ডাক্তার আজিজাহ্ আনজুম
অনুবাদ: বেলায়েত হুসাইন
নিষ্পাপ চেহারার তিন বছর বয়সী শিশু মারইয়াম। একটি বড় ওড়না কাঁধের ওপর ঝুলিয়ে ছোট ছোট পায়ে বাড়ির চারদিকে ছুটোছুটি করছে। শত চেষ্টা করেও ঘাড়ের ওপর কিছুতেই ওড়নাটি স্থির রাখতে পারছে না, ওঠায় আবার পড়ে যায়। বাড়ির লোকজন মুগ্ধ দৃষ্টিতে ছোট্ট পুতুলটির এই অভিনয় উপভোগ করছিল।
আমরা সবাই জানি, বড়দের দেখেই মারইয়ামের মতো শিশুরা শিক্ষা গ্রহণ করে, বিশেষকরে আমরা লক্ষ্য করবো, আমাদের ঘরের মেয়ে শিশুরা শৈশব থেকেই বড়দের ওড়না মাথায় জড়িয়ে খেলাধুলা করে বেড়ায়। যখন খেলাধুলার সময় হয় তখন ঝট করে আলমারি খুলে মায়ের সুন্দর রঙের ওড়নাটি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে বান্ধবীদের সঙ্গে খেলতে- এদিকে যে, আলমারির অন্যান্য কাপড়গুলো নিচে ফেলে রেখে গেছে- সেদিকে তার কোন ভ্রুক্ষেপই নেই। মায়ের ওড়নাটি নিজের মতো করে মাথায় জড়িয়ে ছোট্ট পরীটি আনমনে খেলতে থাকে।
এটি এজন্য হয় যে, কেননা, পর্দা মানব প্রকৃতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং তা লজ্জা ও সৌন্দেয্রের অনুভূতির প্রতীক। নিজেদের মাথা ও মুখমন্ডল ঢেকে রাখাকে নারীরা তাদের ভূষণ মনে করে।
হজরত আদম (আ.) ও বিবি হাওয়া জান্নাতে নিষিদ্ধ ফলের স্বাদ আস্বাদন করার ঘটনার পরে নিজেদের লজ্জা আবরণের অনুভূতি টের পান এবং এই পরিস্থিতিতে লজ্জা ঢাকতে তারা জান্নাতের পত্রবৃক্ষ ব্যবহার করেন। এই স্বভাবজাত লজ্জানুভূতিই আমাদের আদি পিতা-মাতাকে নিজেদের ইজ্জত ও আবরু ঢেকে রাখার তাকিদ দেয় এবং প্রাকৃতিক ভাবেই তারা পর্দাপালন শুরু করেন।
মহান আল্লাহ তায়ালা শরয়ী পোশাককে আপন নিদর্শন আখ্যায়িত করেছেন। পোশাকের উদ্দেশ্য যেমনিভাবে মানুষের দেহ আবরণের মাধ্যমে সৌন্দর্য প্রকাশ, ঠিক তেমনিভাবে এর দ্বারা দেহকে শীতের প্রকোপ থেকে এবং গরমের প্রচন্ডতা থেকে রক্ষা করাও অন্যতম লক্ষ্য। সুতরাং যে এসব দিক বিবেচনা করে পোশাক তৈরি করবে, তার পোশাকই হবে আদর্শ পোশাক।
ওড়না ও চাদর মেয়েদের পোশাকে আবশ্যকীয় অংশ। চাদর ও ওড়না তাকে মুসলিমার পরিচয় দান করে। মুসলিম মহিলারা পর্দা করাকে নিজেদের জন্য গর্বের বিষয় মনে করে। আক্ষরিক অর্থে চাদর বা ওড়না ইসলামি শরিয়তের পর্দাপালনের সহায়ক একটি বস্ত্র, যা দিয়ে মুসলিম নারীরা মাথা- মুখ ঢেকে ঘর থেকে বাইরে বের হয়। ঘরের বাইরে যেতে হলে তার জন্য অবশ্যই দেহের নির্দিষ্ট অংশ আবৃত করা ফরজ। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, হে নবী! আপনি আপনার স্ত্রীগণকে, কন্যাগণকে এবং মুমিনদের স্ত্রীগণকে বলে দিন, তারা যেন তাদের চাদরের কিছু অংশ নিজেদের ওপর টেনে দেয়, এতে তাদেরকে চেনা সহজ হবে। ফলে তাদেরকে উত্যক্ত করা হবে না। আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। ( সুরা আহজাব, আয়াত: ৫৯)
নি:সন্দেহে পর্দা নারীদের জন্য পরপুরুষের নজর থেকে সুরক্ষার সহজ একটি উপায়। এটি মানব সভ্যতাকে প্রত্যহিক জীবনের বড় বড় অনিষ্ট থেকে বাঁচতে সাহায্য করে। তবে এটিও ঠিক যে, এজন্য সমাজ অনুকূল হতে হবে, তাহলে মানবপ্রকৃতি নিজের কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবে এবং এর মাধ্যমে নারী আত্মিক ও সামাজিক প্রশান্তি ও সৌন্দর্য অনুভব করতে পারবে।
প্রতিটি শিশুই জন্মগতভাবে নিষ্পাপ ও কোমল হৃদয়ের হয়ে থাকে। তাদেরকে তুলনা করা হয় সদ্যফোঁটা ফুলকলির সঙ্গে। পরিণত জীবনের সঙ্গে তাদের এই স্বভাব কোমলতা ও নিষ্পাপ-ভাব টিকিয়ে রাখতে শালীন পোশাক ও পর্দার গুরুত্ব অপরীসিম। ছোট্ট শিশুদের মনে লজ্জা শালীনতা ও পর্দার অনুভূতি জাগ্রত করা এবং তাদেরকে নারীত্বের তালিম দেয়া প্রত্যেক মায়ের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। এজন্য শৈশব থেকেই মায়েরা শিশুদের এই শিক্ষা দিবে যে- একটি সতেজ ফুটন্ত ফুল যেমন অনল প্রবাহে ঝলসে যায়, একটি স্বচ্ছ কাচপাত্রে যেভাবে ধূলিকণার আস্তর পড়ে তা অস্পষ্ট হয়ে যায়, ঠিক তেমনিভাবে বে-পর্দা ও নগ্নতা নারীর সৌন্দর্যকে বিনষ্ট করে। তা ছাড়া অতি মূল্যবান কোন মুক্তা যেমনকরে সুরক্ষার তাকিদে লুকিয়ে রাখা হয়, ঠিক এভাবেই হিজাব ও পর্দা নারীকে পুরুষের কুদৃষ্টি থেকে সুরক্ষা দান করে। সুতরাং বয়:সন্ধিকালে আপনার কন্যা শিশুকে বয়সের প্রয়োজনীয়তা শিক্ষা দিন এবং বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়গুলো তাকে বোঝান যে, এখন তার কি করণীয়? পর্দা পরিপালনের সঙ্গে তাকে উন্নত জীবনে আরোহণের পথ দেখিয়ে দিন।
মেয়ে পরিণত বয়সে উপনীত হলে একজন সচেতন মা কি করবেন? তখন তার করণীয় হবে, নিজেও আগের তুলনায় পর্দার প্রতি বেশি যত্নশীল হবেন, মেয়ে বড় হলে তাকে শুধু ওড়না ও স্কার্ফ কিনে দিয়েই তিনি বসে থাকবেন না; বরং এগুলো পরিধানের পদ্ধতিও তাকে শিক্ষা দিবেন। বাসা-বাড়িতে খেলাধূলার সময়ও মেয়েকে শালীন ও পর্দা-সহায়ক পোশাক পরিধানের ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করা প্রতিটি মায়ের কর্তব্য। কেননা, পর্দা মানুষের স্বভাব-প্রকৃতির অংশ আর প্রকৃতি যদি তার আপন স্বভাবের ওপর বহাল থাকে, তাহলে তো ঠিক আছে, নইলে প্রকৃতিও পথ হারাতে পারে।
সানডে ম্যাগাজিন, ডেইলি জং অবলম্বনে
-এটি