মাওলানা লাবীব আবদুল্লাহ
শিক্ষক, খতিব ও কলামিস্ট
তানজিমুল মাদারিস আল কওমীয়া কিশোরগঞ্জ এবং তানজিমুল মাদারিস আদদীনিয়া উত্তরাঞ্চল (বগুড়া জামিল মাদরাসাকেন্দিক) শিক্ষাবোর্ডের দফরত পরিদর্শনে গিয়েছিলাম৷ ইত্তেফাকুল উলামা বৃহত্তর মোমেনশাহীর চৌকস এক প্রতিনিধিদল সরেজমিনে বোর্ডের কার্যক্রম দেখতে গিয়েছিলেন৷ সহযাত্রী হিসেবে ছিলাম আমিও৷ বোর্ডের কর্মকর্তা, জিম্মাদারদের সাথে জীর্ঘ মতবনিময় হয়েছে৷ সরাসরি দেখার সুযোগ হয়েছে বোর্ডের বহুমুখী উদ্যোগ ও আয়োজন৷
তানজিমুল মাদারিস কিশোরগঞ্জ ১৯৮২ সাল থেকে কওমী মাদরাসার শিক্ষা নিয়ে কাজ করছে৷ তবে পরীক্ষাকেন্দ্রক কাজ বেশী৷ ১৯৯৫ সাল থেকে শিক্ষাবিষয়ক কার্যক্রম পরিচালনা করছে তানজিমুল মাদারিসিল আদদীনিয়া আল কওমীয়া (উত্তরাঞ্চল)৷
বোর্ড দুটি ছাড়াও ব্যাক্তিগতভাবে বেফাকুল মাদারিসিল আরবিয়া বাংলাদেশের দফতরে একাধিক বার সরেজমিনে গিয়ে কার্যক্রম দেখেছি৷ কওমী মাদরাসার বোর্ডগুলো ব্যক্তিত্ব, এলাকা এবং মাদরাসাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে৷
বোর্ডগুলোর মাধ্যমে পড়ালেখার কিছুটা উন্নতি হয়েছে৷ বোর্ডের ফলাফল ভালো হলেই সেই মাদরাসায় তালেবে ইলমরা ভর্তির প্রতিযোগিতা করে৷ মেধাবীরা ভীড় করে৷ যেহেতু টিসি পদ্ধতি নেই তাই শত শত মাদরাসার মেধাবী ছাত্ররা তাদের মন মতো মাদরাসায় ভর্তি হচ্ছে৷ উস্তায রাগ করবেন না খুশী হবেন তা তাদের দেখার বিষয় নয়৷ তাদের প্রয়োজন বোর্ডের রেজাল্ট৷ যদিও এই রেজাল্টের বিশেষ কোনো কার্যকারিতা নেই কর্মজীবনে৷ ফলাফল ভালোর জন্য নোট গাইড পড়লেই চলে৷ পরীক্ষার প্রশ্ন সেইসব বাজে গাইডের সাথে মিলও থাকে৷
কওমী মাদরাসা কিতাব পত্র প্রকাশনার কোনো নীতিমালা না থাকায় এক শ্রেণি অসাধু ব্যবসায়ীরা কোটিপতি হচ্ছে তালেবে ইলমদের অভিভাবকদের পয়সায়৷ শুধু দাওরায়ে হাদীসের নোট গাইড ক্রয় করতে খরচ হয় প্রায় বিশ হাজার টাকা৷ মহিলা মাদরাসার ছাত্রীরা এইসব আজেবাজে নোট গাইড ক্রয়ে অগ্রসর৷ যেহেতু উর্দু পারে না তাই উর্দু কিতাব বাদ৷ ছেলেদের মাদরাসার তালেবে ইলমরা এখন মহিলাদের ভূমিকায়৷ উর্দু তারাও বাদ দিচ্ছে৷ সব নোট বাংলায় ক্রয় করে আলেম হওয়ার স্বপ্ন দেখছে! আরবী শরাহ শুরুহাত বোঝার জন্য যেটুকু যোগ্যতা থাকা প্রয়োজন ছিলো তা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে কারণ উস্তাযরাও মহিলা মাদরাসার ছাত্রীদের অনুকরণ করছেন নোট মোতালাআর ক্ষেত্রে৷ এটি এখন দোষের কিছু না৷ পরীক্ষায় পাস বা ভালো ফলাফল এখন মূখ্য৷ ভালো আলেম না হলেও চলবে৷ বক্তা বা ইমামের জন্য এতো ইলম দরকার নেই৷ আর মাদরাসায় পড়ানোর জন্য তো বাংলা নোট আছেই৷ আরবীর জন্য এতো মেহনতের প্রয়োজন কি?
দেশে হাজার হাজার কওমী মাদরাসা৷ লাখ লাখ তালেবে ইলম৷ প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার কিতাব বিক্রি হয়৷ তালেবে ইলমরা উচ্চমূল্যে কিতাব ক্রয় করতে বাধ্য হয়৷ নানা মাকতাবা প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করছে তালেব ইলমদের কাছ থেকে অথচ এই মাকতাবাগুলো নিম্নমানের নোট গাইড প্রকাশ করে ইলমী ইনহিতাতের চরম পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে মাদরাসাগুলোকে৷
ইদানীং কোনো কোনো প্রকাশনী মুহতামিমদের মোটা অংকের হাদিয়ার নামে ঘুষও দিচ্ছে যেনে মাদরাসা তাদের মাকতাবার প্রকাশিত কিতাবগুলো ক্রয় করে৷ দেশজুড়ে তাদের অসতাতার নেটওয়ার্ক৷ এইসব দেখার কেউ নেই৷ আলিয়া মাদরাসার আদলে কওমী মাদরাসার কোনো কোনো আলেমের নাম ব্যবহার করা হচ্ছে গাইডে৷ ফাযেলে দেওবন্দ লকব লেজুড় হিসেবে থাকে সেইসব নামের সাথে৷
এইসব হালাকু খাঁ-রা উর্দু কায়দারও উচ্চারণসহ নোট প্রকাশ করেছে৷ আগামীতে হাদীসের উচ্চারণসহ নোট বের করবে মনে হচ্ছে৷ সেইসব খালাকু খাঁদের প্রয়োজন টাকা এবং টাকা৷ ইলম গোল্লায় যাত তাতে তাদের কী?
মাদরাসাগুলোর অসচেতনতাকে পূঁজি করে সেইসব লুটেরা কিতাববানিজ্য করে কোটিপতি হচ্ছে অথচ কওমী মাদরাসা কর্তপক্ষ উদ্যেগী হলে কিতাব পত্রের ক্ষেত্রে এতো অরাজকতা হতো না৷
গত এক শত বছরে কওমী কর্তপক্ষ নিসাবের কিতাবগুলো উন্নতমানে ছাপার জন্য একটি প্রেসও দিতে পারলো না? নিসাবের কিতাবগুলো নির্ভুলভাবে ছাপার একদল যোগ্য লোকও তৈয়ার করতে পারলো না? প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য হচ্ছে অথচ বঞ্চিত হচ্ছে কওমী কর্তপক্ষ এই সহজ উপলব্দিটি নেই কেন?
তানজিম, বেফাক আরও কিছু বোর্ড কিছু কিছু বই কিতাব প্রকাশ করেছে তাতেই কোটি টাকার উপরে আয় থাকে বছর শেষে৷ যদিও বইগুলোর মান নিয়ে প্রশ্ন করা যায়৷ নিসাবের কিতাব নিজেরা ছাপিয়ে যদি নিজস্ব এজেন্ট নিয়োগ করে কিতাবের এই বাণিজ্যটা কওমী কর্তপক্ষ করতো তাহলে লাভমান হতো কওমী মাদরাসা৷ নিয়ন্ত্রণ হতো কিতাবের মান৷ রক্ষা হতো কওমী স্বার্থ৷ কিন্তু হচ্ছে না কেন? প্রশ্ন হবে কে কওমী কর্তপক্ষ? এইসব প্রশ্ন থাক৷
প্রাস্তাবনা: দ্রুত গঠন করা হোক একটি কওমী পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড৷ এটি আবার বেফাক নয়৷ বেফাক পরীক্ষা নেবে৷ এই বোর্ড হবে পৃথক৷ সকল বের্ডের সম্মিলিত পরামর্শক্রমে হবে এই বোর্ড। এই বোর্ডের অনুমেদন ছাড়া কোনো কিতাব মাদরাসায় পড়ানো হবে না৷
এরজন্য একটি রুপরেখা তৈয়ারে দেশের কওমী ধারার শিক্ষাবিদদের কাজে লাগানো যেতে পারে৷ এটি দীর্ঘমেয়াদী কাজ৷ দ্রুত বাস্তবায়ণের প্রয়োজন নেই৷ পরিকল্পনা প্রয়োজন প্রথমে৷
এই বোর্ড হলে কওমী মাদরাসা ব্যবসায়িকভাবে লাভমান হবে৷ কর্মসংস্থান হবে অনেকের৷ আর্থিক লাভমান হবে কওমী মাদরাসা৷ তালেবে ইলমরা সুলভে কিতাব কিনতে পারবে৷ বন্ধ হবে অরাজকতা৷
মাদরাসায় সকল নোট গাইড উস্তায তালেবে ইলমদের জন্য নিষদ্ধ করতে হবে৷ মূল কিতাব থাকবে৷৷সর্বোচ্চ আরবী শরাহ শরুহাত তাও প্রয়োজনে রচিত হবে বা তালখিস করা হবে৷
এই বোর্ড সময়ের প্রয়োজন উপলব্দি করে নতুন নতুন কিতাব উপহার দেবে যা পাঠ্যভুক্ত হবে৷
লেখক: পরিচালক, ইবনে খালদুন ইনস্টিটিউট
-এএ