মুহাম্মদ এহসানুল হক।।
বর্তমান চরমোনাই পীর মাওলানা রেজাউল করিম সাহেবের বাবা মাওলানা সৈয়দ মোহাম্মদ ফজলুল করীম রহ. ছিলেন শাইখুল হাদীস রহ. এর অত্যন্ত কাছের ছাত্র। লালবাগ জামিয়ার স্বর্ণযুগে তিনি সরাসরি শায়েখের দরসে বসেছেন। ছাত্রজীবন থেকেই তার গভীর সম্পর্ক ছিল শাইখুল হাদীস রহ. এর সাথে। মরহুম ইসহাক রহ. এর সন্তান হিসেবে শায়েখও তাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন।
২০০৬ এর ২৫ নভেম্বর সকালে খবর এলো চরমোনাই পীর মাওলানা সৈয়দ মোহাম্মদ ফজলুল করীম রহ. আমাদের মাঝে নেই। নশ্বর এই দুনিয়া ত্যাগ করে তিনি যাত্রা করেছেন চিরন্তন শান্তির পথ আখেরাতের দিকে। মুহূর্তেই সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। তার অনাকাঙিক্ষত বিদায়ে শোক-সাগরে ভাসছে হাজারো আশেকীন-মুরিদান ও সাধারণ মানুষ।
মরহুমের শ্রদ্ধেয় উস্তাদ শাইখুল হাদীস সাহেবকে যখন তার মৃত্যুর সংবাদ জানানো হলো, তার চেহারা জুড়ে নেমে এলো শোকের ছায়া। স্মৃতিচারণ করে বললেন, ‘আমি যখন কওমি সনদের স্বীকৃতির দাবিতে মুক্তাঙ্গনের রাজপথে শুয়েছিলাম তখন ফজলুল করীম আমার সাথে দেখা করতে এসেছিল।
স্পষ্ট মনে পড়ে। সেদিন মুক্তাঙ্গনে পীর সাহেব যখন এসেছিলেন, তখন শাইখুল হাদীস রহ. খাবার খাচ্ছিলেন। পীর সাহেব এসে খুব নিকটে বসলেন। শায়েখ তাকে দেখেই প্রাণখোলা হাসি দিয়ে বলে উঠলেন, আমার ডান হাত এসে গেছে। পীর সাহেব হাসলেন। এরপর দু‘জন হাত ধরাধরি করে হাজির হলেন মঞ্চে। এক অভাবনীয় দৃশ্যের অবতারণা হলো। ইসলামি আন্দোলনের ইতিহাসে রচিত হলো এক ঐতিহাসিক ঘটনা। আলিঙ্গনাবদ্ধ দুই হাত উঁচু করে বাংলার দুই সিংহপুরুষ ঘোষণা করলেন, স্বীকৃতি ছাড়া অন্যকিছু মানি না, মানবো না। সেটাই ছিল উস্তাদের সাথে ছাত্রের শেষ দেখা।
জানাযা হবে সেই বরিশাল। যাতায়াত ব্যবস্থাও বেশ কঠিন। শাইখুল হাদীস রহ. এর শারীরিক অবস্থা তখন ভালো না। কিন্তু তিনি বললেন, আমি জানাযায় যাবো। ছাত্রদের মধ্যে অনেকে জানাযায় শরিক হওয়ার জন্য তৈরি হয়ে গেল। এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগে তারা রওনাও হয়ে গেল। খবর পেলাম শায়েখের সাথে মামুন মামাও (মাওলানা মামুনুল হক) যাবেন। মামুন মামাকে বললাম, আমিও যাবো। মামা বললেন, মানুষ তো অনেক, কেবিন পাওয়া যাচ্ছে না। জায়গা হওয়া কঠিন। আমি বললাম, জায়গা লাগবে না। আমি যাবো।
লঞ্চের ব্যবস্থা করা হলো। রাত সাতটার দিকে শায়েখ রওনা হলেন সদরঘাটের উদ্দেশে। যানজটের কারণে সদরঘাট পৌঁছতে বেশ বিলম্ব হলো। সেখানে অপেক্ষায় ছিলেন তৎকালীন এমপি মুফতি শহিদুল ইসলাম ও মুফতি শরাফতসহ আরও অনেকে। আমরা যাচ্ছিলাম লঞ্চের দিকে। উলামায়ে কেরামের পদভারে গোটা এলাকা ছিল মুখরিত।
সময়টা ছিল এমন শাইখুল হাদীস রহ. যেখানেই যেতেন, উৎসুক জনতা ঘিরে ধরতো। নারায়ে তাকবির শ্লোগানে প্রকম্পিত হতো আকাশ বাতাস। সেদিনও ব্যতিক্রম হলো না। লঞ্চঘাটে শাইখুল হাদীসের উপস্থিতি পীর সাহেবের আশেকীনদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া তুলল। অনাকাক্ষিতভাবেই শুরু হলো শ্লোগান ‘শাইখুল হাদীসের আগমন, শুভেচ্ছার স্বাগতম’। শায়েখকে যে লঞ্চে তোলা হলো, আশপাশ থেকে স্রোতের মতো সবাই অন্য লঞ্চ ছেড়ে ছুটলো ঐ লঞ্চের দিকে।
ভিড় ঠেলে আমরা শায়েখকে কেবিনে নিয়ে গেলাম। দীর্ঘক্ষণ লোকজন শায়েখকে ঘিরে রাখলো। আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে মামুন মামার সাথে গল্প করে সময় কাটালাম। এক সময় ভিড় কমলো, শায়েখ খাওয়া-দাওয়া শেষ করলেন। এরপর ঘুমিয়ে পড়লেন। ফজরের নামাজের পর আমরা ভিড়লাম চরমোনাইয়ের তীরে। পাশেই ছিল ময়দান। বার্ষিক মাহফিলের জন্য সকল আয়োজন সম্পন্ন। লোকজনও উপস্থিত। নেই কেবল মাহফিলের মধ্যমনি পীর সাহেব চরমোনাই।
লাখো মানুষের ঢল। একটু পরপর ভেসে আসছে চিৎকারের আওয়াজ। চলছে শোকের মাতম। আমাদের উৎসুক চোখের পাতাগুলোও ভিজে উঠলো। স্বেচ্ছাসেবকদের সাহায্যে আমরা শায়েখকে একটা বিশেষ কামরায় নিয়ে গেলাম। দুয়েকজন ছাড়া কাউকেই ঢুকতে দেয়া হলো না। তারপর নিয়ে যাওয়া হলো লাশের কাছে, যেখানে প্রিয় ছাত্র ঘুমিয়ে আছে চিরনিদ্রায়।
পীর সাহেবের মাথার কাছে তিনি অনেকক্ষণ নীরবে বসে রইলেন। অনিমেষ তাকিয়ে রইলেন তার দিকে। পীর সাহেব ডানদিকে চেহারা দিয়ে নিশ্চিন্ত মনে শুয়ে আছেন। তার এই স্থিরতা সকলকে করে দিয়েছে স্তব্ধ। নূরানি চেহারার পবিত্রতা পুরো ঘরকে করে রেখেছে শীতল। পবিত্রতার শীতল পরশে পুলকিত হলাম।
চরমোনাই মাহফিলে আগে কখনো যাওয়ার সুযোগ হয়নি। তাই আরও একটু দেখার আগ্রহ নিয়ে খাস কামরা থেকে আমি একাই বের হলাম। এক শামিয়ানার নিচে লক্ষ লক্ষ মানুষ। চলছে তুমুল আহাজারি। অন্য রকম পরিবেশ। পরিচিত অনেকের সাথেই দেখা হলো। কিছুক্ষণ বাইরে থাকার পর খাস কামরায় ফিরতে গিয়ে পড়লাম বিপদে। সেচ্ছাসেবকরা কাউকেই ঢুকতে দিচ্ছে না। আমি তাদের কাছে গিয়ে পরিচয় দিবো সেই পরিবেশও নাই। ব্যারিকেডের পাশে দাঁড়িয়ে ভাবছি কী করবো। এমন সময় তৎকালীন এমপি মুফতি শহিদ সাহেব আমাকে একা দেখে হয়তো ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন। কিছু জিজ্ঞাসা না করেই আমার কাঁধে হাত দিয়ে কথা বলতে বলতে রওনা হয়ে গেলেন খাস কামরার দিকে। আমার আর কাউকে কিছু বলতে হলো না।
কিছুক্ষণ পর শায়েখ পাশের ঘরে এলে পীর সাহেবের ছেলেরা শায়েখকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার জুড়ে দিলেন। মনে হচ্ছিল পিতৃহারা সন্তানরা এসে দাদার কোলে ঠাঁই নিয়েছে। পীর সাহেবের সন্তানরা শায়েখকে ঘিরে অনেকক্ষণ বসে রইলেন। এক ছেলে পা জড়িয়ে ধরলে শায়েখ পা ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করছিলেন। তখন পীর সাহেব হুজুরের আরেক ছেলে চিৎকার করে বলে উঠল, আপনি আমার বাবার উস্তাদ, আপনার পা না ধরলে আমরা কার পা ধরবো।
তিনি তাদের সান্তনা দিলেন। বললেন, দুনিয়া থেকে সবাইকেই একদিন চলে যেতে হবে। এই পৃথিবী কারও জন্যই স্থায়ী নয়। আরও বললেন, দেখ, তোমাদের সবাইকে দেখতে তোমাদের বাবার মতোই মনে হয়। বাবার দেখানো পথেই তোমরা থাকবে। হুজুরের সন্তানরা সবাই মাথা নিচু করে বসে আছে। আর অঝোর ধারায় অশ্রু ঝরছে…
লেখক: শিক্ষক, জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া, ঢাকা
-এএ