মাওলানা মুহাম্মদ আবু সালেহ।।
পুরাকালে বাদশাহদের দরবারে আলেম উলামাদের খুব কদর ছিল। এক বাদশাহ দ্বীনী বিষয় নিয়ে তার দরবারে এক আলেমের সাথে আলোচনা করছিলেন। এমন সময় এক ব্যক্তি একটি শিশুকে নিয়ে এসে সেই আলেমের খেদমতে আরজ করলেন, হুজুর, আমার ছেলেটির পেট ফেঁপেছে, ব্যথায় খুব কষ্ট পাচ্ছে। দয়া করে কিছু করুন যেন আল্লাহ পাক আরোগ্য দান করেন।
উক্ত বুযুর্গ আলেম শিশুটির পেট লক্ষ্য করে একটি ফুঁক দিলেন এবং বললেন, যান, নিয়ে যান। ইনশাআল্লাহ ভাল হয়ে যাবে। বাদশাহ বিষয়টি লক্ষ্য করলেন; কিন্তু সন্তষ্ট হতে পারলেন না।
তিনি বুযুর্গকে বললেন, হযরত! আমি আপনাকে জ্ঞানী ব্যক্তি ভেবেছিলাম! কিন্তু আপনি যা করলেন তার কোন যুক্তি দেখি না। শিশুটি যন্ত্রনায় কাতর, অথচ তার চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা না করে শুধুমাত্র একটি 'ছু' করে দিলেন। এই ‘ছু’ করাতে কী যায় আসে? রুগ্নদের প্রতি দয়া দেখানোই তো মহৎ ব্যক্তির লক্ষন।
বুযুর্গ বললেন, বাদশাহ আপনার লক্ষণ বেশি ভাল নয়। দেশের লোক আপনার প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে পড়েছে। তারা আপনার বদনাম ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে। জনগনের অসন্তুষ্টি মঙ্গলজনক হয় না। বুযুর্গ আলেমের কথা শ্রবণে বাদশাহর মুখমন্ডল কালো হয়ে একেবারে যেন নূয়ে পড়লো।
একটু থেমে বুযুর্গ বললেন, তবে দুষ্টু প্রকৃতির লোকেরাই শুধু বদনাম ছড়ায়। কারণ, দুষ্টুদের দমনের জন্য আপনার কঠোরতায় তারা সন্তুষ্ট হতে পারে না। এতে প্রকৃতপক্ষে আপনার মর্যাদাই বৃদ্ধি পাবে। বাদশাহর মুখ এবার হাস্যোজ্জ্বল হয়ে উঠলো। আনন্দে মুখে কথার খৈ ফুটতে লাগলো।
বুযুর্গ বললেন, কিন্তু দেশে দুষ্ট লোকের সংখ্যাই অধিক। এরা বিদ্রোহ করলে আপনার ক্ষমতা রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়বে। একথা শুনে বাদশাহর মুখমন্ডল আবার লাল হয়ে উঠলো। ক্রোধে তিনি ফেটে পড়লেন। আসন ছেড়ে উঠে পড়লেন। দুই হাতের আস্তিন গুটাতে গুটাতে বললেন, কে আছে আমার সঙ্গে বিদ্রোহ করবে? আমার সৈন্য আছে, অস্ত্র আছে, বিদ্রোহ কিভাবে দমন করতে হয় তাও আমার জানা আছে।
বুযুর্গ এবার বললেন, দুষ্টু লোকেরা সংখ্যায় অধিক হলেও তাদের সাহস কম। বিদ্রোহ করার মত মনোবল তাদের নেই। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। আপনার মত ন্যায়পরায়ন বাদশাহ ইনশাআল্লাহ শান্তিতে থাকবেন এবং দেশেও শান্তি বিরাজ করবে।
একথা শুনে বাদশাহ শান্ত সুবোধ বালকের মত আসনে বসে পড়লেন। তার চেহারায় পূর্বের প্রশান্তির ভাব ফিরে এলো। যেন তার কিছুই হয়নি।
এবার বুযুর্গ বললেন, দেখুন বাদশাহ! আমি আপনাকে চারটি কথা বলেছি। এর দ্বারা আপনার অবস্থা চারবার পরিবর্তন হয়েছে। প্রথম কথায় লজ্জায়, অপমানে আপনার চেহারা কালো হয়ে পড়লো। দ্বিতীয় কথা দ্বারা আপনি আনন্দিত হলেন। তৃতীয় কথায় আপনার মুখমন্ডল ক্রোধে লাল হয়ে উঠলো, আপনি আসন ছেড়ে উঠে ছটফট করতে লাগলেন। চতুর্থ কথায় আপনার মুখমন্ডলে পুনরায় প্রশান্ত ভাব ফিরে এলো। আপনি নিশ্চিন্তে আসন গ্রহন করলেন।
বুযুর্গ আলেম বলে চললেন, দেখুন, আমি আল্লাহ পাকের অতি নগন্য এক বান্দা। আমার কথা যদি আপনার উপর এতটা প্রভাব এবং প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে, তবে মহান আল্লাহর কথায় কি কোনো প্রভাব এবং প্রতিক্রিয়া হতে পারে না? তাঁর পবিত্র বানীর প্রভাবে কি পাহাড় চূর্ণ হয়ে যেতে পারে না? তাঁর কথা কি মানুষের দেহের উপর প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম নয়? রোগের উপশম ঘটাতে পারে না? তবে কেন আপনার এই ধারণা জন্মালো যে, শিশুটির দেহের উদ্দেশ্যে প্রয়োগ করা পবিত্র কুরআনের বানী তার উপর কোন আছর করবে না, তার রোগ উপশম হবে না?
বাদশাহ এবার নিজের ভুল বুঝতে পেরে লজ্জিত হলেন এবং তওবা করলেন, জীবনে আর এরূপ কথা বলবেন না।
উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেম হাকিমুল উম্মত হযরত আশরাফ আলী থানভী রহমাতুল্লাহ আলাইহির খলিফা হযরত কারী মুহাম্মদ তাইয়েব রহমাতুল্লাহ আলাইহির ওয়াজ থেকে সংগৃহীত অতি মূল্যবান এই ঘটনাটি। ১৯৬১ ইং সনে করাচীর জুন মার্কেটের দারুল কুরআন মাদ্রাসায় এক মাহফিলে তিনি এই বয়ানটি করেন। আল্লাহ পাক তাকে জান্নাতুল ফিরদাউস নসিব করুন।
আজকের এই বিজ্ঞানের জয়জয়কারের সময়ে কেউ কেউ বিজ্ঞানের যুক্তির দোহাই দিয়ে ধর্ম এবং ধর্মীয় বিষয়াদির প্রতি ভিন্নতর মনোভাব পোষন করতে চান। বিজ্ঞানের থিউরি দিয়ে ধর্মের সকল কিছুকে মেপে পরখ করতে চান। সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআ'লা এবং পরকালের প্রতি বিশ্বাসকেও তারা বিজ্ঞানের ব্যাখ্যার আওতায় নিয়ে আসার পক্ষে। তাদের জন্য এই ঘটনায় শিক্ষণীয় রয়েছে বটে।
কথা হচ্ছে, আমরাও বিজ্ঞানকে সাথে নিয়েই চলতে চাই। আগাতে চাই। আজকের উন্নয়ন-আবিষ্কার বিজ্ঞান ছাড়া অকল্পনীয়। জীবনও বিজ্ঞানের উপর বিভিন্নভাবে নির্ভরশীল। কিন্তু অহেতুক আমাদেরকে বিজ্ঞানের বিপরীতে এনে প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করানোর মানসিকতা দুঃখজনক। আমাদের মনে রাখতে হবে, জগতের অনেক কিছুকে বিজ্ঞান দিয়ে প্রমান করা গেলেও কিছু কিছু জায়গায় এসে বিজ্ঞান কিন্তু ঠিকই থমকে দাঁড়ায়। আর বিজ্ঞান যেখানে থেমে যায়, বিজ্ঞানের দৌঁড় যেখানে গিয়ে শেষ হয়ে যায়; মহাগ্রন্থ আল কুরআন সেখানে কথা বলে। সেখান থেকে আল কুরআন শুরু করে।
পথ দেখিয়ে দেয়। এমনটা হবেই না বা কেন? বিজ্ঞান তো মানব সৃষ্ট, মানুষের গবেষনালব্ধ জ্ঞান; আর কুরআন যে এই মানবজাতিরই সৃষ্টিকর্তার প্রেরিত বাণী। উদাহরণস্বরূপ, রূহ, আত্মা বা প্রাণের বিষয়ে বিজ্ঞানের বক্তব্য কি? বিজ্ঞান এই ব্যাপারে কি ব্যাখ্যা দেয়? দিতে পেরেছে কি আজ পর্যন্ত কোনো ব্যাখ্যা? আমাদের জানামতে, পারেনি। কিন্তু কারও কারও কাছে সেকেলে মনে হওয়া মহাগ্রন্থ আল কুরআন প্রায় সাড়ে চৌদ্দশো বছর পূর্বে রূহ সম্মন্ধে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে এমন তথ্য দিয়েছে, যা পাঠ করলে, চিন্তা করলে শরীর শিউরে ওঠে। শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে আসে মহান সৃষ্টিকর্তার প্রতি। বিশ্বাসের বীজ অঙ্কুরিত হয় হৃদয়ের গহীনে।
তাই বিজ্ঞানের ফতোয়া ছাড়া কোনো কিছু যদি বিশ্বাস করতেই না চান, তাহলে আপনি যে বেঁচে আছেন, অর্থাৎ আপনার ভেতরে বসবাস করা রূহ বা আত্মার ব্যাপারে সঠিকভাবে জেনে তারপরেই বেঁচে থাকা আপনার নৈতিক দায়িত্ব। আপনার কাছে কি মনে হয়?
লেখক: ইমাম ও খতিব, গবেষক।
-এটি