শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


কিংবদন্তি আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমীর চিরবিদায়!

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুফতি মোস্তফা ওয়াদুদ কাসেমী।।
লেখক ও মাদরাসা শিক্ষক

পৃথিবীতে কিছু মানুষের জন্ম আজন্ম হয়ে থাকে। কিছু মানুষ চিরদিনের জন্য গেঁথে থাকেন মানুষের হৃদয়ে। মহান রাব্বুল আলামীন তাঁদেরকে মানুষের জন্য নেতা হিসেবে নির্বাচন করেন। সমাজে তাদের নাম বাঁচিয়ে রাখেন চিরদিন। তেমনি একজন মহান মানব হলেন বর্তমান সময়ের বিশিষ্ট আলেমেদ্বীন, বীর সিপাহসালার, হাজার হাজার উলামায়ে কেরামের উস্তাদ, যামানার কিংবদন্তি মহানায়ক, দেওবন্দী চিন্তাদর্শনের প্রবাদপ্রতীম ব্যক্তিত্ব, প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল, শায়খুল হাদীস আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী রহ.।

জন্মসাল:
১৯৪৫ সালের ১০ জানুয়ারি মোতাবেক ১৮ আষাঢ় ১৩৫৩ বঙ্গাব্দ, শুক্রবার বাদ জুমআ কুমিল্লা জেলার মনোহরগঞ্জ থানার চড্ডা নামক গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।

শিক্ষাজীবন:
তিনি ছোটোবেলা থেকেই প্রচুর ডানপিঠে ছিলেন। বাবা-মায়ের কাছেই প্রাথমিক শিক্ষা-দীক্ষা গ্রহণ করেন।
তার বাবা পাড়ার অন্যান্য ছেলেদের সাথে প্রথমে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। বাড়ির পাশেই ছিলো স্কুল। চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত এ স্কুলেই পড়াশুনা করেন।

তারপর তিনি চড্ডার পাশের গ্রামে কাশিপুর মাদরাসায় ভর্তি হোন। এখানে মুতাওয়াসসিতাহ পর্যন্ত পড়েন। এরপর বরুড়ার ঐতিহ্যবাহী মাদরাসা দারুল উলুম এ ভর্তি হোন। সেখানে হেদায়া পর্যন্ত পড়েন।

বাবার ঐকান্তিক ইচ্ছা ও তাঁর অগাধ প্রতিভার ফলে উচ্চ শিক্ষার জন্য তখন বিশ্ববিখ্যাত বিদ্যাপীঠ দারুল উলুম দেওবন্দে পাড়ি জমান। কিন্তু ভর্তির নির্ধারিত সময়ে পৌঁছাতে না পারায় সাহারানপুর জেলার বেড়ীতাজপুর মাদরাসায় ভর্তি হোন। সেখানেই জালালাইন জামাত পড়েন। তারপর দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন ও ইলমী পিপাসাকে নিবারণের জন্য ভর্তি হোন দারুল উলুম দেওবন্দে।

শিক্ষকবৃন্দ:
আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী রহ. তার ছাত্র জীবনে তখনকার সময়ের যুগশ্রেষ্ট উস্তাদদের কাছে দরস নেয়ার সৌভাগ্য লাভ করেছেন। তন্মধ্যে প্রসিদ্ধ কয়েকজন হলেন মাওলানা সায়্যিদ ফখরুদ্দীন মুরাদাবাদী রহ., কারী তাইয়িব সাহেব রহ., ওয়াহিদুজ্জামান কেরানবী রহ., শাইখুল হাদীস মাওলানা যাকারিয়া রহ., মাওলানা মুফতী মাহমুদ হাসান গাঙ্গুহী রহ., মাওনানা শরীফুল হাসান রহ., মাওলানা নাসির খান রহ., মাওলানা আব্দুল আহাদ রহ., মাওলানা আনজার শাহ কাশ্মিরী রহ., মাওলানা নাঈম সাহেব রহ., মাওলানা সালিম কাসেমী রহ. সহ বিশ্ববরেণ্য ওলামায়ে কেরামের কাছে তিনি দরস লাভ করেন।

শিক্ষকতা:
দীর্ঘ ২৭ বছর যাবৎ অর্জিত জ্ঞানকে প্রচারের নিমিত্তে মুজাফফরনগর শহরে অবস্থিত মুরাদিয়া মাদরাসায় অধ্যাপনার কাজ শুরু করেন। এরপর দেশে এসে শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া থানার নন্দনসার মুহিউস সুন্নাহ মাদরাসায় শায়খুল হাদীস ও মুহতামীম পদে যোগদান করেন। ১৯৭৮ সালে ঢাকার ফরিদাবাদ মাদরাসায় শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ হোন। তারপর ১৯৮২ সালে চলে আসেন কাজী মু’তাসিম বিল্লাহ রহ. প্রতিষ্ঠিত জামিয়া শারইয়্যাহ মালিবাগে।

১৯৮৮ সাল থেকে অধ্যাবধি পর্যন্ত অত্যন্ত যোগ্যতা ও মেহনতের সাথে ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা এবং ১৯৯৮ সাল থেকে অধ্যাবধি জামিয়া সুবহানিয়ার শায়খুল হাদীস ও মুহতামিমের দায়িত্ব আঞ্জাম দিচ্ছেন।

আধ্যাত্মিক জীবন: তিনি প্রথমে শায়খ যাকারিয়া রহ. এর কাছে বায়আত হোন। এরপর মুফতি মাহমুদ হাসান গাঙ্গুহী রহ. এর হাতে বায়আত হোন ও খেলাফত লাভ করেন।

রাজনৈতিক জীবন: ১৯৭৫ সাল থেকেই তিনি জমিয়তের একনিষ্ঠ সক্রিয় কর্মী। স্বাধীনতা পরবর্তী দীর্ঘকাল জমিয়তের সাধারণ সম্পাদক মরহুম মাওলানা শামসুদ্দীন কাসেমী রহ. এর নেতৃত্বে সকল আন্দোলনে শরীক থাকতেন। জমিয়তে তিনি মরহুম মাওলানা শামসুদ্দীন কাসেমী রহ. মাধ্যমেই যোগদান করেছিলেন। ১৯৯০ সালে জমিয়তের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে চলে আসেন। বর্তমানে কেন্দ্রীয় জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের গত ৭ নভেম্বর ২০১৫ ইংরেজী, রবিবার জাতীয় কাউন্সিলের মাধ্যমে মহাসচিবের দায়িত্ব পান। এবং নিজস্ব মেধা ও দক্ষতার মাধ্যমে এ দায়িত্ব আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন। বর্তমানের আলোচিত অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ ঢাকা মহানগরীর সম্মানিত সভাপতির দায়িত্বভার তাঁর উপর ন্যস্ত করা হয়। তিনি সূচারুরুপে এ দায়িত্বও পালন করছেন। একই সাথে গত ১৫ নভেম্বর বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ এর মহাসচিবের দায়িত্ব পান তিনি। এরপর গত ৩ অক্টোবর ২০২০ সালে বেফাকের আমেলা বৈঠকে তাঁকে নির্বাচন করা হয় বেফাকের সিনিয়র সহ-সভাপতি।

বুখারী শরীফের দরসদান: আল্লামা নূর হোসাইন কাসমী সাহেব বুখারী শরীফের মাধ্যমেই খেদমাত শুরু করেছিলেন। সর্বপ্রথম শরীয়তপুরের নন্দনসার মুহিউসস সুন্নাহ মাদরাসায় বুখারীর দরস প্রদান করেন তিনি। এরপর ১৯৮৮ সাল থেকে অদ্যাবধি ২০২০ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ প্রায় তিনযুগ ধরে বুখারীর দরস প্রদান করে আসছেন।

তার কাছ থেকে এ পর্যন্ত হাজার হাজার ছাত্র বুখারীর দরস লাভ করেছে। তিনি বর্তমানে ৪৫ টি মাদরাসার প্রধান/খণ্ডকালীণ শায়খুল হাদীসের দায়িত্ব পালন করছেন।

বাংলাদেশের প্রথিতযশা এ আলেমের কাছে বিদেশ থেকেও অনেক মাদরাসার শায়খুল হাদীসগণ সনদ প্রাপ্তির লক্ষে বারিধারার কুঁড়েঘরে চলে আসেন। যার ফলে ইতিমধ্যে তার সুনাম সুখ্যাতি ছড়িয়ে গেছে বিশ্বময়। সুদান, কাতার, মালদ্বীপ, মালয়েশিয়া, আমেরিকা, লণ্ডন, মিশরসহ বিশ্বের ইলমী মারকাজের জ্ঞানপবন ব্যক্তিরা তার কাছে বরকত হাসিলের উদ্দেশে হাজির হোন। নিয়মিত তার দরবারে ভীড় জমান।

রচনাবলি : আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী রহ. এর কওমি মাদরাসার মেশকাত জামাতের পাঠ্যকিতাব ‘নখবাতুল ফিকার’ এর মতন সংকলন করেছেন তিনি। যা আজও দেশের বিভিন্ন মাদরাসায় পাঠ্যকিতাব হিসেবে পড়ানো হয়। আল্লামা কাসেমীর ইসলাহী বয়ানগুলো নিয়ে সংকলন করা হয়েছে ‘ইসলাহী বয়ান’ সিরিজ। যা বারিধারায় ছাত্র থাকা অবস্থায় আমি সংকলন করেছিলাম।

দেশভ্রমণ: তিনি দীন ইসলামকে প্রচারের জন্য বিশ্বের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেরিয়েছেন। তন্মধ্যে ভারত, পাকিস্তান, দুবাই , সৌদি আরব ও থাইল্যান্ড অন্যতম।

মৃত্যু: সারাদেশের আলেম-উলামা, ছাত্র-শিক্ষক ও লক্ষ লক্ষ ভক্তদের কাঁদিয়ে অবশেষে আজ ১৩ ডিসেম্বর ২০২০ সাল রোজ: রবিবার দুপুর  ১টায় এ কিংবদন্তি মহানায়ক চিরবিদায় নিয়ে প্রভূর সাক্ষাতে পাড়ি দিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা তাঁকে জান্নাতের আলা মাকাম দান করুন।

উপসংহার:
যুগশ্রেষ্ট রাহবার ও প্রখ্যাত শায়খুল হাদীস আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী রহ. তার শেষ জীবনেও দীন-ইসলামের হেফাজত ও সাধারণ মানুষের ঈমান-আকীদা সংরক্ষনের ব্যাপারে দিনরাত মেহনত করে গেছেন। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বিষয় নিয়ে সর্বদা কাজ করেছেন। সবকিছুর পাশাপাশি দুহাত ভরে ইলমে দীন বিতরণ করে গেছেন নিয়মিত। সারাদেশে ওয়াজ-মাহফিলের মাধ্যমে মানুষকে দীনের প্রতি আহবান করে তাদের ইলমের পিপাসা মিটিয়েছেন।

লেখক: নিউজরুম এডিটর, আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকম ও শিক্ষক, জামিয়া মাহমূদিয়া ইছহাকিয়া মানিকনগর মাদরাসা, ঢাকা।


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ