মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪ ।। ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


বনী ইসরায়েলের তিন ভাই ও শয়তানের চিকন চক্রান্ত!

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

ড. শায়েখ মাহমদুল হাসান

বনী ইসরাঈলে ছিল এক আল্লাহর অলী, যুগশ্রেষ্ঠ আবেদ। গির্জায় থাকেন তিনি। আল্লাহর ইবাদত করেন। সারাদিন ইবাদতে মশগুল থাকেন। আল্লাহর ইবাদতই তাঁর একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান।

বনী ইসরাঈলের এক পরিবারে ছিল তিন ভাই। তাদের ছিল এক বোন। অবিবাহিতা। পরিবারে আর কোনো সদস্য ছিল না। একবার তিন ভাই মনস্থ করল, আল্লাহর পথে জিহাদে বের হবে। কিন্তু তারা বোনকে নিয়ে বিপাকে পড়ল। তাকে কোথায় রেখে যাবে? কার কাছে রেখে যাবে? কোথায় পাবে তার জন্য নিরাপদ আশ্রয়? অনেক চিন্তা-ভাবনা করল তারা। শেষে সিদ্ধান্ত নিল, তাদের একমাত্র বোনকে রেখে যাবে আবেদের কাছে, দরবেশের তত্ত্বাবধানে। সেখানেই নিরাপদে থাকবে।

আবেদ একজন সজ্জন ব্যক্তি। বিশ্বস্ত লোক। তাই তারা এ ব্যাপারে তার সঙ্গে আলোচনা করল। কিন্তু তিনি প্রস্তাবটি কঠোরভাবে প্রত্যখ্যান করলেন। বললেন, ‘নাউজুবিল্লাহ’! ‘নাউজুবিল্লাহ’!! না, তা কক্ষনো হতে পারে না।

কিন্তু তারা নাছোড়বান্দা। আবেদকে পীড়াপীড়ি করতে লাগল। শেষ পর্যন্ত রাজি হলেন তিনি। তাদের প্রস্তাব গ্রহণ করলেন। বললেন :
-আচ্ছা, গির্জার পাশের ঘরটিতে তাকে রেখে যাও।

তারা সে ঘরে বোনটিকে রেখে বিদায় নিল। মেয়েটি গির্জার পাশের ঘরে থাকত। একা একা। খাবারের সময় হলে আবেদ গির্জা থেকে খাবার নিয়ে যেত। মেয়েটির ঘরের সামনে রেখে আসত। কিছুক্ষণ পর মেয়েটি ঘর থেকে বেরিয়ে এসে খাবার নিয়ে যেতো। এভাবে দিন চলে যেতে লাগল। একদিন শয়তান এলো আবেদের কাছে। ফুসলাতে লাগল, বেশ যুক্তি দিয়ে।

বলল -দিনের বেলায় মেয়েটির ঘর থেকে বের হওয়া কি ঠিক হচ্ছে? কেউ তাকে দেখে ফেললে তার সঙ্গে ঝুলে যেতে চাইবে। এর চেয়ে ভালো, তুমি নিজে তার রুমের দরজায় খাবার রেখে আসবে। সামান্য এ কষ্টের জন্য তুমি অনেক ছওয়াব পাবে।

তখন আবেদ খাবার নিয়ে তার রুমের দরজায় রেখে আসত। কোনোরকম কথাবার্তা বলত না। বেশ কিছুদিন এভাবে চলল। কিছুদিন পর আবার এলো ইবলিস। আরো ছওয়াব অর্জনের সুবর্ণ পথ খুলে দিতে। এসে বলল-মেয়েটি কেমন অসহায়! একাকী বসে থাকে!! তুমি একটু-আধটু তার সঙ্গে কথা বললে, ভালো লাগত তার, আনন্দ পেত। সারাদিন কেমন একা একা বসে থাকে মেয়েটি। বিমর্ষ হয়ে থাকে। একা একা কী তার ভালো লাগে? তুমি তার সাথে একটু কথা বললে, কী এমন ক্ষতি হবে?

আবেদ তখন মেয়েটির সাথে অল্পস্বল্প কথা বলা শুরু করল। বলত গির্জার ওপর থেকে, হালকা কথাবার্তা। কিছুদিন পর শয়তান আবার এলো আবেদের কাছে। বলল : -এর চেয়ে ভালো হয়, যদি তুমি নিচে নেমে গির্জার দরজায় বসে কথা বলো। আর মেয়েটি তার কক্ষের দরজায় বসে তোমার কথা শুনে। এতে মেয়েটির একাকিত্বের গ্লানি লাঘব হবে। আবেদও তা-ই করতে লাগল; এভাবে মেয়েটিকে নির্জনতার অভিশাপ থেকে মুক্তি দেয়ার চেষ্টা করতে লাগল।

কিছুদিন পর আবার শয়তান এলো আবেদের কাছে। বলল : -অসহায় মেয়েটিকে শান্তি দিয়ে তুমি বেশ ছওয়াব কুড়িয়ে নিচ্ছ! তবে তুমি যদি মেয়েটির ঘরের দরজায় বসে কথা বলতে, আর সে ঘরের ভেতরে থেকেই তোমার কথা শুনত; তাহলে আরো ভালো হতো, আরো চমৎকার হতো।

আবেদ এবারও তা-ই করল। কিছুদিন পর শয়তান আবেদের কাছে আবার এলো। এবং বুঝালো-যদি তুমি তার রুমে গিয়ে কথা বল, আর সে রুমে পর্দার আড়ালে থেকে তোমার কথা শুনে, তাতে মন্দ কি?

এবার আবেদ মেয়েটির রুমে যেতে শুরু করল। সারাদিন গল্প-গুজব করে রাতে গির্জায় ফিরে যেত। এক সময় মেয়েটিকে সামান্য চুমু দিত। গায়ে হাত বুলাতো। সব শেষে তাকে পুরোপুরি ভোগ করতে লাগল। এক পর্যায়ে মেয়েটি গর্ভবতী হয়ে গেল। একটি পুত্র প্রসব করল।
এবার ইবলিস এসে বলল:

-মেয়েটির ভাইয়েরা যদি এসে দেখে, তার বোন পুত্র প্রসব করেছে তাহলে তুমি কি জবাব দিবে? তারা তোমাকে অপদস্থ করবে, লাঞ্ছিত করবে। তুমি এক কাজ কর, বাচ্চাটিকে হত্যা করে মাটিচাপা দাও। তখন মেয়েটি ভাইদের কাছে অপমানিত হওয়ার ভয়ে বিষয়টি চেপে যাবে।
আবেদ বাচ্চাটিকে খুন করে দাফন করে দিলো।

ইবলিস এবার কুমন্ত্রণা দিয়ে বলল: -তোমার কি মনে হয়, এই মেয়ে ব্যাপারটি নিয়ে চুপ থাকবে। তার সঙ্গে তোমার কান্ড এবং তার বাচ্চাকে হত্যা করা সবই সে তার ভাইদের কাছে ফাঁস করে দিবে। তবে হ্যাঁ, এক কাজ করলে তুমি নিশ্চিন্ত হতে পার। তাকেও হত্যা করে মাটিতে পুঁতে ফেলো।

সাধক মেয়েটিকেও হত্যা করে দাফন করে ফেলল। তারপর গির্জায় ফিরে গেল। বেশ কিছুদিন পর মেয়েটির ভাইয়েরা যুদ্ধ থেকে ফিরে এলো। আবেদের কাছে এসে তাদের বোন সম্পর্কে জানতে চাইল। আবেদ কাঁদতে কাঁদতে বলল: -মেয়েটি মারা গেছে। খুব ভালো মেয়ে ছিল সে। এই দেখ তার কবর।

ভাইয়েরা কাঁদতে কাঁদতে বোনের কবর যিয়ারত করল। বোনের মৃত্যুতে শোকাভিভূত হলো। রাত হলে সবাই ঘুমিয়ে পড়ল। শয়তান স্বপ্নে মুসাফিরের ছদ্মবেশে এসে বড় ভাইকে জিজ্ঞেস করল -তোমার বোন কোথায়?

সে দুঃখ ভারাক্রান্ত স্বরে বলল : -সে তো মারা গেছে। আবেদের গির্জার পাশে তার কবর। ছদ্মবেশী মুসাফির বলল : -মিথ্যে কথা। সাধক বেটা তার সঙ্গে কু-কর্ম করেছে। তার বাচ্চা হয়েছিল। কথা ফাঁস হয়ে যাবে বলে তাদের হত্যা করে ফেলেছে। কবর খুঁড়ে দেখো দু’জনের কঙ্কাল পাবে।

তারপর মেঝ ভাইকেও একই কথা বলল। সবশেষে ছোটজনকে বলল। সকালে ঘুম থেকে জেগে ভাইয়েরা একে অন্যকে আশ্চর্য স্বপ্নের বিবরণ দিলো। বড় জন বলল : -এ এক আজগুবি কিসসা। এসব কথা বাদ দাও। ছোটজন বলল -না। আমি বিষয়টি খতিয়ে দেখব।

তারা শয়তানের বর্ণনানুসারে ঘরে গেল। কবর খুঁড়ে বোন ও বাচ্চার কঙ্কাল পেল। এ সম্পর্কে তারা আবেদকে জিজ্ঞাসাবাদ করল। সে অপরাধ স্বীকার করল। ভাইয়েরা প্রশাসনের কাছে বিচার দিলো। আবেদকে গির্জা থেকে নামিয়ে আনা হলো। ফাঁসির কাষ্ঠে বাঁধা হলো। এমন সময় শয়তান এসে বলল :

-আমিই তোমাকে মেয়েটির সাথে অপকর্ম করার প্রতি প্ররোচিত করেছি এবং তাকে ও তার বাচ্চাকে হত্যা করার কুমন্ত্রণা দিয়েছি। আজ যদি তুমি আমার অনুগত হও এবং আল্লাহকে অস্বীকার কর, তাহলে তোমাকে এ শাস্তি থেকে মুক্তি দিব।

আবেদ তখন আবার শয়তানের চক্রান্তে পা দিলো, আল্লাহর সঙ্গে কুফরী করল। শয়তানের উদ্দেশ্য পূর্ণ হলো। তখন সে চলে গেল। আর ইতোমধ্যে আবেদের ফাঁসিও সম্পন্ন হয়ে গেল।

এ ব্যাপারে কুরআনে কারীম বলে-
﴿كَمَثَلِ الشَّيْطَانِ إِذْ قَالَ لِلْإِنْسَانِ اكْفُرْ فَلَمَّا كَفَرَ قَالَ إِنِّي بَرِيءٌ مِنْكَ إِنِّي أَخَافُ اللهَ رَبَّ الْعَالَمِينَ فَكَانَ عَاقِبَتَهُمَا أَنَّهُمَا فِي النَّارِ خَالِدَيْنِ فِيهَا وَذَلِكَ جَزَاءُ الظَّالِمِينَ﴾
তাদের তুলনা হলো শয়তান। সে মানুষকে বলে, কাফের হয়ে যা। তারপর যখন সে কাফের হয়ে যায়, তখন বলে, তোর সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। আমি তো আল্লাহকে ভয় করি, যিনি বিশ্ব জগতের প্রতিপালক।

সুতরাং তাদের উভয়ের পরিণতি হবে স্থায়ীরূপে জাহান্নাম। এটাই অনাচারীদের পরিণতি। [সূরা হাশর: ১৬ ও ১৭]

লেখক: বৃটেনের বাংলাদেশী ইসলামী স্কলার ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ