হাফেজ ফজলুল হক শাহ
বিজ্ঞানের প্রধান শাখার নাম রসায়ন। এর ইংরেজী প্রতিশব্দ কেমিষ্ট্রী (ঈযবসরংঃৎু)। এ শব্দটি আরবী ‘আল-কিমিয়া’ শব্দ থেকে নির্গত। আর আরবী ‘আল-কিমিয়া’ শব্দটি মিশরীয় ‘কামিত’ শব্দ থেকে এসেছে। কারো মতে এটি গ্রীক ঈযঁসবরধ, ঈযবসবরধ শব্দ থেকে নিষ্পন্ন, যার অর্থ গলিত ধাতু। বিজ্ঞানের ইতিহাসে ‘আল-কিমিয়া’ জ্ঞানের দর্শন ভিত্তিক এমন এক শাখাকে বলে, যা জ্ঞানের সকল শাখার সকল উপাদানের সম্মিলনে একটি উচ্চতর শক্তির অস্তিত্তকে বুঝায়। রসায়ন, পদার্থ বিজ্ঞান, চিকিৎসাশাস্ত্র, জ্যোতির্বিজ্ঞান প্রভৃতি সকল উপদান যে একক উচ্চতর শক্তির অংশ হিসেবে বিদ্যমান রয়েছে, সেই বিজ্ঞানের নাম ‘আল-কিমিয়া’। সপ্তম শতাব্দী থেকে ‘আল-কিমিয়া’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে। রসায়নকে আরবীতে ‘আল-কিমিয়া’ ছাড়াও ‘আল-হিকমা আস্ সানাআহ্’ নামেও ডাকা হতো।
পদার্থের গঠন, পদার্থের পারস্পারিক ক্রিয়ায় নতুন পদার্থের সৃষ্টি এবং পদার্থের ক্রিয়া-বিক্রিয়া সম্বন্ধে যে শাখায় আলোচিত হয়, রসায়নবিদগণ সে শাখাকে কেমিষ্ট্রী নামে অবিহিত করেছেন। বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখায় রসায়নের অপার অবদান রয়েছে।
রসায়নের শিকড়ে পৌঁছুতে হলে দহনের ইতিহাস খুঁজতে হবে। আগুন আবিষ্কারের পর রসায়নের সূচনা হয়। আগুন এমন এক শক্তি, যা এক বস্তুকে অন্য বস্তুতে রুপান্তরের ক্ষমতা রাখে। মানব সভ্যতার প্রাথমিক পর্যায়ে আগুনকে নিয়ে মানুষের আগ্রহের অন্ত ছিল না। আগুন থেকে তারা লোহা আবিষ্কার করে। শুরু হয় লৌহ যুগ। তারপর কাঁচ আবিষ্কার হয়, তারপর সোনা। সোনা সবচেয়ে মূল্যবান ধাতুর মর্যাদা লাভ করলে অনেকেই ধাতুকে সোনায় পরিনত করার চেষ্টা চালায়। ফলে বিজ্ঞানের একটি শাখার উদ্ভব ঘটে, যাকে রসায়ন বলা হয়। সে সময় রসায়নের লক্ষ্য ছিল যে কোন সাধারন ধাতুকে স্বর্ণে বা রৌপ্যে রুপান্তরিত করা। তাদের আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল এমন একটি ঔষধ আবিষ্কার করা যা সকল রোগের নিরাময় হতে পারে।
খৃষ্টপূর্ব ৩৫০০ বছর পূর্বে মেসোপটেমিয়ায় দজলা ও ফোরাত নদীর মধ্যবর্তী অ লে এক উন্নত সভ্যতা গড়ে উঠে। পৃথিবীর প্রাচীন সভ্যতাগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। তারা রসায়নিক বস্তুগুলো নিয়ে প্রথম চিন্তা-ভাবনা ও প্রাথমিক পর্যায়ের কাজ শুরু করে। সে সময় ধাতুর ব্যবহারে মেসোপটেপিমীয়রা বেশ উন্নতি সাধন করেছিল। খৃষ্টপূর্ব ২৫০০ অব্দে সর্ব প্রথম তারা ব্রোঞ্জের ব্যবহার শুরু করে।
প্রাচীন মিশরে নিয়মতান্ত্রিক রসায়ন চর্চা শুরু হয়। নীল নদের মোহনায় মেমফিসের বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্যোতির্বিদ্যা পড়ানো হতো। তখনো মিশরের লোকেরা পিড়ামিড নির্মানের কলা-কৌশল রপ্ত করতে পারেনি। এরপর তারা পদার্থবিদ্যা শিখে মমি তৈরী করার ক্ষেত্রে কাঠের টুকরো জোড়া দেবার জন্য গাদ ও সিমেন্ট বানানোর চেষ্টা করল। বিভিন্ন বৃক্ষের আটা, গম, যব ইত্যাদি দিয়ে তারা কাগজ তৈরী করল। এসব কাজে তারা আগুনকে ব্যবহার করত। এভাবে মিশরে রসায়ন চর্চার যাত্রা শুরু হয়।
প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর আগে মিশরীয়রা স্বচ্ছ কাঁচ তৈরী করে। এরপর চিন্তার জগত আরো প্রসারিত হলে তারা রঙ্গিন কাঁচ তৈরী করতে সক্ষম হয়। পরবর্তীতে রোমানরা কাঁচ দিয়ে নকল মণি-মুক্তো তৈরীর চেষ্টা চালায়। তারা নকল সোনা এবং অন্য জিনিসকে কিভাবে সোনা বানিয়ে মানুষের চোখে ধূলো দেয়া যায়, তা নিয়ে বিস্তর গবেষণা চালায়। এক পর্যায়ে আরবে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে এবং আরবরাও রসায়ন এবং রসায়নের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা নিয়ে চিন্তা ভাবনায় জড়িয়ে পড়ে।
ইসলামের আগমনের পূর্বে রসায়ন বিজ্ঞান হিসেবে পরিচিত ছিল না, উপায় উপকরণের মাধ্যম হিসেবে রসায়ন চর্চা করা হতো। রসায়নকে সর্বপ্রথম বিজ্ঞান হিসেবে মুসলমানরাই প্রতিষ্ঠিত করেন। হাম বোল্ট বলেন, “আধুনিক রসায়নশাস্ত্র মুসলমানদের আবিষ্কার, এ বিষয়ে তাদের কৃতিত্ব অতুলনীয় ও চিত্তাকর্ষক।” ঐতিহাসিক রেজাউল করিম বলেন, “জ্যোতির্বিদ্যা, অঙ্কশাস্ত্র এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানের পর আরবদের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান রসায়নে। গ্রীকদের মত অস্পষ্ট অনুমান ও কল্পনার উপর নির্ভর না করে আরবরাই সর্ব প্রথম নিরীক্ষণ পদ্ধতি (বীঢ়বৎরসবহঃ) প্রবর্তন করেন। সূ² পর্যবেক্ষণ (ড়নংবৎাধঃরড়হ) এবং সত্য উদঘাটনের প্রবল স্পৃহা আরবদেরকে বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্তে পৌছাতে সাহায্য করেছে।”
মুসলমানদের রসায়ন চর্চার মূল উপজীব্য গ্রন্থ হল আল-কুরআন। কারন পবিত্র কুরআন শরীফ সর্বাধুনিক বিজ্ঞানময় ধর্মীয় মহাগ্রন্থ। ফ্রান্সের বিখ্যাত চিকিৎসক ড. মুরিস বুকাইলি ঞযব ইরনষব ঃযব ছঁৎধহ ধহফ ঝপরবহপব গ্রন্থে লিখেছেন, “আল-কুরআনে প্রচুর বৈজ্ঞানীক তথ্য ও উক্তি রয়েছে। এসব বাণী অবতীর্ণ ও সংকলিত হয়েছে তের শ বছর আগে। আল-কুরআনের বিভিন্নমুখী বৈজ্ঞানীক তথ্যাবলি আধুনিক বিজ্ঞানের সাথে কিভাবে এত সমঞ্জস্যশীল হল তা বিস্ময়ের ব্যাপার।”
রসায়ন বিষয়ে কুরআনে প্রচুর আয়াত রয়েছে। গ অশনধৎ অষর তার ঝপরবহপব রহ ঃযব ছঁৎধহ গ্রন্থে ঈযবসরংঃৎু অধ্যায়ে আল-কুরআনের রসায়ন ভিত্তিক আয়তগুলো নিয়ে বিস্তর আলোচনা করেছেন। তিনি এগুলোকে চার ভাগে ভাগ করেছেন। এক, সাধারন রাসায়নিক দ্রব্য সম্পর্কীত আয়াত। দুই, দুধ ও মধু উৎপাদন সম্পর্কীত আয়াত। তিন, বৃষ্টি দ্বারা উদ্ভিদ ও সব্জি উৎপাদন সম্পর্কীত আয়াত। চার, বাতাস থেকে উৎপন্ন খাদ্য বিষয়ক আয়াত।
ইসলামের গোড়ার দিকেই রসায়ন নিয়ে আলোচনা হয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) ঔষধ নিয়ে নানাবিধ বক্তব্য রেখেছেন। হাদীসের কিতাবগুলোতে ‘তিববুন নবী’ শীর্ষক অধ্যায়ে চিকিৎসা ও ঔষধ বিষয়ক তাঁর বাণীগুলো সংকলিত রয়েছে। ঔষধকে যদি রাসায়নের পর্যায়ে অন্তর্ভূক্ত করা হয়, তবে ইসলামের ইতিহাসে রাসূলুল্লাহ (সা.) প্রথম রাসায়নিক। এরপর ‘দারুল হিকমা’ তথা ‘জ্ঞানের দরজা’ উপাধি প্রাপ্ত চতুর্থ খলীফা হযরত আলী বিন আবী তালিব রসায়ন বিষয়ক প্রভূত জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। তিনি বলেন, “পারদ ও অভ্র একত্র করে যদি বিদ্যুতের মত কোন বস্তুর সাথে মিশিয়ে দিতে পারো, তাহলে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের অধিশ্বর হতে পারবে।”
নিকৃষ্ট ধাতু থেকে সোনা তৈরীর এই ফরমুলার পরিকল্পকারী হিসেবে হযরত আলীকে রসায়ন বিজ্ঞানের জনক বলা যেতে পারে। হযরত আলীর রাসায়নিক পরিকল্পনা ও ফর্মূলাকে চিন্তাগতভাবে লালন করেছেন বিখ্যাত সাহাবী হযরত আমীর মুয়াবিআ বিন আবী সুফিয়ানের পৌত্র খালিদ বিন ইয়াযিদ। রসায়নের ইতিহাসে তিনি ঐতিহাসিক চরিত্র। উমাইয়া বংশের এ যুবরাজ গ্রীক ভাষায় রচিত বিজ্ঞানের অনেক বই সর্ব প্রথম আরবীতে অনুবাদ করেন। তিনি মিশরে গিয়ে রসায়ন চর্চা করেন। আল-রাজী, আবুল কাসেম প্রমূখ খ্যাতিমান রসায়নবিদগন তাদের মূল্যবান রচনায় রসায়ন সম্পর্কে খালিদের মতামত নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি ৭০৪ খৃষ্টাব্দে ইন্তেকাল করেন।
হারবী আর হুমায়রী এবং জাফর আস-সাদিক উভয়ে আধুনিক রসায়নের জনক জাবের বিন হাইয়ানের শিক্ষক। তারা মিশরের রসায়ন সম্পর্কে প্রচুর জ্ঞান রাখতেন। ইবনে হাইয়ান তাদের রসায়নিক থিওরীগুলো নিয়ে তার গ্রন্থে বিস্তর আলোচনা করেছেন। হারবী আল-হুমায়রী সপ্তম শতকের মাঝামাঝি সময়ে ইয়ামনে জন্ম গ্রহন করেন। আর জাফর আস-সাদিক খুব সম্ভবত ৭০২ খৃষ্টাব্দে মদীনায় জন্ম গ্রহন করেন।
জাবের বিন হাইয়ান আধুনিক রসায়নের প্রবর্তক। তার আগে রসায়ন পূর্ণাঙ্গ বিজ্ঞান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিল না। তিনি কঠোর পরিশ্রম, ব্যাপক অনুসন্ধান, বিস্তর গবেষনা এবং দীর্ঘ অধ্যাবসায়ের মধ্য দিয়ে রসায়নের শাখা-প্রশাখাগুলোকে বিণ্যস্ত করেন। তিনি রসায়ন শাস্ত্রের সকল প্রক্রিয়াগুলোর সাথে বিশেষভাবে পরিচিত ছিলেন। পূর্বের প্রক্রিয়াগুলোকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে সংস্কার ও পরিমার্জন করে নিজের আবি®কৃত প্রক্রিয়াগুলোকে সুসংগঠিত ও শৃংখলতি করে তোলেন। একটি বস্তুর প্রাণ থেকে কিভাবে ক্লেদ বের করা যায়, কি করে বস্তুটির দেহ শুদ্ধ করা যাবে, কেমন করে পরিশুদ্ধ দেহকে তরল করা হয় এবং পরিশেষে পরিশুদ্ধ তরল দেহের সাথে কিভাবে প্রাণকে মিলিয়ে দেয়া যাবে, তা তিনি বিশদ ভাবে তার রসায়ন বিষয়ক গ্রন্থগুলোতে আলোচনা করেছেন।
জাবের বিন হাইয়ান বিন আব্দুল্লাহ আল-আযাদী ৭২১ খৃষ্টাব্দে ক‚ফায় জন্ম গ্রহন করেন। তার উপনাম আবু মূসা এবং উপাধি আবুল কিমিয়া বা রাসায়নের পিতা। তিনি জাফর আস-সাদিকের নিকট শরীয়তের বিধানাবলি, ভাষা-সাহিত্য এবং রসায়ন বিদ্যা অর্জন করেন। আব্বাসীয় খলীফা হারুনুর রশিদের (৭৮৬-৮০৯খৃ:) শাসনামলে তার রসায়ন চর্চার খ্যাতি দুনিয়াময় ছড়িয়ে পড়ে। সে সময় ক‚ফায় তার একটি রসায়ন গবেষনাগার ছিল বলে ঐতিহাসি পি কে হিট্টি উল্লেখ করেছেন। তিনি জীবনের শেষ বয়সে এসে খলীফা হারুনুর রশিদের মন্ত্রী জাফর বিন ইয়াহয়া বরমক্কী (৭৬৭-৮০৩খৃ:)-এর ব্যক্তিগত চিকিৎসক নিযুক্ত হন। ইরানের রায় শহরের অধিবাসী প্রখ্যাত চিকিৎসা বিজ্ঞানী আবু বকর রাজী (৮৬৫-৯২৩খৃ:) স্বরচিত ‘সিররুল আসরার’ গ্রন্থে লিখেছেন, “অধুনিক রসায়নের প্রথম ব্যক্তি জাবের বিন হাইয়ান আরবের জ্ঞানের জগৎকে সুভাশিত করেছেন।” ইংল্যান্ডের প্রতিথযশা দার্শনিক ফ্রান্সেস বেকোন বলেন, “জাবের বিন হাইয়ান রসায়নের জগতে পন্ডিত ব্যক্তি, তাকে রসায়নের জনক বলা হয়।”
ফ্রান্সের রাসায়নিক এবং রাজনীতিবিদ মারসিলান বিরতুলুন (গবৎপবষষরহ ইবৎঃযবষড়হ) (১৮৮৩-১৯০০খৃ:) বলেন, “জাবের বিন হাইয়ান রসায়নশাস্ত্রে অনুরুপ ব্যক্তিত্ব, দর্শনশাস্ত্রে এ্যরিস্টটোল যেমন।” আল্লামা যারকালী ‘আল-আলাম’ গ্রন্থে তার বিশালায়তনের ৫০০টি গ্রন্থের কথা উল্লেখ করেছেন। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ইবনে নাদিম (মৃ:১০৪৭খৃ:) তার বিখ্যাত ‘ফিহরাসত’ গ্রন্থে ইবনে হাইয়ানের রচনা সম্ভারের বিবরণ লিপিবদ্ধ করতে গিয়ে বলেন, “তার রচিত ছোট বড় কিতাবের সংখ্যা দুই হাজারের অধিক।” ইমাম ইবনে তাইমিয়া বলেন, “রসায়নবিদদের নিকট জাবের বিন হাইয়ানের রচনা সম্ভার অধিক প্রসিদ্ধ। তার গ্রন্থের সংখ্যা এতই বিপুল, পন্ডিত ব্যক্তিদের নিকটও যার বিরাট একটি অংশ অজ্ঞাত রয়ে গেছে।”
তার বর্ণাঢ্য রচনা সম্ভারের মধ্যে রসায়ন বিষয়ক শ্রেষ্ঠ কিতাবের নাম ‘আসরারুল কিমিয়া’, ‘উসূলুল কিমিয়া’, ‘আর-রাহমাহ’ ইত্যাদি। তার গ্রন্থগুলো বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত হয়েছে। ইউরোপীয় ভাষায় তার গ্রন্থগুলো অনুবাদ করার সময় পাশ্চাত্যের লেখকরা তার নাম জেবার (এবনবৎ) হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি একাধারে দার্শনিক, রসায়নশাস্ত্রবিদ, চিকিৎসা বিজ্ঞানী, জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং মহাকাশ বিজ্ঞানী। বরেণ্য আওলিয়া যুননুন মিসরী ছিলেন জাবের বিন হাইয়ানের ছাত্র। বিশিষ্ট মুসলিম দার্শনিক আল-কিন্দী আল-ক‚ফী ইবনে হাইয়ানের জ্ঞানে প্রভাবিদ হয়েছেন। ৮১৩ খৃষ্টাব্দে জাবের বিন হাইয়ান ক‚ফায় ইন্তেকাল করেন।
জাবের বিন হাইয়ানের পর মুসলিম রসায়নবিদ হিসেবে আবির্ভূত হন আবু বকর মুহাম্মাদ বিন ইয়াহয়া বিন যাকারিয়া আল-রাযী। ৮৬৫ খৃষ্টাব্দে তিনি রায় শহরে জন্ম গ্রহন করেন। চিকিৎসাশাস্ত্রের পাশাপাশি রসায়ন এবং পদার্থ বিদ্যায় তার অবদান অপার ও অসীম। তিনি সর্বপ্রথম ‘সালফিউরিক এসিড’ আবিষ্কার করেন। হাউড্রোজেন এবং সালফেটের রাসায়নিক বিক্রিয়ায় সালফিউরিক এসিড তৈরী হয়। সার উৎপাদনে এটি একটি মূল্যবান উপাদান। এছাড়াও রং, ঔষধ, কিটনাশক, পেইন্ট, কাগজ, বিস্ফোরক প্রভৃতি তৈরীতে প্রচুর পরিমানে সালফিউরিক এসিড প্রয়োজন হয়। আল-বেরুনী আবু বকর আল-রাযীর ১২টি রসায়ন বিষয়ক বইয়ের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি ৯৩২ খুষ্টাব্দে ইন্তেকাল করেন।
এছাড়াও মুসলিম সোনালী দিনগুলোতে আরো অসংখ্য মুসলিম রসায়নবিদগণ নিজেদের গবেষনা দিয়ে রসায়নের জ্ঞানের জগতকে সমৃদ্ধশীল করেছেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েক জন হলেন, আব্বাস বিন ফিরনাস (৮১০-৮৮৭খৃ:)। তিনি আবিষ্কারক, প্রকৌশলী এবং উড্ডয়ন বিশারদ ছিলেন। আবু বকর আহমদ বিন আলী বিন কায়েস আন-নাবতী (মৃ:৯৩০খৃ:)। তিনি ইবনে ওয়াহশিয়া নামে অধিক পরিচিত। ইরাকে জন্ম গ্রহনকারী এই মুসলমি রসায়নবিদের রসায়ন বিষয়ক শ্রেষ্ঠ রচনা ‘উসূলুল কাবির’। মুহাম্মাদ বিন ইমায়েল আল-তাতিমী (৯০০-৯৬০খৃ:), আল-মাজরেতি (৯৫০-১০০৭খৃ:), আবুল মানসুর মুয়াফফাক হারবী, ইবনে আব্দুল মালেক আল-কাছী, ইবনে জাহিয, ইবনে রাসসাম প্রমূখ।
চতুর্দশ শতাব্দী পর্যন্ত রসায়নে মুসলমানদের নব নব আবিষ্কার যখন পৃথিবীকে আলোকিত করেছিল তখন আজকের ইউরোপ অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল। প দশ শতাব্দীতে মুসলমানদের ক্ষয়িষ্ণ যুগের সূচনা হলে ইউরোপীয়ানরা মুসলমানদের রেখে যাওয়া জ্ঞান-বিজ্ঞান নিয়ে মেতে উঠে। মুসলমানদের বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ক গ্রন্থাবলী শত শত বছর ধরে ইউরোপে গুরুত্বপূর্ণ পাঠ্য হিসেবে পরিগনিত। ইবনে সিনার চিকিৎসা বিজ্ঞান বিষয়ক কালজয়ী ‘আল-কানুন’ গ্রন্থটি ইউরোপের শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছয় শত বছর ধরে পড়ানো হয়। অতএব মুসলমানরা কোন কালেই জ্ঞান-বিজ্ঞানে দরিদ্র ছিল না। বরং জ্ঞান-বিজ্ঞানের জগতে দুস্থতার চাদর মুড়ি দিয়ে ইউরোপীয়ানরা যখন অসহায়ত্বের দুয়ারে পড়ে ছিল, তখন মুসলমানরা জ্ঞান-বিজ্ঞানের আকাশে উজ্জল জতিষ্ক হয়ে উদ্ভাসিত হয়েছিল।
আজকের ইউরোপ যে বিজ্ঞান নিয়ে গৌরব করে তা নি:সন্দেহে মুসলিম মনীষীদের উদার জ্ঞানের অপার দান। আগে মানুষ জানত মানুষের মুখের কথা বাতাসে হারিয়ে যায়। কিন্তু কুরআনের কারনে পাশ্চাত্য জানল কথামালা বিসৃত হয় না। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন, “তোমাদের প্রতিপালকের আদেশে একদিন সব কিছুই প্রকাশিত হয়ে পড়বে।” (সূরা যিলযাল,৪-৫)। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, “তোমরা দু‘টি জিনিসের ব্যাপারে সতর্ক থাক। একটি তোমাদের স্ত্রীরা, অন্যটি এই পৃথিবী, যার উপর তোমরা আস্ফালন করে চলছ।” (সহীহ মুসলিম)।
কুরআন ও হাদীসের এ দু‘টি তথ্য বাতাসে মানুষের কথা রেকর্ড হয়ে থাকার প্রতি ইংগিত দেয়। সুতরাং এ দু‘টি বাণী বেতার আবিষ্কারের সাধনাকে উজ্জীবিত করেছে। অতএব যারা বলে জ্ঞান-বিজ্ঞানে মুসলমানদের কোন অবদান নেই, তারা হয় অন্ধ নয় তো অজ্ঞ।
লেখক: মুহতামিম, মাদরাসা দারুন নাঈম, পোরশা, নওগাঁ।
-এটি