক শাস্তি প্রদান করা হলে সে মনে করবে এটাই সঠিক পন্থা কাউকে বশে আনার ক্ষেত্রে। সে মন মানসিকতায় সহিংসতাকে সাপোর্ট করে বেড়ে উঠবে। আর তার মধ্যে ধারণা জন্মাবে যে, সবলরা দুর্বলের উপর সহিংস আচরণ করতেই পারে।
৫. লেখাপড়ায় মনোযোগ কমে যাবে
শারীরিক শাস্তির ভয়ে পড়তে বসলেও তা ঠিকমত আত্মস্থ করতে পারবে না। ফলে পড়া ভালভাবে মনে রাখতেও পারবে না। সেক্ষেত্রে স্কুলে/মাদ্রাসাতে আশানুরূপ ফলাফল করতে পারবে না। যার ফলে পড়া-লেখার প্রতি অমনোযোগী হয়ে পড়বে।
৬. মিথ্যে কথা বলা শিখবে
শাস্তির ভয়ে হয়তো আপনার কাছে কথা গোপন করবে বা মিথ্যে বলবে। আর এই মিথ্যে থেকেই সকল অসততার বীজ বপন শুরু হয়ে থাকে। ফলে তার নৈতিকতার ভিত দুর্বল হয়ে গড়ে উঠবে।
৭. মা-বাবার সাথে দূরত্ব বেড়ে যাবে
অতিরিক্ত শাসন মা-বাবার সাথে সন্তানের দ‚রত্ব বাড়িয়ে দেয়। অনেক সময় তিক্ত সম্পর্কের সূচনা হয়। যা খুবই দুঃখজনক ব্যাপার। আর এই তিক্ত সম্পর্ক, দূরত্ব ইত্যাদির কারণে সুন্দর সাবলীল সম্পর্কগুলো নষ্ট হয়।
সুতরাং এসব সমস্যা যাতে না হয়, সেদিকে আপনার সতর্ক দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন। আর এক্ষেত্রে আপনার করণীয় বিষয়গুলো দেখে নিন:
১. অতি শাসন বন্ধ করুন।
অতিরিক্ত কোন কিছুই ভালোনা। আর তাইতো শাসনের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করবেন না। বাচ্চার অন্যায় আচরণের জন্য তাকে বুঝিয়ে বলুন কিংবা সীমিত ভাবে শাসন করুন। কিন্তু কখনোই গায়ে হাত তুলবেন না। চেষ্টা করুন আপনার সন্তান যেন ভালবেসেই আপনার কথা শুনে, বাধ্য হয়।
২. সন্তানের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলুন
সন্তান যেন বন্ধুর মত সব কিছু আপনার সাথে শেয়ার করতে পারে, সেই আস্থার জায়গা তৈরি করুন। তার সমস্যাগুলো সমাধান করতে চেষ্টা করুন। তার সাথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলুন। তার মতামতের মূল্য দিতে চেষ্টা করুন।
৩. ভাললাগা-খারাপ লাগার দিকে খেয়াল রাখুন
আপনার সন্তানের ভাললাগা, খারাপ লাগা ইত্যাদির দিকে খেয়াল রাখুন। তার উপর কোন কিছু চাপিয়ে দিতে যাবেন না। মন থেকে কোন বিষয় মেনে নিতে না পারলে, সে তাতে ভালও করতে পারবে না। সুতরাং তার পছন্দ অপছন্দ গুরত্বের সাথে বিবেচনা করুন।
৪. অন্যের সাথে তুলনা করবেন না
এই পৃথিবীতে কেউই কারো মতো নয়। আর সব বাচ্চা একরকম হয় না। সেক্ষেত্রে মেধা, যোগ্যতা, দক্ষতা বিষয়ে অন্য কারো সাথে তুলনা না করাই ভাল। এসব তুলনা করলে বাচ্চা হীনম্মন্যতায় ভুগবে। বরং কিভাবে বাচ্চার যোগ্যতা, দক্ষতা বাড়ানো যায় সেদিকে সচেষ্ট হোন।
৫. অপমানসূচক কোন কথা বলবেন না
বাচ্চাকে সবার সামনে অপমানসূচক কোন কথা বলা বা গায়ে হাত তোলা থেকে বিরত থাকুন। ছোট্ট বাচ্চারা অনেক বেশি সংবেদনশীল হয়। এবং ওদেরও ভীষণ অপমানবোধ আছে। আর আপনার এই আচরণ তাকে আরও বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলে দিচ্ছে।
৬. বাচ্চাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে কথা শোনান
আপনার সন্তানকে বিভিন্ন বিষয়ে বকাঝকা বা গায়ে হাত না তুলে বরং বুঝিয়ে বলুন। তাকে আপনার মতো করে কেউই বোঝাতে পারবে না। তার কোন্ কোন্ আচরণ সঠিক নয়, সেটা তাকে উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দিন। এবং আস্তে আস্তে তা সংশোধন করতে চেষ্টা করুন।
৭. ধৈর্য ধরে বাচ্চার ভুল শোধরাতে চেষ্টা করুন
অনেকসময় ধৈর্য ধরে মমতার পরশ দিয়ে অবাধ্য সন্তানকে বাধ্য করতে হয়। সময়ের সাথে সাথে তার ভুলগুলো শুদ্ধ করতে সচেষ্ট হতে হবে। আজ যে অবুঝ কাল সে ঠিকই বুঝতে পারবে। আর তাইতো সে যেন উদার মনের ভাল মানুষ হয়ে গড়ে উঠে সে চেষ্টা করতে হবে।
লেখক: শিক্ষাসচিব, জামিয়া ইসলামিয়া জহিরুদ্দিন আহমদ মাদরাসা মানিকনগর।
-এএ