মুফতি কামরুজ্জামান।।
পৃথিবীর ইতিহাসে রবিউল আওয়াল একটি ঐতিহাসিক মাস। বিশিষ্ট গবেষক ও ঐতিহাসিক আল্লামা সুলাইমান মানসুরপুরী এবং আল্লামা মাহমুদ বাশার-এর গবেষণা অনুযায়ী ৫৭১ খৃষ্টাব্দের ২০/২২ এপ্রিল মোতাবেক আরবী রবিউল আওয়াল মাসেই রাসুল সা. দুনিয়ার বুকে আগমন করেন আর এ ব্যাপারে সকল ঐতিহাসিকগণ-ই একমত। তবে কোন তারিখে তাঁর জন্ম হয়েছে সে ব্যাপারে ৩,৮,৯,১২ সহ বিভিন্ন মত রয়েছে। তবে রবিউল আওয়ালের ১২ তারিখকেই অধিকাংশ ঐতিহাসিক আলেম অগ্রাধিকার দিয়েছেন।
রাসুল সা. হলেন অন্ধকারাচ্ছন্ন এ ধরাধামের জন্য প্রজ্জল এক আলোকবর্তিকা স্বরূপ। তাঁর প্রকাশ রূপ হল দুইটি। একটি হল তার সৌন্দর্যের প্রকাশ। এটা হয়েছিলো মাতৃগর্ভ থেকে ধরণীর বুকে প্রিয় নবী সা. এর শুভাগমনের মাধ্যমে। এটা ইসলামের শরীয়াতে মিলাদুন্নবী বা নবীর জন্ম হিসেবে প্রসিদ্ধ। অপরটি হচ্ছে-রাসুল সা. এর কামাল তথা গুনাবলীর পূর্ণ বিকাশ। এটা হয়েছিলো জন্মের পর থেকে সুদীর্ঘ ৪০ বছর পর নবুওয়াত লাভের মাধ্যমে। ইসলামী দৃষ্টি কোনে এটি সীরাতুন্নাবী হিসেবে প্রসিদ্ধ।
রাসুল সা. এর মিলাদ তথা জন্ম বৃত্তান্ত ও তৎসংশিষ্ট বিষয়ে উম্মতের অনুসরণীয় কিছুই নেই। অনুসরণীয় হল রাসুল সা. এর সীরাত। কারণ রাসুল সা. এর জন্ম কখন হয়েছিলো, কিভাবে হয়েছিলো, জন্মকালীন সময়ে কি কি অলৌকিক ঘটনা ঘটেছিলো, তার অবয়ব আকৃতি কেমন ছিলো এগুলো যদি কোন ব্যক্তি অনুসরণ করতে চায় তাহলে সেটা আদৌ সম্ভব নয়। তবে রাসুল সা.এর জন্ম সংক্রান্ত ও তার অবয়ব সম্পর্কে আলোচনা করা অত্যন্ত বরকত ও ফযীলতের বিষয়। এতে বহু কল্যাণ নিহিত রয়েছে। মহান আল্লাহ তা’য়ালা কোরআনে এরশাদ করেন, “অর্থাৎ নিশ্চয়ই আল্লাহর রাসুলের মধ্যে তোমাদের জন্য রয়েছে উত্তম আদর্শ। যে আল্লাহ কে এবং আখেরাত দিবসের আশা রাখে”। (সুরা আহযাব-২১)
অপর আয়াতে আল্লাহ তা’য়ালা বলেন “অর্থাৎ রাসুল সা. তোমাদেরকে যা দিয়েছেন তা আকড়ে ধরো এবং যে বিষয় নিষেধ করেছেন তা থেকে বেঁচে থাকো”। (সুরা হাশর-৭) এ মর্মে কোরআনে এরশাদ হয়েছে, “অর্থাৎ হে রাসুল আপনাকে বিশ্ববাসীর জন্য কেবল রহমত স্বরুপই প্রেরণ করেছি”। (সুরা আম্বিয়া-১০৭) তাই সমস্ত মাখলুকের জন্যই তিনি ছিলেন করুনার আধার।
হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে রাসুল সা. বলেন, নবুওয়াতের পূর্বে যখন আমি রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতাম দুপাশের গাছ ও পাথর আমাকে “আস্সালামু আলাইকা ইয়া রাসুলুল্লাহ” বলে সালাম নিবেদন করত। সুতরাং রাসুল সা. এর জীবনেই রয়েছে আমাদের জন্য সর্বোত্তম আদর্শ। রাসুল সা. এর আদর্শকে জীবনে বাস্তবায়ন করলেই সফলতার মুখ দেখা যাবে। রাসুল সা. এর সাহাবায়ে কেরাম তাঁর আদর্শ অনুসরণ ও বাস্তবায়ন করেই এ বিশ্বকে চূড়ান্ত সফলতার মুখ দেখিয়ে গিয়েছেন।
হযরত উমর ফারুক রা. যিনি অর্ধজাহানের অধিপতি ছিলেন। শাইখুল ইসলাম আল্লামা ত্বাকি উসমানী বলেন, হযরত উমর রা. যে বিশাল ভূখন্ড শাসন করতেন সেখানে বর্তমান বিশ্ব মানচিত্রের ৫০টি রাষ্ট্র রয়েছে। একদা আমিরুল মুমীনিন হযরত উমর রা. তার শাসন কালে সহচরদের নিয়ে কোন এক গিরিপথ দিয়ে অতিক্রম করছিলেন, হঠাৎ তিনি কোন এক পাহাড়ের পাদদেশে থেমে নিজেকে সম্বোধন করে বলছিলেন, হে উমর! তোমার কি মনে আছে তুমি কি ছিলে ? তুমি তো সামান্য উটের রাখাল ছিলে। এখানে উট চড়াতে। উটের পেশাবে তোমার দুই পা ভিজে যেতো।
উট চড়ানোর যোগ্যতাটুকু তোমার ছিলোনা। আজ তুমি অর্ধজাহানের খলিফা হয়েছো। এসব কিছু রাসুল সা. এর সোহবতের বরকতে হয়েছে। তার আদর্শ গ্রহনের কারণেই গোটা বিশ্ব তোমাদের পদচুম্বন করছে। সাহাবায়ে কেরামের প্রত্যেকেই রাসুল সা. এর সুন্নত অনুসরণের ব্যাপারে ছিলেন খুবই লালায়িত। ভয়-নিন্দা কোন কিছুকেই তাঁরা পরওয়া করতেন না।
হুদাইবিয়ার সন্ধির জন্য রাসুল সা. হযরত উসমান রা. কে মক্কার মুশরিকদের কাছে প্রেরণ করলেন। পূর্বে থেকেই মক্কায় তার বেশ গ্রহণযোগ্যতা ছিলো। প্রথমে তিনি তার চাচাতো ভাইয়ের গৃহে গিয়ে অবস্থান করলেন। তার চাচাতো ভাই যখন তার দিকে দৃষ্টিপাত করলেন তখন দেখতে পেলেন-তার কাপড় বা পায়জামা পায়ের গোড়ালী ও হাটুর মাঝ বরাবর রয়েছে। তৎক্ষণাৎ তিনি হযরত উসমান রা. কে বললেন, তোমার যে বেশভূষা তাতে তো মক্কার নেতৃস্থানীয় লোকেরা তোমার কথার কোন গুরুত্ব প্রদান করবেনা।
কারণ তুমি তোমার কাপড়কে “নিসফে সাক” বরাবর উঁচু করে পরেছ। অথচ তুমি জানো, আরবের লোকেরা যে তার কাপড়কে অহমিকাবশত যত নিচে ঝুলিয়ে পরিধান করে তাকে তারা ততো বেশি পছন্দ করে। প্রতিউত্তরে হযরত উসমান রা. বলেন, আমার কাপড়কে নিচু করে পড়বো না। কারণ এটা আমার রাসুলের সুন্নত।
এমর্মে অপর একটি ঘটনা ইতিহাস গ্রন্থে বিদ্যমান রয়েছে। তৎকালীন এক পরাশক্তি কিসরার দরবারে আলোচনার জন্য নিয়ে হযরত হুযাইফাতুল ইয়ামান রা. ও হযরত রিবয়ী বিন আমের রা. কে প্রেরণ করা হল। তারা যখন কিসরার মেহমানখানায় প্রবেশ করবেন তখন তাদের কে বলা হল ভিতরে প্রবেশ করতে তোমাদের এ পোষাক পরিবর্তন করে আমাদের পোষাক পড়ে যেতে হবে। তারা এ দাবীকে প্রত্যাখ্যান করে বললেন এটা আমাদের ধর্মীয় পোষাক রাসুলের সুন্নত। সুতরাং আমরা কিছুতেই এটা পরিবর্তন করবো না।
পরে রাজদরবারের লোকেরা বাধ্য হয়ে তাদেরকে ঐ পোষাকেই প্রবেশ করার অনুমতি দিলো। অতপর যখন দস্তরখানে মেহমানদারীর পালা আসল তখন তারা সুন্নাত তরীকায় দস্তরখানে বসলেন। খাবারের মাঝে হযরত হুযাইফা রা. এক আশ্চর্যজনক ঘটনার অবতরণা করলেন। খাবারের লুকমা গ্রহনের মাঝে অনাকাংখিত কিছু খাবার নিচে পড়ে গেলো। পরক্ষনে হযরত হুযাইফা রা. রাসুল সা. এর সুন্নত মুতাবিক পতিত খাবারগুলো থেকে ময়লা পরিষ্কার করে তুলে নিতে উদ্বত হলেন। “কেননা রাসুল সা. বলেন তোমাদের কারো হাত থেকে যখন খাবারের কোন লুকমা পড়ে যায় তাহলে সে যেন তার থেকে ময়লা দূর করে তা উঠিয়ে নেয় এবং শয়তানের জন্য যেন রেখে না দেয়।
আর তোমাদের কেউ যেন খাবারের পরে হাত রুমালে না মুছে বরং সে যেন তার আঙ্গুলগুলো চেটে খায়। কারণ সে যানে না তার খাবারের কোন অংশের মধ্যে বরকত রয়েছে। হতে পারে পতিত লুকমার মাঝেই বরকত রয়েছে।” মুসনাদে আহমাদ-১৪২৫৬ হযরত হুযাইফা রা. যখন তার থেকে পরে যাওয়া লুকমাটি উঠিয়ে নিতে উদ্বত হলেন তখনই তার এক সঙ্গি হাত চেপে ধরলেন এবং বললেন তুমি এ কি করছো? তুমি ইরানের বাদশাহ বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি কিসরার দরবারে রয়েছো। তুমি যদি এ কাজ করো তাহলে এদের কাছে আমাদের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে।
তখন হযরত হুযাইফা রা. সকলকে অবাক করে দিয়ে উত্তর দিলেন আমি এ নির্বোধ অবুঝদের কারণে রাসুল সা. এর সুন্নতকে ছেড়ে দিবো? পরবর্তিতে ইরানের সৈনিকরা তাদের কাছে উপস্থিত হয়ে তাচ্ছিল্যের সুরে বলল তোমরা তো আমাদের সাথে যুদ্ধ করবে, দেখি তোমরা কোন তরবারি দিয়ে যুদ্ধ করবে? হযরত রিবয়ী বিন আমর রা. তরবারি বের করলেন তার তরবারী দেখে ইরানের সৈনিকদের পছন্দ হচ্ছিলো না। তৎক্ষণাত হযরত রিবয়ী বিন আমর রা. বললেন তোমরা তো তরবারি দেখেছো তরবারি বহনকারীর বাহু দেখনি। তখন তারা তাদের সবচেয়ে মজবুত ঢালের ব্যাপারে ধারণা ছিলো কোন আঘাতেই এটার কোন ক্ষতি হবে না। হযরত রিবয়ী বিন আমর রা. তার তরবারি দিয়ে প্রচন্ড এক আঘাতে ঢালটি দ্বিখন্ডিত করলেন। এ সংবাদ শুনে স¤্রাট কিসরা তাদেরকে রাজদরবারে তলব করলেন ভিতরে প্রবেশ করে তারা দেখতে পেলেন সম্্রাট একা রাজসিংহাসনে বসে আছেন।
আর অন্য সকলে তার সম্মানার্থে মাথা ঝুঁকিয়ে দাড়িয়ে রয়েছে। সাহাবিরা লক্ষ্য করলেন, এ কাজটি রাসুল সা. এর সুন্নাহর সাথে সাংঘর্ষিক। “কেননা রাসুল সা. বলেন যে ব্যক্তি চায় এবং খুশি হয় মানুষেরা তার সম্মানার্থে ঠায় দাড়িয়ে থাকুক তাহলে সে যেন তার অবস্থান স্থল জাহান্নামে নির্ধারণ করে নেয়।” তিরমীযী-২৬৯৮ তাই তারা বললেন সম্্রাট হয়ত আমাদের জন্যও বসার ব্যবস্থা করুন অথবা আপনি নিজে দাড়িয়ে যান। আমরা আপনার সাথে দাড়িয়ে কথা বলি। তখন সম্্রাট ক্রোধান্বিত হয়ে তার সৈন্যদেরকে বলল ওদের সাথে কোন আলোচনা নেই। ওদের মাথায় এক টুকরি মাটি দিয়ে দাও। সাহাবিরা মাটির টুকরি মাথায় নিয়ে বললেন হে স¤্রাট তুমি যেনে রেখো ইরানের মাটি তুমি আজ আমাদের দিয়ে দিয়েছো।
ইরানের সম্রাট কুসংস্কারে বিশ্বাসী ছিলো। সে তৎক্ষণাৎ মাটির টুকরি ফেরত নেয়ার জন্য লোক পাঠালো। কিন্তু তারা সফল হলো না। আপনারা অনেকেই হয়ত হযরত হাফেজ্জী হুজুর রহ. কে চিনেন। তিনি উচু পর্যায়ের এক বুজুর্গ ছিলেন। শেষ বয়সে তাকে যারা দেখেছেন তাদের মনে থাকার কথা সব সময় তিনি মাথা নিচু করে শাহাদাত আঙ্গুলি উচু করে তাসবীহ হাতে হুইল চেয়ারে জিকির করতে থাকতেন। তৎকালিন সময় ইরাক-ইরান যুদ্ধ চলছিলো। অনেকেই এ যুদ্ধ বন্ধ করার চেষ্টা করেছেন। হযরত হাফেজ্জী হুজুরও সে জন্য ইরাক ও ইরানে সফর করেছিলেন।
তিনি লন্ডন, ইরান, সৌদি আরব ও ইরাকে সফর করেছিলেন। এজন্য সর্বপ্রথম যখন তারা লন্ডনে একটি সেমিনারের জন্য সফর করলেন, তখন হযরত হাফেজ্জী হুজুর রহ. এর নেতৃত্বে একটি দল সফর করলেন। সফরে হযরত হাফেজ্জী হুজুর রহ. এর সঙ্গে যারা ছিলেন। সকলেই স্বাভাবিক সুন্নতি পোষাক পড়ে লন্ডনে সফর করলেন। তবে সাথে অপর একজন দাড়ি-টুপি ওয়ালা ছিলো সে চিন্তা করলো যেহেতু লন্ডনে এসেছি তাদের পোষাক পড়ে সেমিনারে যোগদান করলে হয়ত এতে আলাদা সম্মান পাওয়া যাবে। কিন্ত ঘটনা সম্পূর্ণ বিপরিত ঘটে গেলো। লন্ডন এয়ারপোর্টে নামার পরে সুন্নতি পোশাকে যারা ছিলেন চেকপোষ্টে অবস্থানরত দায়িত্বশীলগণ তদেরকে সহজেই ছেড়ে দিলো। কিন্তু ঐ লোকটি বড় বিড়ম্বনার শিকার হল।
এয়ারপোর্টে বিভিন্ন চেকের কারণে তাকে প্রায় ৪-৫ ঘন্টা অপেক্ষা করতে হল। পরে লোকটি যখন সফরকারীদের কাছে উপস্থিত হল তখন বলল আমি আপনাদের মত সুন্নতি লেবাস না পরে বিরাট ভুল করেছি। এজন্যই এত হয়রানির শিকার হয়েছি। “রাসুল সা. এরশাদ করেছেন তোমরা ততোক্ষণ পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ মুমিন হতে পারবেনা যতক্ষন পর্যন্ত আমি তোমাদের পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি ও সমস্ত মানুষের চেয়ে তোমাদের কাছে অধিক প্রিয় না হবো।” বুখারী-১৪ সুতরাং আজ বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের লাঞ্চনার মূল কারণ হচ্ছে রাসুল সা. এর আদর্শ পরিত্যাগ করা।
আজ আমরা প্রতিটি ক্ষেত্রে ইহুদি, খৃষ্টান, মূর্তিপূজারীদের অনুসরণ করছি। তাদের দালালী করছি। এত কিছু করেও কোন ফলাফল হচ্ছে না। আমরা মার খেয়েই যাচ্ছি, লাঞ্চিত হয়েই চলছি। এর থেকে বেরিয়ে আসার একমাত্র পথ হচ্ছে রাসুল সা. এর আদর্শকে আমাদের মাঝে পরিপূর্ণরুপে বাস্তবায়ন করা। মহান আল্লাহ তা’য়ালা আমাদের সকলকে পরিপূর্ণ ভাবে রাসুলের আদর্শ ধারণ করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক: জামিয়া আরাবিয়া শামসুল উলুমের প্রিন্সিপাল ও শাইখুল হাদিস, ফরিদপুর চকবাজার জামে মসজিদের খতিব।
-এটি