আওয়ার ইসলাম: বর্তমানে কওমি শিক্ষকদের গড় বেতন ছয় থেকে সাত হাজারের বেশি নয়। এক বস্তা চালের দাম যখন দুই থেকে তিন হাজার টাকা, তখন পাঁচ থেকে সাত হাজারে চার পাঁচ সন্তানের ভরণ- পোষণ, মা-বাবা, স্ত্রী, ভাই-বোনের দেখভাল কিভাবে চলবে? এটা ভাবার মতো সময় মাদরাসা কর্তৃপক্ষ বা মুহতামিমের কখনোই হয়ে উঠে না ৷ কারণ তাদের পকেট সর্বদাই ভারি থাকে ৷ তারা অভাব বুঝে না ৷
অনেকে বলেন হুজুরদের টাকায় বরকত আছে। কতো ভালো চলেন হুজুররা! كلمة حق اريد بها الباطل (কথা সত্য তবে উদ্দেশ্য খারাপ)। কিছুদিন আগে মাদরাসার একজন শিক্ষককে নিজের ছোট ছেলের অপারেশনে মাত্র চল্লিশ হাজার টাকার জন্য কাকুতি মিনতি করে সহযোগিতা চাইতে দেখলাম। পরে মানুষের ধারে ধারে ঘুরতেও দেখেছি। দেখেছি পঞ্চাশ বছর শিক্ষকতার পর সামান্য চিকিৎসা খরচের জন্য চাঁদা কালেকশন করতে। দশ বছর চাকরি করে বিয়ের খরচ যোগাড় করতে না পেরে যৌতুক নিয়ে বিয়ে করতে।
তবে এটা ঠিক, শত অভাবের মাঝেও হাঁসি মুখে, পরিচ্ছন্ন বদনে সবার মাঝে বিচরণের এক অদ্ভূত যোগ্যতা আছে কওমি ওলামায়ে কেরামদের। কিন্তু বাস্তবতা বড়ই নিষ্ঠুর, অসম্ভব কষ্টের। যা সহজে প্রকাশ করে না।
সম্মানিত পাঠক!
মাদরাসায় উঁচু উঁচু ইমারত তৈরিতে টাকার অভাব হয় না। সব অভাব শিক্ষকদের বেতন দিতে। কিংবা বৃদ্ধিতে। বেতন বাড়ানোর সময় কর্তৃপক্ষের উজ্বল চেহারা মলিন হয়ে যায়। অথচ সবার আগে শিক্ষকদের জীবনমান, থাকা -খাওয়ার সুন্দর বন্দোবস্ত করা উচিৎ ছিলো। অথচ মাদরাসাগুলোতে সবচেয়ে অবহেলিত বিষয় শিক্ষকদের অধিকার।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, শিক্ষকদের বেতনের এক আজগুবি নাম দেয়া হয়েছে হাদিয়া! তার মানে এটা নিয়ে যেনো কেউ জোর খাটাতে না পারে! কিন্তু যখন কোনো শিক্ষক দু’দিন অনুপস্থিত থাকেন তখন তার দুই দিনের টাকা কাটার ব্যাপারে এটা বেতন হয়ে যায়। তখন আর হাদিয়া থাকে না। সুতরাং এটা বেতনই, হাদিয়া নয়। এটা তার প্রাপ্য তার অধিকার। এটা ন্যায্য হওয়া চাই।
যেখানে একজন প্রাইমারি শিক্ষকের বেতন বিশ থেকে পঁচিশ হাজার। সেখানে একজন কওমি সিনিয়র শিক্ষকের বেতন ছয় সাত হাজার! এটা শুধু অন্যায্য নয়; বরং অপমানজনকও বটে।
অনেকে বলতে পারেন, ভালোই তো চলছে। কোনো অভিযোগ তো নেই। সমস্যাও তো দেখা যায়না। হ্যাঁ সমস্যা অনেক গভীরে।
কওমি শিক্ষকদের এই আর্থিক কাটামোর কারণে এখনো কওমি শিক্ষা নিম্নবিত্তের শিক্ষা হিসেবে রয়ে গেছে। এখানে উচ্চবিত্ত কিংবা উচ্চ-মধ্যবিত্তের সন্তানরা আসছে না। কারণ একজন অভিভাবক তার সন্তানের শিক্ষার পাশাপাশি তার ইহকালিন জীবন মানের চিন্তাও করে থাকেন। এই চিন্তাটা দোষের কিছু নয়।
ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি উন্নত জীবন ব্যবস্থার ধারণা ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক বিষয় নয়। এই চিন্তাটায় কারো দুর্বল ঈমানের প্রশ্ন তোলা একধরণের বোকামী। একজন মানুষ ধার্মিক হলেই তাকে গরিব হতে হবে এই ধারণা মুর্খতা। সুতরাং এই চিন্তা থেকেই কওমি মাদরাসা এখনো গণমানুষের প্রতিষ্ঠান হিসেবে সর্বস্তরে সমাদৃত হতে পারেনি।
অপরদিকে এই মানহীন জীবনব্যবস্থা কওমি মাদরাসাকে মেধাশুন্য করে দিচ্ছে। হিসেব করে দেখুন, কয়জন মেধাবী কওমি ছাত্র শিক্ষকতা পেশায় যোগ দিচ্ছে? বলা যায় খুবই কম সংখ্যক। হয় তারা জেনারেল লাইনে চলে যাচ্ছে, অথবা কিছুদিন খেদমত করে উন্নত জীবনব্যবস্থার তাগিদে বিদেশ পাড়ি জমাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে হাজার হাজার মেধাবী আলেম বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত। এরা চাকরির অভাবে নয় বরং সবদিক কুলিয়ে উঠতে না পেরে দেশ ছেড়েছেন। এভাবে চলতে থাকলে মানসম্পন্ন শিক্ষক শূণ্যতায় ভোগবে কওমি মাদরাসাগুলো।
জামিয়া পটিয়ার সাবেক পরিচালক আল্লামা হারুন ইসলামাবাদি রহ. বলছেন, ‘কওমি মাদরাসা কখনো অর্থাভাবে বা কারো ষড়যন্ত্রে বন্ধ হবেনা, যদি কখনো বন্ধ হয় তাহলে যোগ্য লোকের অভাবেই হবে।’
আর যোগ্য ও মেধাবিদের ধরে রাখতে হলে অবশ্যই তাদের থাকা, খাবার এবং আর্থিক দিক মানসম্পন্ন করতেই হবে।
সম্মানিত পাঠক!
মনে রাখতে হবে উঁচু দালানের চেয়ে একজন ভালো শিক্ষক কওমি মাদরাসার জন্যে বেশী প্রয়োজন।লেখাটা পড়ে হয়তো অনেকেই খুলুসিয়তের ওয়াজ করবেন। ফুলুসের টানাপোড়নে খুলুসিয়তের দুর্দশা দেখেছি অনেক। এটা রাসুল সা. এর হাদিসও বটে।
সুতরাং বাস্তবতার নিরিখে লিল্লাহিয়াত খোঁজাই বুদ্ধিমানের কাজ। সব মিলিয়ে এখনই ভাবার সময়। পৃথিবী এগিয়েছে মানুষের মনস্তাত্বিক জগতের পরিবর্তন হয়েছে। তার সাথে সামঞ্জস্যতা রাখতে না পারলে পিছিয়ে পড়তে হবে নিশ্চিত।
এমডব্লিউ/