আওয়ার ইসলাম: চলছে হজের মৌসুম। সারাবিশ্ব থেকে খোদাপ্রেমী মানুষ ছুটছে মক্কার পানে। মক্কা কর্তৃপক্ষও তাঁদের স্বাগত জানাতে প্রস্তুতি নিচ্ছে অনেক আগে থেকেই। সে প্রস্তুতির অংশ হিসেবে কাবার গায়ে লাগছে নতুন গিলাফ। কাবার প্রধান রক্ষনাবেক্ষক সালেহ বিন জাইন আল-আবিদিন আল-শাইবির কাছে নতুন গিলাফ তুলে দিয়েছেন মক্কার গভর্নর প্রিন্স খালিদ আল-ফয়সাল। বুধবার সৌদি আরবের কিং সালমানের পক্ষ থেকে এই গিলাফ হস্তান্তর করেন গভর্নর।
ইসলামের নবি ও তার সাহাবীদের অনুসরণ করে নিয়মিত এই গিলাফ পরিবর্তন করা হয়। প্রতি বছর হজ্জের ঠিক আগে কাবা শরীফের গিলাফ সরিয়ে তা সাদা কাপড় দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। হাজীদের ইহরামের শ্বেতশুভ্রতার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এই সাদা গিলাফ পরানো হয়। হজ্জ শেষ হয়ে গেলে ১০ জিলহজ্জ তারিখে নতুন গিলাফ পরানো হয়। যুগে যুগে এই গিলাফের রঙ বদলেছে বলে জানিয়েছে আরব নিউজ।
এতে জানানো হয়েছে, নবি মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লাল-সাদা স্ট্রিপের ইয়েমেনি কাপড় দ্বারা তৈরি গিলাফ দিয়ে কাবা শরীফ ঢাকতেন। পরবর্তীতে আবু বকর সিদ্দিক রা., উমর ইবনে খাত্তাব রা., উসমান ইবনে আফফান রা. সাদা চাদর দিয়ে গিলাফ তৈরি করেছেন। ইবনে জুবায়ের রা. লাল কাপড় দিয়ে এই গিলাফ তৈরি করেছেন। আব্বাসীয় যুগে পাল্টাপাল্টি করে এটিকে সাদা ও লাল রঙের কাপড় দিয়ে তৈরি করা হত। আব্বাসীয় যুগের শাসক আল-নাসির এই গিলাফের রঙ পরিবর্তন করে প্রথমে সবুজ ও পরে কালো রঙ নির্ধারণ করেন। এরপর থেকেই আজ পর্যন্ত গিলাফের রঙ কালো রয়ে গেছে।
মক্কার ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করা ড. ফাওয়াজ আল-দাহাস আরব নিউজকে জানান, কাবা ইতিহাসে একেকসময়ে সাদা, লাল ও কালো রঙ্গের গিলাফ দ্বারা ঢাকা ছিল। বিভিন্ন যুগের অর্থনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষিতে এই রঙ নির্ধারিত হয়েছিল। সেসময় মিশর থেকে আসা কুবাতি ফ্যাব্রিক দিয়ে এই কাবার গিলাফ তৈরি করা হত। ইয়েমেনি কিসওয়াও বেশ প্রসিদ্ধ ছিল। আল-দাহাস বলেন, সাদা সবথেকে উজ্জ্বল রঙ। তাই সাদা কাপড় দিয়ে গিলাফ তৈরির প্রচলন ছিল। কিন্তু এটি দ্রুত নষ্ট ও নোংরা হয়ে যেত। তাই একসময় কালো রঙের গিলাফ এই স্থানে জায়গা করে নেয়। আর সেসময়কার অর্থনৈতিক অবস্থা নির্ধারণ করত গিলাফের কাপড়ের মান কেমন হবে। এটি যাতে কাবার কাছে যাওয়া মানুষরা নোংরা না করতে পারে তাই ওমরাহর সময় এটিকে কিছুটা উপড়ে তুলে রাখা হয়।
ইসলাম আসার পূর্বেই কাবার ওপরে গিলাফ দিয়ে ঢাকার প্রচলন শুরু হয়। ইয়েমেনের কিং তুব্বা আবু কসর আসাদ প্রথম এই প্রচলণ ঘটান। তিনি আরব অঞ্চলে ইহুদি ধর্ম গ্রহণ করা শাসকদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। তুব্বা আবু কবর আসাদ সে সময় মক্কায় গিয়ে ক্বাবা শরীফ তাওয়াফ করেন ও মাথা মুণ্ডন করেন। তিনি মক্বায় কয়েকদিন অবস্থান করেন। মক্কায় অবস্থানকালে তিনি ঘুমের মধ্যে একদিন স্বপ্ন দেখেছিলেন যে, তিনি কাবা শরীফ গিলাফ দ্বারা আচ্ছাদন করছেন। এ স্বপ্ন দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি খাসাপ দিয়ে কাবা ঘরটি আচ্ছাদিত করেন। খাসাপ হচ্ছে তালগাছ জাতীয় গাছের পাতা ও আঁশের তৈরি এক ধরনের মোটা কাপড়। তবে এরপরই তিনি আবার স্বপ্ন দেখেছিলেন যে তিনি আরো উন্নতমানের কাপড় দ্বারা কাবা শরীফ আচ্ছাদন করছেন।
অত:পর তিনি খাসাপের পরিবর্তে মামিজিয়ান পাপিরাস নলখাগড়া দিয়ে কাবা ঘর আচ্ছাদন করেন। ইয়েমেনের মামিজ নামক একটি উপজাতীয় গোত্র এই কাপড় তৈরি করতো। এরপরও তৃতীয়বারের মতো তিনি স্বপ্নে আরো উন্নত মানের কাপড় দ্বারা কাবা আচ্ছাদনের স্বপ্ন দেখেছিলেন। তৃতীয় দফা স্বপ্নটির পর তিনি ইয়েমেনের লাল ডোরাকাটা কাপড় দিয়ে পবিত্র কাবা ঢেকে দেন। তার এই গিলাফ দেয়ার প্রচলনের পর স্থানীয় শাসকরা নিয়মিত কাবায় গিলাফ পাল্টাতে থাকেন। তারা একে তাদের ধর্মীয় কর্তব্য মনে করতেন। আরবে ইসলাম প্রচার শুরু হওয়ার পর ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের নবী সাদা রঙ্গের মিশরীয় কুবাতি কাপড় দিয়ে গিলাফ তৈরি করেন। বর্তমানে গিলাফ কালো রেশমী কাপড় দ্বারা নির্মিত।
উইকিপিডিয়ার তথ্যানুযায়ী, এর ওপর স্বর্ণ দিয়ে লেখা থাকে 'লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ', 'আল্লাহু জাল্লে জালালুহু', 'সুবহানাল্লাহি ওয়া বেহামদিহি, সুবহানাল্লাহিল আযিম' এবং 'ইয়া হান্নান, ইয়া মান্নান'। ১৪ মিটার দীর্ঘ এবং ৯৫ সেমি প্রস্থবিশিষ্ট ৪১ খণ্ড বস্ত্র জোড়া দিয়ে এই গিলাফ তৈরি করা হয়। চার কোণায় সুরা ইখলাস স্বর্ণসূত্রে বৃত্তাকারে উৎকীর্ণ করা হয়। রেশমী কাপড়টির নিচে মোটা সাধারণ কাপড়ের লাইনিং থাকে। একটি গিলাফে ব্যবহৃত রেশমী কাপড়ের ওজন ৬৭০ কিলোগ্রাম এবং স্বর্ণের ওজন ১৫ কিলোগ্রাম। বর্তমানে এটি তৈরীতে ১৭ মিলিয়ন সৌদী রিয়াল ব্যয় হয়।
সূত্র: ইন্টারনেট
এমডব্লিউ/