।।কাউসার লাবীব।।
সাব-এডিটর
বুয়ুক সেলজুক প্রধানমন্ত্রী নিযামুল মুলক। তার পুরো নাম আবু আলী আল-হাসান আল তুসি নিযাম উল-মুলক । তবে তিনি খাজা নিযামুল মুলক নামে অধিক পরিচিত। সেলজুকের এ উজিরে আলা বা প্রধানমন্ত্রী খণ্ডকালীন সময়ের জন্য সেলজুক সাম্রাজ্যের শাসক হিসেবেও অধিষ্ঠিত ছিলেন। নিযামুল মুলক তার নাম নয়। এটি তার উপাধী। সেলজুক সাম্রাজ্যের সরকারি ব্যবস্থাপনায় তিনি বেশ প্রভাব রাখার ফলে তিনি “নিযামুল মুলক” উপাধী লাভ করেন।
তার জন্ম ইংরেজি ১০১৮ সালে তুস শহরে। ১১ বছর বয়সে হিফজ শেষ করেন। এরপর তাফসির, হাদিস ও শাফেয়ি ফিকহে তিনি পান্ডিত্য অর্জন করেন। লেখাপড়া শেষে তিনি গজনির সুলতানদের অধীনে চাকরি করতেন। পরে বুয়ুক সেলজুক সাম্রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী হন। প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। যেগুলো ইতিহাসে নেযামিয়া মাদরাসা নামে পরিচিত। তিনি আলেমদের খুব সম্মান করতেন। আজানের শব্দ শোনার সঙ্গে সঙ্গে সব কাজ রেখে মসজিদে চলে দিতেন।
খাজা নিযামুল মুলক বাগদাদ, নিশাপুর , ইস্পাহান, খোরাসান, বর্তমান আফগানিস্তানের বালখ এবং ইরাকের বিভিন্ন শহরে নিযামিয়া নামে অসংখ্য মাদরাসা স্থাপন করেছিলেন। এসব মাদরাসা বর্তমান যুগের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আদলেই গড়ে তোলা হয়েছিল। এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের মাধ্যমে তিনি ইসলামি সভ্যতায় উচ্চ শিক্ষাকে উন্নত পর্যায়ে বা পূর্ণতায় পৌঁছানোর পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। হিজরি ৪৫৯ সালে বাগদাদে প্রতিষ্ঠিত নেযামিয়া মাদরাসাটি ছিল তার প্রতিষ্ঠিত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি। এখানে শিক্ষকতা করেছিলেন আবু আব্দুল্লাহ তাবারি, আবু মুহাম্মাদ খাওয়ারেযমি, আবু ইসহাক শিরাজি, আবু হামিদ গাজালির মতো মুসলিম দার্শনিকরা। বাগদাদে নেযামিয়া মাদরাসার ব্যাপক সফলতা পাওয়ার পর নেযামুল মুলক একের পর মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত করতে থাকেন।
বাগদাদে প্রতিষ্ঠিত নেযামিয়া মাদরাসার গ্রন্থাগার ছিল ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বপ্রথম গ্রন্থাগার। যশ-খ্যাতি ও সমৃদ্ধির দিক থেকে এই গ্রন্থাগারটির গর্ব করার মতো সংক্ষিপ্ত একটি দিনপঞ্জী বা ইতিহাসও রয়েছে। নিজামুল মুলক এই গ্রন্থাগারগুলো নির্মাণ করেছেন এবং তিনি নিজেই এই প্রতিষ্ঠানগুলোর তদারকি বা দেখাশোনা করতেন। তিনি মাদরাসাটি পরিদর্শন করতে গিয়ে ছোট্ট একটি রেসালা লিখেছিলেন। তাতে গ্রন্থাগার ও মাদরাসাটির প্রশাসনিক বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া আছে যা ইতিহাসে আজো সংরক্ষিত।
বাগদাদের নেযামিয়া মাদরাসাটি তিনি বিশাল অঙ্গন জুড়ে গড়ে তুলেছিলেন। যেখানে মাদরাসা ভবন ছাড়াও ছিল শিক্ষকদের বাসভবন, মসজিদ, সুবিশাল গ্রন্থাগার, মেহমান খানা ও উদ্যান। এতে ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদিও বিশেষ করে ওয়াজের মজলিশ, ধর্মীয় বিষয়-আশয় নিয়ে যুক্তি-তর্কের আসর ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হতো। এসবের কারণে বিশ্বের জ্ঞানী-গুণী মনীষীদের মিলনকেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল এটি। প্রতিষ্ঠালগ্নে এ মাদরাসার পাঠ্যতালিকায় ছিল শাফেয়ি ফিকাহ, হাদিস ও কোরআন অধ্যয়নসহ বেশকিছু বিষয়। পরে ধীরে ধীরে এগুলোর সঙ্গে যুক্ত হয় উলুমুল কোরআন, উসুলে ফিকহ, তাফসির, ইলমে কালাম, গণিত, চিকিৎসাবিদ্যা, সাহিত্যসহ আরো অনেক বিষয়।
ক্রমান্বয়ে নিশাপুর শহরেও তিনি এমন একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। যার ফলে বাগদাদের মতো এ শহরটিও জ্ঞান ও বিজ্ঞানে ব্যাপক অগ্রগতি লাভ করে। বিশিষ্ট কবি ও দার্শনিক ওমর খৈয়াম, ইমাম মোয়াফফাক নিশাপুরি, ইমামুল হারামাইন জুইয়িনি, ফরিদ উদ্দিন আত্তার নিশাবুরি প্রমুখের মতো জগদ্বিখ্যাত মনীষীগণ ছো্ঁয়ায় এ প্র্রতিষ্ঠান ধন্য হয়। তাদের শিক্ষকতায় এখানে গড়ে ওঠে অসংখ্য স্বনামধন্য মনীষী। মানের দিক থেকে বাগদাদের মাদরাসাটির পরপরই ছিল এটির স্থান।
এভাবে খাজা নিযামুল মুলকের হাতে গড়ে উঠেছিল ইস্ফাহানে নিযামিয়া মাদরাসা। যে প্রতিষ্ঠান ধন্য হয়েছিল আবু বকর মুহাম্মাদ বিন সাবেত খোজান্দি এবং ফখরুদ্দিন আবুল মায়ালি ভেরকানীর মতো জ্ঞানীদের ছোঁয়ায়। আর তার প্রতিষ্ঠিত বালখের নেযামিয়া মাদরাসাটির হাল ধরে ছিলেন আদম বিন আসাদ সোহরাওয়ার্দি ও রাশিদ ভাতভতের মতো মনীষীগণ। এভাবেই তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন শহরকে ইলমের নগরী হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন। ছড়িয়ে দিয়েছিলেন ইলমের আভা।
কোনো এক সফর শেষে মাদরাসা প্রেমী মহান এ উজির ৪৮৫ হিজরির রমজানে সুলতান মেলিক শাহ সেলজুকির সঙ্গে ইস্পাহান থেকে বাগদাদে রওনা হন। কাফেলা যখন নিহাওয়ান্দের কাছে এক গ্রামে এসে পৌছায়। তখন নিযামুল মুলক বলেন, হযরত উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর শাসনামলে এখানে অনেক সাহাবি শহিদ হয়েছিলেন। তারা কতই না সৌভাগ্যবান। এরপর সেখানে কাফেলা তাবু গাড়ে।
সেদিন ছিল ১০ রমজান। ইফতার শেষে নিযামুল মুলক মসজিদ থেকে তাবুর দিকে যাচ্ছিলেন। এ সময় এক কুর্দী বালক এসে তার কাছে সাহায্য চায়। তিনি বালকের দিকে এগিয়ে যেতেই সে তার পেটে ছুরিকাঘাত করে। মাটিতে লুটিয়ে পড়েন নিযামুল মুলক। বালক পালাতে গিয়ে তাবুর রশিতে পা আটকে পড়ে যায় এবং নিরাপত্তা রক্ষীদের হাতে নিহত হয়। ধারণা করা হয় এ বালক ছিল ফেদাইন।
লোকজন ধরাধরি করে আহত নিযামুল মুলককে তাবুতে নিয়ে যায়। আহত অবস্থায় তিনি শহিদি মৃত্যুর সুভাস পাওয়ায় বারবার আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছিলেন। পাশাপাশি তিনি বলছিলেন, ‘আমার খুনিকে তোমরা কিছু বলো না। আমি তাকে মাফ করে দিয়েছি।’ ইতিহাসের মহান এ বীর ৪৮৫ হিজরি সনের ১০ রমজান দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে প্রভূর সান্যিধ্যে যাত্রা করেন।
-কেএল