মুফতি তারিকুজ্জামান তারিক, মিশর
একটি শিল্পীগোষ্ঠীর ব্যবহৃত ‘রুহানি সাহাবা’ শব্দের ব্যবহার নিয়ে বিতর্ক ক্রমশই বাড়ছে। ছোট থেকে মিডল স্টেপ অতিক্রম করে এখন বড়রাও এটা নিয়ে কথা বলছে। পক্ষে-বিপক্ষের আলোচনায় বিষয়টি নিয়ে সবাই এখন বেশ সরব। এ ব্যাপারে নীরব থাকতে চাইলেও বিষয়টি বেশ স্পর্শকাতর মনে হওয়ায় এবং ভবিষ্যৎ-প্রজন্মের কাছে এটা হুজ্জত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় এ ব্যাপারে কিছু কথা আরজ করতে চাই। উদ্ধৃতিনির্ভর নয়, আজ শুধু সাধারণভাবে কয়েকটি বিষয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করব। এরপর যদি প্রয়োজন মনে হয়, তাহলে বড় পরিসরে দলিলসমৃদ্ধ প্রবন্ধও রচনা করব ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ আমাদের কথায় সর্বদা রাশাদ ও সাদাদ দান করুন।
প্রথমত, ‘সাহাবা’ শব্দটি ‘সাহাবি’ এর বহুবচন। শরয়ি দৃষ্টিকোণ থেকে এটি অত্যন্ত সম্মানিত ও স্পর্শকাতর একটি পরিভাষা। মর্যাদার দিক থেকে পুরো মানব-ইতিহাসে ‘আম্বিয়া’ এর পরই ‘সাহাবা’ এর অবস্থান। উম্মাহর সকল আলিম এ ব্যাপারে একমত যে, উম্মতের কারও পক্ষে সাহাবিদের মর্যাদার ধারেপাশেও যাওয়া সম্ভব নয়। কেউ সাহাবি বলে সাব্যস্ত হয়ে গেলে তিনি সমালোচনার ঊর্ধ্বে চলে যান। শ্রেষ্ঠ তাবিয়িরা পর্যন্ত অকুণ্ঠচিত্তে স্বীকার করতেন যে, তাঁদের সারাজীবনের আমল মিলেও একজন নিম্নস্তরের সাহাবির পায়ের ধুলির সমান হবে না। চিন্তা করতে পারেন, সাহাবিদের মর্যাদা কতটা ঊর্ধ্বের? অনেক হাদিসেও সাহাবিদের গুরুত্ব ও মর্যাদার কথা বর্ণিত হয়েছে। তাই এ শব্দটির ব্যবহারে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন আবশ্যক।
দ্বিতীয়ত, সাহাবি অর্থ সোহবতপ্রাপ্ত, সংশ্রবপ্রাপ্ত। যিনি ইমান এনে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সোহবত পেয়েছেন-একমুহূর্তের জন্য হলেও- এবং ইমান নিয়েই মৃত্যুবরণ করেছেন, তিনিই সাহাবি হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন। সাহাবি হওয়ার জন্য ইলম থাকার প্রয়োজন ছিল না, কেবল রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সোহবতটাই যথেষ্ট। বুঝা গেল, সাহাবি হয় ব্যক্তি-সংশ্লিষ্ট, কোনো বস্তু-সংশ্লিষ্ট নয়। বলা হয়, তিনি অমুকের সাহাবি অর্থাৎ তিনি অমুকের সোহবতপ্রাপ্ত। একথা বলা ভুল যে, তিনি ইলমের সাহাবি বা তিনি আমলের সাহাবি। ‘সাহাবি’ শব্দের অর্থের দিকে খেয়াল না করে নাশিদে বলা হয়েছে, ‘আমরা ইলমে নববির সাহাবা’। শাব্দিক ও পারিভাষিক উভয় দৃষ্টিকোণ থেকেই এটা ভুল ব্যবহার।
তৃতীয়ত, মাজাজ বা রূপক অর্থ ইচ্ছে হলেই ব্যবহার করা যায় না। ইদানিং অনেকেই ‘রুহানি সাহাবা’ পরিভাষাটিকে রূপক অর্থে সঠিক প্রমাণের প্রয়াস চালাচ্ছেন। অথচ যেকোনো দিক থেকে মিল থাকলেই সেখানে রূপক অর্থ ব্যবহার সঠিক হয়ে যায় না। যদি তাই-ই হতো, তাহলে তো বিভিন্ন প্রাণীর ভালো দিকগুলোর সাদৃশ্য চিন্তা করে প্রশংসাস্থলে মানুষকে ‘কুকুর’, ‘বিড়াল’, ‘সাপ’, বিচ্ছু ইত্যাদি অভিধায় অভিহিত করা যেত; অথচ এটা সর্বমহলে অস্বীকৃত একটা ব্যাপার। বাস্তবতা হলো, রূপক অর্থ ব্যবহারের জন্য মূল বৈশিষ্ট্যের সাদৃশ্যের বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে, যেকোনো মিল বা সাদৃশ্যকে নয়। সাহাবিদের মূল বৈশিষ্ট্য হলো, তাঁরা আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সোহবতপ্রাপ্ত। তাঁরা মুমিন অবস্থায় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে দেখেছেন বা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁদেরকে দেখেছেন। তাহলে এখানে মূল বৈশিষ্ট্য হলো, দেখা ও সোহবত পাওয়া, ইলমে নববি থাকা নয়।
সাহাবিদের মধ্যে তো কতজন ছিলেন, যারা খুব কমই জানতেন, কিংবা ইমান ছাড়া তাঁর আর কিছু জানার সুযোগই হয়নি, তবুও তাঁরা সাহাবা। আর উম্মতের অসংখ্য আলিমের অগাধ ইলম থাকা সত্ত্বেও তারা সাহাবি নন। তাই শুধু দীনি ইলম থাকার ভিত্তিত্তে কাউকে ‘রুহানি সাহাবা’ বললে তা হবে নিয়ম-বহির্ভূত রূপক অর্থের অপব্যবহার।
চতুর্থত, ‘সাহাবা’ পরিভাষাটি যেহেতু অত্যন্ত মর্যাদাকর ও স্পর্শকাতর পরিভাষা, তাই রূপক অর্থে শব্দটির যত্রতত্র ব্যবহার মানুষের আকিদা-বিশ্বাসে ক্ষতি করতে পারে। কারণ, আজ যদি জোড়াতালি দিয়ে এ শব্দটি ব্যবহারের নানা বৈধদিক তালাশ করা হয়, তাহলে ভবিষ্যতে কেউ যদি কারও ব্যাপারে ‘রুহানি নবি’ দাবি করে এবং এসব জোড়াতালি দেওয়া দলিলাদি পেশ করে, তখন কি এ ফিতনা সহজে নির্বাপিত হবে? বস্তুত এ কারণেই রূপক অর্থ ব্যবহারের নানারকম সুযোগ থাকা সত্ত্বেও ভাষাবিদগণ গণহারে যেখানে-সেখানে রূপক অর্থ ব্যবহার করতে নিষেধ করেন। তাছাড়াও ভাষার একটি স্বীকৃত নিয়ম হলো, প্রয়োজন না হলে শব্দের রূপক ব্যবহার থেকে বেঁচে থাকতে হবে। বিশেষ কোনো প্রয়োজন দেখে দিলেই কেবল রূপক অর্থ ব্যবহার করা উচিত। সঙ্গত কারণেই রূপক অর্থে বলা হলেও ‘রুহানি সাহাবা’ পরিভাষাটি পরিত্যাজ্য।
পঞ্চমত, ইসলাম ও ইসলাম-বিষয়ক কোনো পরিভাষার বিষয়ে প্রথমে খেয়াল করতে হয়, প্রয়োজন ও সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তা সালাফের যুগে ছিল কি না। প্রয়োজন ও সুযোগ থাকা সত্ত্বেও যদি সালাফ তা বলে না থাকেন বা ব্যবহার না করে থাকেন তাহলে অবশ্যই তা আমাদের পরিহার করে চলা কর্তব্য। ‘রুহানি সাহাবা’ পরিভাষা যদি সঠিক ও অনুমোদিতই হতো তাহলে এর প্রথম হকদার ছিলেন, তাবিয়িন, তাবি তাবিয়িন ও আইম্মায়ে মুজতাহিদিন। কিন্ত তাঁদের থেকে কি এ পরিভাষা প্রমাণিত? তাঁদের কারও থেকে নতুন এ পরিভাষার ব্যবহার সুসাব্যস্ত? উত্তর যদি ‘না’ হয়ে থাকে তাহলে অবশ্যই আমাদের সতর্ক হওয়া দরকার। নতুন পরিভাষা চালু করে ফিতনার নবদ্বার উন্মোচন করলে ভবিষ্যতে এটাকে কেন্দ্র করে যদি কোনো ফিতনার আবির্ভাব ঘটে তাহলে পরিভাষাটির আবিষ্কারকরা এর দায়ভার কোনোভাবেই এড়াতে পারবে না।
বি. দ্র. বাংলাদেশের বিশেষ কোনো শিল্পীগোষ্ঠীর ব্যাপারে আমার তেমন কোনো ধারণা নেই, আর না আমার এতে কোনো আগ্রহ আছে। বিকৃত করে বা ভুলভাবে তারা কোনো পরিভাষা ব্যবহার করলে এতে আমাদের তেমন কিছু যায় আসত না। কিন্তু ইস্যুটি যেহেতু আলিমদের মধ্যে চলে এসেছে এবং পরিচিত-অপরিচিত, ছোট-বড় সবাই এ ব্যাপারে অবগত হয়ে গেছে, তাই বিষয়টি আর সাধারণ পর্যায়ে নেই। এখন এ ব্যাপারে কথা না বললে কিংবা এড়িয়ে গেলে এটা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য দলিল হয়ে যেতে পারে। আল্লাহ আমাদের সকল বিদআত বা নবআবিষ্কৃত বিষয় থেকে হিফাজত করুন এবং চলমান ও আশু সকল ফিতনা থেকে দূরে রাখুন।
লেখক: মুহাদ্দিস, লেখক, গবেষক ও ইসলামি চিন্তাবিদ৷
এমডব্লিউ/