মুজতাহিদুল ইসলাম।।
ভাস্কর্য। সময়ের এক আলোচিত অধ্যায়। পক্ষে-বিপক্ষে নানা উক্তির ছড়াছড়ি। বৈধতা অবৈধতার নানা মতামত চারদিকে। জ্ঞানী মুর্খ প্রত্যেকেই মতামত ব্যক্ত করে। শাস্ত্রীয় বিজ্ঞজন কোরআন হাদিস থেকে বলেন, আর মূর্খরা নিজ থেকেই বলে। প্রচার-প্রচারণারও শেষ নেই। তবে জ্ঞানীরা বলেন, ভাস্কর্য নিয়ে কোন অপপ্রচারের সুযোগ নেই। এ কথা বলার অবকাশ নেই যে, ‘ভাস্কর্য ও মূর্তি ভিন্ন ভিন্ন দুটি বিষয়, ইসলামে মূর্তি নিষিদ্ধ, ভাস্কর্য নিষিদ্ধ নয়’। কেননা ভাস্কর্য ও মূর্তি এক ও অভিন্ন।
ভিন্ন ভিন্ন দুটি নাম মাত্র। মূর্তির যেমন আকৃতি আছে তেমনি প্রাণীর ভাস্কর্যেরও আছে এক স্বতন্ত্র আকৃতি। আর ইসলামে প্রাণীর যেকোনো আকৃতি বানানো, তৈরি করা, নির্মাণ করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তা ইবাদতের উদ্দেশ্যে হোক বা অন্য কোনো উদ্দেশ্যে হোক। তাই প্রাণীর ভাস্কর্য ও মূর্তির মাঝে পার্থক্য দাঁড় করানোর সামান্যতম সুযোগও রাখেনি ইসলাম। যদি আরেকটু খুলে বলি।
ভাস্কর্য বা মূর্তি সাধারণত তিন ধরনের। ১. জড়বস্তুর ভাস্কর্য। যেমন, ফুলের ভাস্কর্য বা মিনারের ভাস্কর্য। এগুলো নির্মাণ করা বৈধ। এর মাধ্যমে শহর বা এলাকার সৌন্দর্য বর্ধন করা যেতে পারে। (সহিহ বুখারি, হাদিস ৫৯৫৮, তাফসিরে কাশশাফ, সুরা সাবা, আয়াত ১৩)
২. অমুসলিমদের ইবাদতখানায় প্রাণী-আকৃতির যে ভাস্কর্য বা মূর্তি তৈরি করা হয়, যেগুলো পূজা বা উপাসনা করার জন্য তৈরি করা হয়, সেগুলোকে সাধারণত প্রতিমা বলা হয়। এ ধরণের ভাস্কর্য বা প্রতিমা তৈরি হারাম বা নাজায়েজ। ইবাদতের নিয়তে এগুলো নির্মাণ করা হলে ঈমানই থাকবে না।
৩. আরেক শ্রেণীর মূর্তি বা ভাস্কর্য আছে যা উপাসনার জন্য বানানো হয় না এবং তা জড়বস্তুও না; তবে প্রাণী-আকৃতি। যেমন, মহান কোনো ব্যক্তির ভাস্কর্য, যা তার প্রতি শ্রদ্ধা-সম্মান নিবেদন বা তাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য বানানো হয়, ইবাদত বা পূজা করার জন্য নয়। এ ধরণের ভাস্কর্য নির্মাণ করলে ঈমান চলে যাবে না, তবে কবিরা গুনাহ হবে। ফলে এটিও হারাম ও নিষিদ্ধ। (শরহু নববি আলা মুসলিম ১৪/৮১) এ থেকে এ কথাই প্রমাণিত হয়, প্রাণীর ভাস্কর্য ও মূর্তির মাঝে কোনো পার্থক্য নেই। উভয়টি নিষিদ্ধ।
বিজ্ঞজন এ-কথাও বলেন, প্রাণীর ভাস্কর্যকে প্রাণহীন কোনো জিনিসের ভাস্কর্যের সাথে তুলনা করে ভাস্কর্যের বৈধতার পক্ষে প্রমাণ পেশ করারও সুযোগ নেই। প্রাণহীন জিনিসের ভাস্কর্য ইসলামে বৈধ হলেও প্রাণীর ভাস্কর্য ইসলামে বৈধ নয়।
আর আল কুরআনের আয়াত, ‘তিনি (হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালাম) যা চাইতেন তারা (অনুগত জিনগণ) তাঁর জন্য তা তৈরি করত, যথা: দুর্গ, (জড়বস্তুর) ভাস্কর্য ও হাউজের মতো (বড়ো বড়ো) পাত্র এবং (চুল্লির উপর) দৃঢ়ভাবে স্থাপিত ডেগ। ‘হে দাউদ-পরিবার তোমরা শোকর আদায় করো! আমার বান্দাদের মধ্যে অল্পই কৃতজ্ঞ। (সুরা সাবা, আয়াত ১৩)
বিশ^বরেণ্য মুফাসসির ইমাম কুরতুবি রহ. স্বরচিত জগৎ বিখ্যাত তাফসিরগ্রন্থ তাফসিরে কুরতুবিতে ‘তিমসাল’ শব্দের ব্যাখ্যায় বলেন, কোনো প্রাণী বা নিষ্প্রাণ বস্তুর আকৃতির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ আকৃতিই হলো ‘তিমসাল’ তথা ভাস্কর্য। (তাফসিরে কুরতুবি, সুরা সাবা: ১৩)
বিখ্যাত মুফাসসির ও বিদগ্ধ আরবি ভাষাবিধ আল্লামা যামাখশারি রহ.ও পবিত্র কুরআনে বর্ণিত ‘তিমসাল’ শব্দের ব্যাখ্যায় বলেন, ভাস্কর্য বলা হয়, কোনো জিনিসের অনুরূপ আকৃতিতে তৈরিকৃত আকৃতিকে, তা প্রাণীর হোক বা অন্য কেনো বস্তুর হোক। (তাফসিরে কাশশাফ, সুরা সাবা: ১৩)
ইমাম কুরতুবি রহ. উক্ত আয়াতের মধ্যকার ‘তামাসিল’ শব্দের ব্যাখ্যায় আরো উল্লেখ করেছেন, একদল লোক এই আয়াত দ্বারা প্রাণীর ভাস্কর্য নির্মাণের বৈধতা প্রমাণ করে থাকেন, (এ ব্যাপারে) ইবনে আতিয়্যা রহ. বলেন, ‘এই আয়াত দ্বারা প্রাণীর ভাস্কর্য নির্মাণের বৈধতা প্রমাণ করা নিতান্তই ভুল। (তিনি আরো বলেন) কোনো ইমাম এই আয়াত দ্বারা ভাস্কর্য নির্মাণের বৈধতা প্রমাণ করেছেন বলে আমার জানা নেই।’ (তাফসিরে কুরতুবি, সুরা সাবা: ১৩)
যেহেতু ভাস্কর্য প্রাণীরও হয় প্রাণহীন জিনিসেরও হয় এবং উভয়টাকেই সাধারণভাবে ভাস্কর্য বলা হয়, তাই হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালামের নির্দেশে তৈরিকৃত ভাস্কর্য প্রাণীর ভাস্কর্যই ছিলো, তা নিশ্চিতভাবে কিছুতেই বলা যায় না। উপরন্তু এ সম্ভাবনাই যুক্তিযুক্ত যে, আল্লাহর নবি হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালামের নির্দেশে তৈরিকৃত ভাস্কর্য ছিলো বিভিন্ন প্রাণহীণ জড়বস্তুর, যেমন, গাছপালা, ফুল ইত্যাদির ভাস্কর্য। প্রাণীর ভাস্কর্য নয়। কেননা হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালাম হযরত মুসা আলাইহিস সালামের শরিয়তের অনুসারি ছিলেন। আর হযরত মুসা আলাইহিস সালামের কাছে অবতীর্ন কিতাব ‘তাওরাত’ এ প্রাণীর মূর্তি ও ভাস্কর্য নির্মাণে নিষেধাজ্ঞা এসেছে। তাওরাতে বর্ণিত হয়েছে, ‘কোন মূর্তি ও ভাস্কর্য, যা সাদৃশ্য হয় কোনো নর-নারী বা ভূ-পৃষ্ঠের অন্য কোনো প্রাণী বা আকাশে উড়া কোনো পাখি বা জমিনে বুকের উপর ভর দিয়ে চলা কোনো প্রাণী বা সমুদ্রের কোনো মাছের সাথে, তা তোমার জন্য তৈরি করা সমীচিন নয়’।
অতএব এ আয়াত কে প্রাণীর ভাস্কর্য নির্মাণের বৈধতার পক্ষে প্রমাণ হিসেবে পেশ করা সঠিক নয়। কাজেই কুরআনে বর্ণিত ‘তিমসাল’ শব্দকে কেবলমাত্র ‘প্রাণীর ভাস্কর্য’ অর্থে ব্যবহার করা যেমন অবান্তর, তেমনি হযরত সুলাইমান আ. একজন নবি হয়ে নিজ অনুসৃত শরিয়তের গন্ডি পেড়িয়ে প্রাণীর ভাস্কর্য নির্মাণের নির্দেশ দিবেন তা ভাবাও অবান্তর ও বাস্তবতা বিরূদ্ধ। (আদালাতি ফায়সালে, পৃষ্ঠা ১০৬)
আর যদি মেনেও নেওয়া হয় যে, এই আয়াত প্রাণীর ভাস্কর্য নির্মাণের বৈধতার প্রমাণ বহন করে, তবুও তা হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালামের শরিয়তে ভাস্কর্য নির্মাণের বৈধতার প্রমাণ বহন করে, শরিয়তে মুহাম্মদিতে নয়। তাফসিরে কুরতুবিতে ইমাম কুরতুবি রহ. বলেন, এ আয়াত একথা প্রমাণ করে যে, সে যুগে (হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালামের যুগ) (প্রাণীর) ভাস্কর্য নির্মাণ করা বৈধ ছিলো। তবে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শরিয়তে তার বৈধতা রহিত করা হয়েছে’। (তাফসিরে কুরতুবি, সুরা সাবা: ১৩, তাফসিরে মাআরিফুল কুরআন, শফি রহ. কৃত: ৭/১৪৭)
তাফসিরে যামাখশারিতে আল্লামা যামাখশারী রহ. উল্লেখ করেছেন, আবুল আলিয়া রহ. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালামের যুগে (প্রাণীর) ভাস্কর্য নির্মাণ করা অবৈধ ছিলো না’। (তাফসিরে যামাখশারি, সুরা সাবা: ১৩)
তাফসিরে মাওয়ারদিতে রয়েছে, হাসান বসরি রহ. বলেছেন, ‘হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালামের যুগে (প্রাণীর) ভাস্কর্য নির্মাণ করা অবৈধ ছিলো না’। (তাফসিরে মাওয়ারদি, সুরা সাবা: ১৩)
শুভ পরিণাম কামনা করি তাদের জন্য, কুরআনে কারিমের মনগড়া ব্যাখ্যাই যাদের লেখার শুভাবর্ধন। জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুসালেহ সেকেন্দার সাহেব লিখেছেন “অনেকে হয়ত খোঁড়া যুক্তি দিয়ে বলতে পারেন, হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালামের সময় ভাস্কর্য নির্মাণের অনুমতি ছিলো; হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সময় তা বৈধ নয়। তাদের এ ধরণের বক্তব্য আল কুরআনের অস্তিত্বকেই প্রশ্নবিদ্ধ করবে। কারণ, আল কুরআনের প্রায় অধিকাংশ অংশজুড়ে প্রাচীন ইতিহাস, নবীদের সময়ের দৃষ্টান্ত নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে এবং ওই আলোচনার মাধ্যমে মুসলিমদের জন্য করণীয় ও বর্জনীয় সম্পর্কে বলা হয়েছে। মুসলিমরা যদি এভাবে নিজেদের প্রয়োজনে আল কুরআনে বর্ণিত নবিদের সময়ের ঘটনা তাদের জন্য প্রযোজ্য নয় বলতে থাকেন, তাহলে ইসলামের অস্তিত্বই বিপন্ন হবে”। সংশ্লিষ্ট আয়াতের ব্যাখ্যায় শাস্ত্রীয় বিশেষজ্ঞ মুফাসসির, মুহাদ্দিস ও মুফতিগণের মতামত গ্রহণ না করে নিজ থেকে উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় কলম ধরা চরম হঠকারিতা ও দুঃসাহসিকতার প্রমাণ। হয়ত নিজেকে ইসলাম বিশেষজ্ঞদের কাতারে শামিল করার সদিচ্ছা থেকেই তিনি কলম ধরেছেন। কিন্তু অনধিকার চর্চার আবর্তনে ঢাকা তার এ সদিচ্ছাই যে তাকে অন্ধকারে ঠেলে দিচ্ছে এ জ্ঞান টুকুও একজন বিজ্ঞ অধ্যাপকের থাকা উচিত ছিলো। কোরআনের মনগড়া ব্যাখ্যার ভায়াবহতার ব্যাপারে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি কুরআনে কারিমের মনগড়া ব্যাখ্যা করে, সে যেন তার বাসস্থান জাহান্নামে বানিয়ে নেয়’। (তিরমিযী শরিফ, হাদিস ২৯৫০)
নববী শিক্ষা গ্রহন না করে কুরআনে কারিমের এ যথেচ্ছা ব্যাখ্যা প্রদান, এর প্রবক্তার সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জ্ঞাণের দৈন্যতা ও অজ্ঞতার পরিচয় বহন করে। ইসলামী জ্ঞানে পারদর্শী ব্যক্তি মাত্রই জানেন, পূর্ববর্তী নবিদের শরিয়তে অনুসৃত বিধানাবলী তখনই উম্মতে মুহাম্মদিয়্যার জন্য অনুসৃত হবে, যখন কুরআন হাদিস তা অনুসরণের নির্দেশ দিবে বা কুরআন হাদিসে পূর্ববর্তী নবিদের শরিয়তে অনুসৃত বিধানের বিপরীত কোনো বিধান বিদ্যমান না থাকবে। কুরআন হাদিসের প্রকৃত বিজ্ঞজনদের এ ধরনের বিধান অজানা নয়।
হাদিস শাস্ত্রের বিখ্যাত গ্রন্থ বুখারি শরিফে স্বয়ং হযরত সুলাইমান আ. এর ৬০ উর্ধ্ব স্ত্রীর বিবরণ এসেছে, আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাল্লাহ সা. বলেছেন, সুলাইমান ইবনে দাউদ আ. বলেছিলেন, আজ রাতে আমি একশ অথবা বলেছেন নিরানব্বই জন স্ত্রীর সাথে সংগত হবো। তাদের প্রত্যেকেই একজন বীর মুজাহিদ প্রসব করবে। বুখারি শরিফ, হাদিস ২৮১৯) এছাড়াও ৬০, ৭০ ও ৯০ জন স্ত্রীর কথাও বুখারি শরিফে বর্ণিত হয়েছে। (বুখারি শরিফ, হাদিস ৭৪৬৯, ৬৭২০, ৩৪২৪)
অথচ উম্মতে মুহাম্মদির জন্য এক সাথে শুধুমাত্র চারটি বিবাহের বৈধতা দিয়েছে ইসলাম। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘নারীদের মধ্যে যারা তোমাদের ভালো লাগে তাদের বিয়ে করো দু দুজন, তিন তিনজন বা চার চারজন (করে)। কিন্তু যদি আশঙ্কা করো যে, (একাধিক স্ত্রীর মধ্যে) সুবিচার করতে পারবে না, তবে বিয়ে করো একজনকেই’। (সুরা নিসা: ৩)
কুরআনে কারিমে আল্লাহ তায়ালা ইহুদি শরিয়তের বিধান বর্ণনা করতে গিয়ে ইরশাদ করেছেন, ‘আর ইহুদিদের জন্য আমি প্রত্যেক নখযুক্ত জন্তু হারাম করেছিলাম এবং গরু ও ছাগল থেকে তাদের জন্য হারাম করেছিলাম তাদের চর্বি’। (সুরা আনআম: ১৪৬)
অর্থাৎ প্রত্যেক নখ (ক্ষুর) বিশিষ্ট জন্তু- যার আঙ্গুলগুলো বিচ্ছিন্ন নয়। যেমন, উট, হাঁস ইত্যাদি হারাম করা হয়েছিল। (সংক্ষিপ্ত তাফসিরে উছমানী, সুরা আনআম: ১৪৬)
এ আয়াত দ্বারা উট, হাঁস ইত্যাদি ইহুদিদের জন্য হারাম ছিল তা প্রমাণিত হয়। কিন্তু অপর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা মুহাম¥দ সা. এর উম্মতের জন্য তার বৈধতা ঘোষণায় এরশাদ করেছেন, ‘(হে নবি!) আপনি বলে দিন, আমার প্রতি যে (বিধান) পাঠানো হয়েছে তাতে আমি এমন কোনো জিনিস পাই না, যা আহারকারীর জন্য হারাম- যে তা আহার করে। তবে তা যদি হয় মৃত জন্তু বা প্রবাহিত রক্ত কিংবা শুকরের গোশত, (তবে ভিন্ন কথা), কেননা তা অপবিত্র। অথবা তা যদি হয় হারাম পশু, যার উপর (অর্থাৎ যাকে যবেহ করার সময়) আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নাম উচ্চারণ করা হয়েছে’। (সুরা আনআম: ১৪৫)
পূর্ববর্তী নবিদের উপর আরোপিত বিধানাবলী যদি ব্যাপকভাবে মুহাম্মদ সা. এর ধর্মে অনুসরনীয় হত, তাহলে একই সাথে চারের অধিক বিবাহ বৈধ বিবেচিত হত এবং উট, হাঁস ভক্ষণ করা আমাদের জন্য অবৈধ হত।
তাই কোনো বিষয়ে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ধর্মে স্পষ্ট বিধান থাকা সত্তে¡ও তা গ্রহণ করার পরিবর্তে পূর্ববর্তী নবিদের ঘটনা থেকে তার বিপরীত বিধান গ্রহণ করা ইসলামে অনুমোদিত নয়।
কাজেই বলতে দ্বিধা নেইÑ এসকল ক্ষেত্রে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ধর্মীয় বিধান উপেক্ষা করে পূর্ববর্তী নবিদের ঘটনা থেকে বিধান গ্রহণ করাই প্রকারান্তরে মুহাম্মদি ধর্মকে বিপন্ন করার নামান্তর।
তাছাড়া তর্কের খাতিরে সাময়িকভাবে যদি একথা মেনেও নিই যে, প্রথমদিকে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শরিয়তে তা বৈধ ছিল, তাহলে এ কথা বলতেই হবে যে, পরবর্তীতে তা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কেননা ছবি, মূর্তি ও প্রাণীর ভাস্কর্য নির্মাণের ভয়াবহ শাস্তির ঘোষণা স্বয়ং নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নির্ভরযোগ্য বহু হাদিসের মাধ্যমে তা দ্ব্যর্থহীনভাবে দিয়েছেন। (তাফসিরে কুরতুবি, সুরা সাবা: ১৩)
রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, ‘(কিয়ামতের দিন) মানুষের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন শাস্তি হবে তাদের, যারা ছবি বানায় এবং মূর্তি ও ভাস্কর্য নির্মাণ করে। (সহিহ বুখারি, হাদিস ৫৯৫০)
রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অনত্র এরশাদ করেছেন, ‘যারা এ জাতীয় প্রাণীর ছবি, মূর্তি বা ভাস্কর্য তৈরি করে, কিয়ামতের দিন তাদেরকে শাস্তি দেয়া হবে। তাদের বলা হবে, তোমরা যা বানিয়েছিলে তা জীবিত করো’। (সহিহ বুখারি, হাদিস ৫৯৫১)
তিনি আরো এরশাদ করেছেন, ‘কিয়ামতের দিন সেসব মানুষের সবচেয়ে কঠিন আযাব হবে, যারা আল্লাহর সৃষ্টির (প্রাণীর) অনুরূপ তৈরী করবে’। (সহিহ বুখারি, হাদিস ৫৯৫৪)
অন্যত্র হযরত কাতাদা রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, আমি ইবনে আব্বাস রা. এর নিকট ছিলাম। আর (উপস্থিত) লোকজন তাঁর কাছে বিভিন্ন কথা জিজ্ঞাসা করছিল। কিন্তু (কোন কথার উত্তরেই) তিনি নবিজি সা. এর (হাদিস) উল্লেখ করছিলেন না। অবশেষে তাঁকে ছবি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বললেন, ‘আমি মুহাম্মদ সা. কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি দুনিয়ায় কোনো প্রাণীর ছবি নির্মাণ করে, কিয়ামতের দিন তাকে কঠোরভাবে নির্দেশ দেওয়া হবে ঐ ছবির মধ্যে রূহ্ দান করার জন্যে। কিন্তু সে রূহ দান করতে পারবে না। (বুখারি শরিফ, ৫৯৬৩)
আর আম্মাজান হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাযিয়াল্লাহু আনহা পুতুল নিয়ে খেলা করা এবং নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আয়েশা রা. কে তা থেকে বারণ না করা থেকেও ভাস্কর্য নির্মাণের পক্ষে প্রমাণ উপস্থাপন করা যাবে না। কেননা হযরত আয়েশা রা. তখন ছোটো বালিকা ছিলেন। (তাফসিরে কুরতুবি, সুরা সাবা, আয়াত ১৩)
আর ছবি, মূর্তি ও ভাস্কর্য নির্মাণে ভয়াবহ সতর্কবাণী থাকা সত্তে¡ও হযরত আয়েশা রা. এর ছোটো সময়ের ইতিহাস দ্বারা ভাস্কর্য নির্মাণের বৈধতা প্রমাণ করার চেষ্টা করা কোনো বুদ্ধিমানের কাজ নয়।
বিস্ময়ে হতবাক ও ব্যথিত হতে হয় যে, কিছুলোক হযরত আয়েশা রা. এর ছোট সময়ের পুতুল খেলার ঘটনা শুনে আপ্লুত হয়ে তা দ্বারা ভাস্কর্য নির্মাণের বৈধতা প্রমাণেরও ব্যর্থ চেষ্টা করে। অথচ ভাস্কর্য নির্মাণের অবৈধতা বর্ণনায় হযরত আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত নবিজি সা. এর দ্ব্যর্থহীন বহু বাণীগুলোর ক্ষেত্রে তারা অন্ধ ও বধির ব্যক্তির ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়।
হযরত আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজের ঘরের এমন কিছুই না ভেঙ্গে ছাড়তেন না, যাতে কোন (প্রাণীর) ছবি থাকত’। (বুখারি শরিফ, ৫৯৫২)
হযরত আয়েশা রা. থেকে আরো বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম (তাবুক যুদ্ধের সফর থেকে প্রত্যাগমন করলেন। আমি আমার কক্ষে পাতলা কাপড়ের পরদা টাঙ্গিয়েছিলাম। তাতে ছিল (প্রাণীর) অনেকগুলো ছবি। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন এটা দেখলেন, তখন তা ছিঁড়ে ফেললেন এবং বললেন, ‘কিয়ামতের দিন সে সব মানুষের সবচেয়ে কঠিন আযাব হবে, যারা আল্লাহর সৃষ্টির (প্রাণীর) অনুরূপ তৈরি করবে’। (বুখারি শরিফ, ৫৯৫৪)
অন্যত্র হযরত আয়েশা রা. থেকে আরো বর্ণিত হয়েছে। তিনি একবার ছবিযুক্ত গদি খরীদ করেন। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম (বাহির থেকে এসে এ অবস্থা দেখে) দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকলেন, প্রবেশ করলেন না। আমি বললাম: যে পাপ আমি করেছি তা থেকে আল্লাহর কাছে তওবা করছি। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, এ গদি কিসের জন্য ? আমি বললাম আপনি এতে বসবেন ও হেলান দিবেন।
তিনি বললেন, এসব ছবির নির্মাতাদের কিয়ামতের দিন আযাব দেওয়া হবে। তাদের বলা হবে, যা তোমরা তৈরি করেছিলে সেগুলো জিবীত কর। আর যে ঘরে ছবি থাকে সে ঘরে ফিরিশতা প্রবেশ করে না। (বুখারি শরিফ, ৫৯৫৭)
প্রাণীর ভাস্কর্য নির্মাণ শুধুমাত্র ব্যক্তির আখেরাতের শুভ পরিণামকেই বিনষ্ট করে না বরং তার দুনিয়ার জীবনকেও করে মহান মালিকের রহমত ও বরকত থেকে বঞ্চিত।
বুখারি শরিফে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, ‘জিবরাঈল আ. (একবার) নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট (আগমনের) ওয়াদা করেন। কিন্তু তিনি আসতে দেরী করেন।
এতে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খুবই কষ্ট হচ্ছিল। এরপর নবিজি সা. বের হয়ে পড়লেন। তখন জিবরাঈলের সাথে তাঁর সাক্ষাত হল। তিনি যে মানসিক কষ্ট পেয়েছিলেন সে বিষয়ে তাঁর কাছে বর্ণনা করলেন। তখন জিবরাঈল আ. বললেন, যে ঘরে ছবি বা কুকুর থাকে সে ঘরে আমরা কখনও প্রবেশ করি না। (বুখারি শরিফ, ৫৯৬০)
তাই, আমাদের উচিত ভাস্কর্য নিয়ে কিছু অবিবেচক ও ধর্মীয় জ্ঞানহীন ব্যক্তিদের মনগড়া ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের পেছনে না পড়ে ইসলামী জ্ঞানের সোনালী আলোয় আলোকিত ব্যক্তিদের স্বর্ণোজ্জ্বল উপদেশ গ্রহণ করা এবং এমন সকল কাজ থেকে বিরত থাকা, যাতে বিজাতীয়দের সাথে সাদৃশ্য অবলম্বন হয়, আল্লাহ তায়ালা অসন্তুষ্ট হন ও তার লানত বর্ষিত হয়। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে তার সন্তুষ্টি অনুযায়ী জীবন-যাপন করে চির শান্তির নীড় অসীম জান্নাতের অধিকারী হওয়ার তওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক: শিক্ষার্থী, ফতোয়া বিভাগ, জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া