মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪ ।। ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


ইসলামের দৃষ্টিতে শাসনের নীতিমালা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুফতি আব্দুর রহিম।।

সাম্প্রতিক মাদরাসার একজন শিশু শিক্ষার্থীকে শিক্ষক কতৃক বেধড়ক প্রহারের ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। যা শেষ পর্যন্ত মামলা মকাদ্দমা পর্যন্ত গড়িয়েছে। ইতিপূর্বেও এজাতীয় ঘটনা বহুবার ঘটেছে। শাসনের নামে এজাতীয় প্রহার না শরিয়ত সমর্থিত, না রাষ্ট্র ও সমাজ। কারণ এটি শাসন নয়, বরং শাসনের নামে এটি নির্যাতন। তাই শাসনের নীতিমালা ও পদ্ধতি, সীমা অতিরিক্ত শাসনের পরিণতি সম্পর্কে ইসলামি শরীয়ার দৃষ্টি ভঙ্গি নিয়ে কিছু আলোকপাত করা ইচ্ছে করেছি।

সন্তানকে শাসনের ফজিলত
وعن معاذ بن جبل رضي الله عنه أن النبي - صلى الله عليه وسلم - قال: وَأَنْفِقْ عَلَى عِيَالِكَ مِنْ طَوْلِكَ، وَلاَ تَرْفَعْ عَنْهُمْ عَصَاكَ أَدَبًا، وَأَخِفْهُمْ فِى اللَّهِ.

অর্থ: মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল সা. এরশাদ করেছেন, তুমি তোমার সাধ্যানুযায়ী পরিবারের উপর খরচ কর, এবং কখনো তাদের থেকে আদবের লাঠি উঠাবে না। এবং তাদেরকে আল্লাহ তায়ালার ভয় দেখাবে। -[ফাতহুল গাফফার : ৩/১৪৯ মুসনাদে আহমদ : ২২১০]

অপর হাদীসে আছে,
عَنْ مُحَمَّدِ بْنِ الْمُنْكَدِرِ رضي الله عنه قَالَ : ্রإِنَّ اللَّهَ لَيُصْلِحَ بِصَلَاحِ الْعَبْدِ وَلَدَهُ، وَوَلَدَ وَلَدِهِ، وَيَحْفَظُهُ فِي دُوَيْرَتِهِ، وَالدُّوَيْرَاتِ الَّتِي حَوْلَهُ مَا دَامَ فِيهِمْগ্ধ
অর্থ: মোহাম্মাদ ইবনুল মুনকাদির (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, বান্দা যতক্ষন নিজ সন্তান ও নাতী নাতনীদের তালীম তরবীয়্যাতে থাকবে, ততদিন আল্লাহ তায়ালা তার সমস্যাগুলোকে নিজ দায়িত্বে পূরণ করতে থাকবেন। এবং তার ঘর বাড়ি ও তার আশপাশকে আল্লাহ তায়ালা নিজ দায়িত্বে হেফাজত করবেন। -[আজজুহুদ ওররাকায়েক লি ইবনে মোবারক, ১/১১১ ও আজজুহুদ লি নায়িম বিন হাম্মাদ ১/১১১]

অপর হাদীসে আছে,
عَن جَابر رضي الله عنه عَن النَّبِي صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّم َ قَالَ رحم الله رجلا علق فِي بَيته سَوْطًا يُؤَدب بِهِ أَهله
অর্থ: যাবের রা. হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল সা. এরশাদ করেন, আল্লাহ তায়ালা ঐ ব্যক্তির উপর রহমত নাযিল করেন, যে পরিবারস্থদের আদব শিক্ষা দেয়ার জন্য ঘরে বেত টাঙ্গিয়ে রাখে।-[তাখরিজুল আহাদীসিল কাস্সাফ : ১/৩১৬]

সীমা অরিরিক্ত শাসনের পরিণাম
আমরা যারা শাসনের নামে শিশুদের বেধড়ক মারধর করি তারা নিন্মোক্ত হাদীসের মর্মের প্রতি লক্ষ করলে বুঝতে পারবো যে হাশরের ময়দানে আমাদের পরিণতি কি হবে?
عَنْ عَائِشَةَ، أَنَّ رَجُلاً، قَعَدَ بَيْنَ يَدَىِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنَّ لِي مَمْلُوكَيْنِ يُكْذِبُونَنِي وَيَخُونُونَنِي وَيَعْصُونَنِي وَأَشْتُمُهُمْ وَأَضْرِبُهُمْ فَكَيْفَ أَنَا مِنْهُمْ قَالَ ‏"‏ يُحْسَبُ مَا خَانُوكَ وَعَصَوْكَ وَكَذَبُوكَ وَعِقَابُكَ إِيَّاهُمْ فَإِنْ كَانَ عِقَابُكَ إِيَّاهُمْ بِقَدْرِ ذُنُوبِهِمْ كَانَ كَفَافًا لاَ لَكَ وَلاَ عَلَيْكَ وَإِنْ كَانَ عِقَابُكَ إِيَّاهُمْ دُونَ ذُنُوبِهِمْ كَانَ فَضْلاً لَكَ وَإِنْ كَانَ عِقَابُكَ إِيَّاهُمْ فَوْقَ ذُنُوبِهِمُ اقْتُصَّ لَهُمْ مِنْكَ الْفَضْلُ ‏"‏ ‏.‏ قَالَ فَتَنَحَّى الرَّجُلُ فَجَعَلَ يَبْكِي وَيَهْتِفُ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ‏"‏ أَمَا تَقْرَأُ كِتَابَ اللَّهِ ‏:‏ ‏(‏ ونَضَعُ الْمَوَازِينَ الْقِسْطَ لِيَوْمِ الْقِيَامَةِ فَلاَ تُظْلَمُ نَفْسٌ شَيْئًا وَإِنْ كَانَ مِثْقَالَ ‏)‏ الآيَةَ

অর্থ: আয়েসা রা. থেকে বর্ণিত: নবী সা.-এর সম্মুখে বসে এক লোক বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমার কয়েকটি গোলাম আছে। আমার নিকট এরা মিথ্যা কথা বলে, আমার সম্পদে ক্ষতিসাধন (খিয়ানাত) করে এবং আমার অবাধ্যতা করে। এ কারণে তাদেরকে আমি বকাবকি ও মারধর করি। তাদের সাথে এমন ব্যবহারে আমার অবস্থা কি হবে? তিনি বললেন, তারা যে তোমার সাথে খিয়ানাত করে, তোমার অবাধ্যতা করে এবং তোমার নিকট মিথ্যা বলে, আর এ কারণে তাদের সাথে তুমি যেমন আচরণ কর- এ সবেরই হিসাব-নিকাশ হবে। যদি তোমার দেয়া শাস্তি তাদের অপরাধের সমান হয় তবে ঠিক আছে। তোমারও কোন অসুবিধা হবে না তাদেরও কোন অসুবিধা হবে না। যদি তোমার দেয়া শাস্তি তাদের অপরাধের তুলনায় কম হয় তাহলে তোমার জন্য অতিরিক্ত (সাওয়াব) রয়ে গেল। তোমার প্রদত্ত শাস্তি যদি তাদের অপরাধের তুলনায় বেশি হয়, তাহলে অতিরিক্ত অংশের জন্য তোমাকে শাস্তি পেতে হবে। বর্ণনাকারী বলেন, এ কথা শুনে লোকটি চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে আলাদা হয়ে গেল।

রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, আল্লাহ তা‘আলার কিতাবে তুমি কি এ কথা পড় না? ونَضَعُ الْمَوَازِينَ الْقِسْطَ لِيَوْمِ الْقِيَامَةِ فَلاَ تُظْلَمُ نَفْسٌ شَيْئًا وَإِنْ كَانَ مِثْقَالَ (অনুবাদ)- “আমরা ক্বিয়ামাতের দিন ন্যায়বিচারের দাঁড়িপাল্লা স্থাপন করব। সুতরাং কোন লোকের উপর কোন যুলুম করা হবে না। কারো বিন্দু পরিমাণও কিছু কৃতকর্ম থাকলে আমরা তাও হাযির করব। আর হিসাব সম্পন্ন করার জন্য আমরাই যথেষ্ট”- (সূরা আম্বিয়া ৪৭)। (তিরমিযী : হাদীস নং ৩১৬৫)

হাদীসের আলোকে আখেরাতের শাস্তি বুঝতে পারলাম। দুনিয়ার শাস্তিও কম নয়। জেল জরিমানা, নেট জগতে ভাইরাল হওয়া, মানুষের ঘৃণার পাত্র হওয়া, চাকরি হারানো ইত্যাদি যা হয়ে থাকে এসব আল্লাহর পক্ষ হতে দুনিয়ার শাস্তিরই নামান্তর।

শাসনের জন্য বেতের ব্যবহার
কুরআনের আয়াত ও হাদীস হতে এর বৈধতা পাওয়া যায়। কুরআনে কারীমে স্ত্রীদের শাসনের ক্ষেত্রে এরশাদ করা হয়েছে
وَاضْرِبُوهُنَّ অর্থ : এবং প্রহার কর। (সূরা নিসা : আয়াত : ৩৪) অত্র আয়াতে নারীদের শাসনের জন্য বেতের প্রয়োগের অনুমতি প্রদান করা হয়েছে। তাছাড়া পূর্বে ফযীলতের আলোচনায় উল্লেখিত হাদীস সমূহেও প্রহারের উল্লেখ করা হয়েছে। আর প্রহার বেত দিয়েই হয়ে থাকে। তাই বুঝা গেলো বেত দিয়ে প্রহার অবৈধ নয়। তবে জানার বিষয় হলো বেতের প্রয়োগ কোন বয়সের সন্তানের জন্য কার্যকরী ও কতটুকু প্রহার বিধি সম্মত?

কত বয়সে প্রহার বিধি সম্মত?
হাদীসে হুজুর সা. নামাযের জন্য প্রহারের যেই আদেশ দিয়েছেন তাতে উল্লেখ রয়েছে যে, وَاضْرِبُوهُمْ عَلَيْهَا لِعَشْرِ سِنِينَ তথা “তাদেরকে দশ বৎসর বয়সে উপনিত হলে নামাযের জন্য প্রহার করো”। যা হতে বুঝা যায় দশ বৎসরের কম বয়সের শিশুদের ক্ষেত্রে প্রহার বিধিসম্মত নয়।

কতটুকু প্রহার বিধি সম্মত?

সূরা নিসা: আয়াত ৩৪ এর তফসীরে জালালাইন শরীফে উল্লেখ রয়েছে واضربوهن ضربا غير مبرح (তফসীরে জালালাইন ১/১০৬) অর্থাৎ এমন প্রহার করো যাতে শরীরে দাগ না লাগে। তাই শরীরে দাগ লেগে যাওয়া প্রহার শরীয়ত সম্মত নয়।

রদ্দুর মুহতার ১ম খন্ড ৩৫১ পৃষ্ঠায় একটি হাদীন বর্ণিত হয়েছে, যাতে হুজুর সা. হযরত মিরদাস রা. এক সম্বোদন করে বলেছিলেন, إيَّاكَ أَنْ تَضْرِبَ فَوْقَ الثَّلَاثِ، فَإِنَّك إذَا ضَرَبْت فَوْقَ الثَّلَاثِ اقْتَصَّ اللَّهُ مِنْك অর্থাৎ খবরদার! বাচ্চাদেরকে তিনের বেশি মারবে না। কেননা যদি তুমি তিনের বেশি মারো, তাহলে আল্লাহ তা’য়ালা কিয়ামতের দিনে তোমার থেকে আর কিসাস বা বদলা নিবেন। এ থেকে বুঝা যায় শিশু সন্দানকে তিন বারের বেশি প্রহার করা নিষেধ।

কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে আমরা শাসনের ক্ষেত্রে এইসর নির্দেশের প্রতি কোন ভ্রুক্ষেপ করি না।

লেখক: শিক্ষাসচিব, জামিয়া ইসলামিয়া জহিরুদ্দিন আহমদ মাদরাসা মানিকনগর।


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ