রফিকুল ইসলাম জসিম: মূলধারার শিক্ষাব্যবস্থায় বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জাতি গোষ্ঠীর মাতৃভাষা সংযুক্ত না করায় মাতৃভাষার চর্চা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ছেলে মেয়েরা। তাদের নিজস্ব মাতৃভাষা চর্চা এখন অনেকটাই মৌখিক কথার ওপর নির্ভর হয়ে পড়েছে। অধিকাংশ শিশুরা মাতৃভাষা পড়তে-লিখতে পারেন না।
২০১০ সালে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট আইন ২০১০’ প্রণীত হয়েছিল। দেশের ৪০ টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের ভাষাগুলোর মধ্যে মোটামুটি ৮টি ভাষার যৎসামান্য বর্ণমালা এবং ভাষালিপি আছে। সে হিসেবে ২০১৪ সাল থেকে চাকমা, মারমা, সাঁওতাল, ত্রিপুরা, গারো এবং সাদরি ভাষায় প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ে মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করার উদ্যোগ গ্রহন করেন ৷ মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রেও এখন পর্যন্ত মাত্র পাঁচটি ভাষায় তিনটি করে বই প্রকাশ হয়েছে৷
বাংলাদেশে বসবাসরত প্রতিটি নৃগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা থাকলেও তাদের মধ্যে অধিকাংশের ভাষারই নেই নিজস্ব বর্ণমালা। লিখিত রূপ না থাকায় তাদের ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠির মধ্যে রয়েছে সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য।
তাদের গান, ছড়া, কবিতা, উপকথা, রূপকথা, মিথোলজি, এগুলো কিন্তু বাংলাদেশের অমূল্য সম্পদ। এই সম্পদ ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে, বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। একুশের চেতনাকে সমুন্নত করতে এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা অটুট রাখতে সব জাতির মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করা জরুরি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলা ছাড়াও অন্য ভাষাগুলো ব্যবহারের অধিকার, চর্চা, গবেষণা ও রাষ্ট্রের মনোভাবের বিষয়ে জানতে চাইলে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা পদক পাওয়া মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা বলেন, ‘আগের চেয়ে এই ভাষাগুলো রক্ষায় উদ্যোগ বেড়েছে৷ তরুণদের মধ্যে এক ধরনের আগ্রহ তৈরি হয়েছে৷ তবে গবেষণাসহ অনেক কিছুই এখনও বাকি৷ সরকার চাইলে এই উদ্যোগগুলো নিতে পারে৷ এই ভাষাগুলোর ব্যবহার যত বাড়বে ততই এটা সমৃদ্ধ হবে৷’
২০১০ সালের শিক্ষা নীতিতে মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার প্রচলন হলেও তা কার্যকর হয়েছে ২০১৭ সালে৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মেজবাহ কামাল বলেন, ‘এই কাজটা খুবই সামান্য এগিয়েছে৷ এ পর্যন্ত মাত্র পাঁচটি ভাষায় তিনটি করে বই হয়েছে৷ এছাড়া কোন কাজই হয়নি৷ শিক্ষক নিয়োগ, শিক্ষার কারিকুলাম, প্রশিক্ষন এখনও কিছুই হয়নি৷’
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট বলছে, বাংলা ছাড়া অন্য ভাষাগুলোর (নৃ-গোষ্ঠীর মাতৃভাষা) মধ্য থেকে কয়েকটি ভাষা সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে তারা৷ নানা বিষয়ে গবেষণা চলছে৷ দেশের যেকোন ব্যক্তি, শিক্ষাবিদ ও প্রতিষ্ঠান এই গবেষণায় অংশ নিয়ে ভাষা বৈচিত্র্যকে সমৃদ্ধ করতে পারেন৷ এজন্য সহযোগিতা দেবে তারা৷ এগুলো পরবর্তীতে ইনস্টিটিউটের আর্কাইভে সংরক্ষিত থাকবে৷
একই স্কুলে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর শিক্ষাথীরা পড়েন। তবে নিজ সম্প্রদায়ে বর্ণমালা সংরক্ষণে উদ্যোগ না থাকায় ভাষা ও বর্ণমালা সংরক্ষণের বিষয়টিকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে বলে জানান আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউটের পরিচালক শাফিউল মুজনবীন।
ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠির ভাষা সংকট থেকে উত্তরণের জন্য কেবল একতরফাভাবে রাষ্ট্রকে দায়ী করা যুক্তিসঙ্গত নয়। সংশ্লিষ্ট ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখতে প্রয়োজন নিজস্ব ভাষাভাষীদের মধ্যে সচেতন প্রয়াস। একটি সমন্বিত পরিকল্পনা। এক্ষেত্রে সময় থাকতেই বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষা ও বর্ণমালা সংরক্ষণে মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন বলে গবেষকরা মনে করছেন।
-এটি