শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


একটি আদর্শ সমাজের রুপরেখা!

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুফতি জাকারিয়া মাসউদ।।

পবিত্র কুরআন মাজিদে ইরশাদ হয়েছে, আমি আপনাকে সমগ্র বিশ^বাসির জন্য রহমত স্বরুপ প্রেরণ করেছি। (সুরা আল-আম্বিয়া, আয়াত ১০৭) আল্লাহ তায়ালা বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে যে, সারা জগতের জন্য শান্তির বাতাস প্রবাহিত করার উদ্দেশ্যে এ ধরায় প্রেরণ করেছেন তা তাঁর বাণী থেকেই প্রমাণ পাওয়া যায়।

আর বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও নিজের পরিচয় দিয়ে বলেছেন, আমি শিক্ষক হিসেবে প্রেরিত হয়েছি। আমি উত্তম আদর্শ শিক্ষা দেওয়ার জন্য প্রেরিত হয়েছি। (বুখারী, মুসলিম) সুতরাং ঠিক তাই তিনি করে গেছেন, যা তাঁর আগমনের উদ্দেশ্য ছিল। যার প্রমাণ ছোট থেকেই লক্ষ্য করা যায়। আজ সর্বত্র সংস্কারের পরিকল্পনা থাকলেও নাই বাস্তব সম্মত কর্মপদ্ধতি। তাইতো কোনভাবেই সমাজ মাদক, র্ধষণ ও অপরাধ মুক্ত হচ্ছেনো। আসুন ফলো করি তার আদর্শ যার প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল স্বার্থক ও সফল। শিক্ষা নিবো তার থেকে যিনি ছিলেন মানবতার শিক্ষক। নিম্নে তার সমাজ পরিবর্তনের রুপরেখা দৃষ্টান্ত মুলক আলোকপাত করা হলো।

দুধমাতার কোলে নিষ্ঠার শিক্ষা: বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মা হালিমার দুধ পান করেন তখনই নিজের দুধভাইয়ের প্রতি ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করে নিষ্ঠার শিক্ষা দিয়ছেন। হযরত হালিমাতুস সাদিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেন যে, বিশ^নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রথম দিন যে স্তন থেকে দুধ পান করেছিলেন, যতদিন দুধপান করেছেন ঠিক একই স্তন থেকে পান করেছেন। কখনও অপর স্তন থেকে দুধ পান করেননি। কারন তার সাথে আরেকজন ভাই ছিল তার জন্য রেখে দিতেন। এভাবেই তিনি শিশুকালিন নিষ্ঠার শিক্ষা দিয়েছেন।(তারিখুল ইসলাম)

ঐতিহাসিক সমাধান: বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাত্র ৩৫ বছর ২ মাস বয়সে সমগ্র আরবের সকল গোত্রের মধ্যেকার আশু-রক্তক্ষয়ী সংঘর্র্ষের ঐতিহাসিক সমাধান করে সারা আরবে প্রশংসার পাত্রতে রুপান্তরিত হন। অর্থাৎ সে সময় মক্কায় বন্যার কারনে কাবা ঘর ভেঙ্গে গিয়েছিল। তাই আরবের সকল গোত্রের অংশগ্রহনের মাধ্যমে কাবা ঘর পুনঃসংস্কার এর কাজ করার উদ্যেগ গ্রহন করা হয়। এবং যথারিতি কাজ সম্পন্ন হয়ে যখন হাজরে আসওয়াদ নির্ধারিত স্থানে পুনঃস্থাপনের সময় হলো তখন বিবাদ শুরু হলো।

কেননা কাজটি ছিল অতি সম্মানের, আর সকল গোত্র চাচ্ছিল এ সম্মানের কাজটি তারা করবে যার ফলে প্রায় সংঘর্ষ লাগার উপক্রম হলো। ইতিমধ্যে কুরাইশের একজন বয়োবৃদ্ধ ব্যাক্তি ঘোষনা দিলেন, এই কাবা ঘরের দরজা দিয়ে যে ব্যাক্তি সর্বপ্রথম প্রবেশ করবে সে যে সিদ্ধান্ত দিবে তা সকলে মেনে নিতে হবে। সকলে মোটামুটি রাজি হয়ে গেল। সকলে দৃষ্টি রাখলো দরজার দিকে হঠাৎ করে দেখা গেল প্রবেশ করছেন মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ। সকলে এবার এক বাক্যে বলে উঠলো হ্যাঁ এই ব্যক্তির সিদ্ধান্ত মেনে নিতে আমাদের কোন সমস্যা নাই।

বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত প্রদান করে সকলের দিলে স্থান করে নিলেন। তাহলো বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজের চাদর বিছিয়ে নিজ হাতে হাজরে আসওয়াদ উঠিয়ে চাদরের উপরে রাখলেন। তারপর সকর গোত্রের একেকজন প্রতিনিধিকে বললেন চাদর ধরে দেওয়ালের কাছে নিয়ে যেতে। সকলে চাদর ধরে যথাস্থানে নিয়ে গেলে বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজ হাতে তুলে নির্দিষ্ট স্থানে স্থাপন করলেন। একদিকে সকল গোত্রের লোকের অংশগ্রহনের কারনে সবাই আনন্দিত হলো। অপরদিকে বিশ^নবীর (সাঃ) হাতে বিশে^র সম্মানিত পাথর খানা যথাস্থানে স্থাপিত হলো। আর আরব জাতী রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ থেকে রক্ষা পেল। (তারিখুল ইসলাম)

শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য হিলফুল ফুযুল গঠন: বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমন সময় পৃথিবীতে আগমন করেন, যখন সারা আরব লুট-তরাজ, খুন, রাহাজানি, ধর্ষন, মাদক আর নির্যাতনে ভরা ছিল। তিনি আদর্শ সমাজ গঠনের লক্ষ্যে বড় বড় গোত্রের লিডারদেরকে সাথে নিয়ে একটি শক্তিশালি কমিটি (সংগঠন) গঠন করেন। যা আজও হিলফুল ফুযুল নামে পরিচিত।

সে সময় এ সংগঠনে অংশ নেয়, বনু হাশিম, বনু মুত্তালিব, বনু আসাদ, বনূ যাহরাহ ও বনূ তামিম সহ আরও কিছু শক্তিশালি গোত্র। সকলে মিলে সংগঠনের লক্ষ্য স্থির করে, ১। আমরা দেশ থেকে নিরাপত্তাহীনতা দূরীবূত করবো। ২। আমরা মুসাফির (পরদেশী) দেরকে সংরক্ষন করবো। ৩। আমরা দরিদ্রদেরকে সাহায্য করবো। ৪। আমরা বড়দেরকে ছোটদের উপর অন্যায় অত্যাচার করা থেকে বাধা প্রদান করবো। এভাবেই শুরু করেন বিধ্বংসীত আরব জতীকে আদর্শ জাতীতে রুপান্তরের কার্যক্রম। তারপরে যখন তিনি নবুয়ত প্রাপ্ত হলেন তখন মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত ওহীয়ে এলাহীর মাধ্যামে আরব জাতীর আমুল পরিবর্তন করে সোনার জাতীতে রুপান্তরিত করলেন। নবুয়ত প্রাপ্তীর পরের কার্যক্রমের মধ্যে কিছু উল্যেখযোগ্য বিষয় আলোচনা করার চেষ্টা করছি।

নারী ও শিশুর যথার্থ মর্যাদা প্রদান: তখন নারী ও শিশু নারীদের সাথে করা হতো অমানবিক নির্যাতন। যা ইসলাম মুসলমান বা কোন ধর্ম কেন যে কোন মানুষের কাছেই ছিল অন্যায়। কিন্তু তা ছিল তাদের জন্য সচারচর সহজ ব্যপার অর্থাৎ নারীরা ছিল নিছক ভোগ্যসামগ্রী বা বিনোদনের বস্তু। আর কি আশ্চর্য যাদেরকে বিনোদনের জন্য ব্যবহার করবে তারাই যখন শিশু নারী হয়ে নিজের ঘরে জন্ম নেয় তাকে করে জীবন্ত হত্যা। এটি কোন দিক থেকেই বিবেকে ধরে না এটি কতখানি অপরাধ। বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইসলাম নিয়ে নবী হিসেবে আগমন করার পরে উভয় প্রকারের নারীদের জন্য সর্বচ্চ সম্মানের জায়গাটি প্রদান করলেন। বিশ্বনবী ঘোষণা করলেন যার তিনটি কন্যা সন্তান হবে সে খুশি মনে তাদের লালন পালন করে সঠিক পাত্রে বিবাহ প্রদান করলে আল্লাহ তায়ালা তার জন্য তিনটি জান্নাত বরাদ্দ করে দিবেন। সুবহানাল্লাহ!

সাহাবারা খুশি হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রসুলুল্লাহ যদি কারও দুইটি কন্যা হয় তার? বিশ^নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তার জন্য দুইটি জান্নাত। আর যার একটি কন্যা সন্তান হবে তার জন্য একটি জান্নাত। ( বুখারি, মুসলিম) অপরদিকে মা-দের জন্য ঘোষনা করলেন আরও মর্যাদার স্থান। বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাহ বলেন, জান্নাত তোমাদের মায়ের পায়ের নিচে। সুবহানাল্লাহ! (বুখারি, মুসলিম) অর্থাৎ মাকে খুশি রাখতে পারলে তোমার জন্য জান্নাত ওয়াজিব। প্রিয় পাঠক/পাঠিকা, একবার ভাবেনতো কোন সময় বিশ^নবী এ ঘোষনা করলেন? যখন সমাজ পতিরা নারীদের ভোগের সামগ্রী বানিয়ে রেখেছে তখন। আর এখন যখন বিশ্বনবীর এ আদর্শ মোতাবেক সমাজ ব্যাবস্থার কথা বলতে যাই তখন নারীরা মনে করে ইসলাম আমাদের সমান অধিকার দেয়নি। প্রিয় বোন যে নবী তোমাকে ভোগ থেকে তুলে সম্মানের আসন দিল তাকে যদি পছন্দ না হয় আমার কিছু বলার নাই । তবে ঠান্ডা মাথায় একবার ভাবার আহবান করলাম। যে সকল নারীবাদি পুরুষেরা তোমার পক্ষে স্লোগান দেয় মুলত সে তোমাকে আবার ভোগের লালসায় ঘুরে। নিজের অবস্থান বুঝো আগে, সমান নয় বরং পুরুষের তুলনায় তোমার অধিকার বেশি।

সুদ প্রথা নিষিদ্ধ করণ: বিশ^নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন দেখলেন, আরবের সামাজিক অবস্থার অবনতির পিছনে মুল কারন হলো, অর্থনৈতিক যথেচ্ছা ব্যবহার। আর তখনকার আরবের অর্থ উপার্জনের মুল মাধ্যম ছিল অবৈধ পদ্ধতিতে উপার্জন। তার মধ্যে সুদ প্রথার প্রচলন ছিল সবথেকে বেশি ব্যাপক। আর এই সুদের কারনে কেউ হয়ে যেত বড় ধনী আর কেউ শোষনের বেড়াজালে পরে নিঃশেষ হয়ে যেত। ইচ্ছেমত জুলুম করতো ধনীরা গড়ীবদের উপর। তাই বিশ^নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দীপ্তকন্ঠে ঘোষনা করলেন, মহান আল্লাহ তায়ালা সুদকে হারাম করেছেন আর ব্যবসাকে হালাল করেছেন। (সুরা আল বাকারা, আয়াত নং ২৭৫)

মাদক, জুয়া ও ব্যভিচার দমন: সমাজকে ঢেলে সাজাতে বিশ^নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাল্লাম লক্ষ্য করলেন যে, সবথেকে বেশী অপরাধ সংঘটিত হয় মদ ও জুয়ার আসরে তাই বিশ^নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সমাজ বিনির্মাণের লক্ষ্যে ঘোষণা দিলেন, মহান আল্লাহর নির্দেষ। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ওহে মুমিনগন! নিশ্চয়ই মদ, জুয়া, প্রতিমা ও ভাগ্য নির্ণায়ক তীর এসব শয়তানের কারসাজী ঘৃন্য বস্তু। সুতরাং তোমরা এসব বর্জন যাতে তোমরা সফল হতে পারো।(সুরা মায়িদা আয়াত ৯০) এক হাদিসে বিশ^নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘোষণা করেন, নেশা জাতীয় যেকোন দ্রব্যই মাদক। আর যাবচতীয় মাদকই হরাম।

যে ব্যক্তি দুনিয়াতে মাদক সেবন করে অতঃপর নেশা অবস্থায় মারা যায় তওবা করার সুযোগ না পায় , আখিরাতে সে মদপান করা থেকে বি ত হবে। এছাড়াও বিভিন্ন হাদিসে ধাপে ধাপে আল্লাহর নির্দেষ মোতাবেক মদকে হারাম পর্যন্ত ঘোষণা করেন। এক পর্যায়ে তা সমাজ থেকে তা দুরীভুত হয়ে যায়। কিন্তু দুঃখজনক হঔের সত্য যে আমাদের সমাজেও মাদক নিষিদ্ধ , তবে তা ব্যক্তি কেন্দ্রীক উৎপত্তির জায়গা চালু খাওয়া নিষেধ। এভাবে নয় আসুন কোরআনের পদ্ধতিতে মাদক মুক্ত; সমাজ গড়ি।

সৎ পথে স্বাবলম্বী হওয়ার প্রতি উৎসাহ প্রদান: আরব সমাজ যত অন্যায়ের মধ্যে লিপ্ত ছিল তার মধ্যে উল্লেখ যোগ্য অপরাধ হলো লুটতরাজ। আর এই অপরাধকারিদের ধরন হলো, বেকার সমাজ। তাই বেকারত্বের অভিসাপ থেকে বাঁচতে কর্মঠ মুখি হতে বিশ^নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সত্যবাদি ব্যবসায়ীদের ভুয়সী প্রশংসা করে জান্নাতী বলে ঘোষনা করলেন। যাতে সকলে কর্মমুখী হয় আর অপরের সম্পদের প্রতি লোভ না করে। আবু হুরায়রা রাদিআরøাহু আনহু; হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেেেছন, সৎ পথে ফকির ও মিসকিনদের জন্য উপার্জন কারী জিহাদরত ব্যাক্তির মত। (ইবনে মাজাহ) এছাড়াও কুরআন ও সুন্নাহয় হালাল উপার্জনের প্রতি ব্যপকভাবে উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে।

অপকর্ম রোধে ব্যক্তির ভুমিকা: সমাজে কোন আইন বা কোন গোষ্ঠীর দ্বারা একক ভাবে কোন অন্যায় দুর করা সম্ভবপর নয়। এখানে যেমন আইন দরকার তেমনি প্রত্যেকটি স্থান থেকে ব্যক্তিগত ভুমিকা খুবই প্রয়োজন। নিজ নিজ দ্বায়িত্বে যদি সকলে অপকর্ম ছেড়ে দেয় তাহলে অতি সহজে সমাজ কলুষ মুক্ত হয়ে যাবে। অন্যায়ের বিরোধিতা করা প্রত্যেকের দ্বায়িত্ব।

বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তোমরা প্রত্যেকেই জিম্মাদার এবং প্রত্যেককেই আল্লাহর দরবারে হিসাব দিতে হবে।(বুখারি মুসলিম) সুতরাং শুধু একটি গোষ্ঠীর উপ সমাজ সংস্কারের দ্বায়িত্ব দিয়ে রাখলে তা মোটেও যুক্তিসঙ্গত নয় । বরং সকলকেই এগিয়ে আসতে হবে। সব ধরনের অন্যায়ের বিরোধীতা করে, ন্যায় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটি আদর্শ সমাজ গঠন করতে হবে। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সে তৌফিক দান করুন। আমিন

লেখক: সাংবাদিক, ইসলামি গবেষক ও কলামিষ্ট।

-এটি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ