সালাহ্উদ্দীন জাহাঙ্গীর ।।
বউয়ের আজন্ম সাধ তিনি শিক্ষক হবেন। দুই-তিন বছর ধরে বলছিলেন তাঁর জন্য কোথাও পড়ানোর ব্যবস্থা করতে। কিন্তু বাচ্চাদের পড়ানোর মতো ভোগান্তির কাজ তিনি সামাল দিতে পারবেন কিনা সেই চিন্তা, আবার আমারও নিমরাজি ছিল। কেননা বাড়ির আশপাশে কোনো স্কুল বা মাদরাসা নেই, যেখানে তিনি আরবি/ইসলামি বিষয়াদি বাচ্চাদের পড়াতে পারবেন। তাই আমি ও বিষয়ে বড় একটা গা করিনি।
তবে গত বছরখানেক সময় ধরে ‘অন্য কিছু কারণে’ আমার মাথায় ধীরে ধীরে শিশুশিক্ষা বিষয়ে নতুন চিন্তা জমা হতে লাগল। চিন্তার ফলাফল যেটা দাঁড়াল-আমরা নিজেরাই কি একটা মকতব বা স্কুল করতে পারি? গ্রামের ছেলেমেয়েদের পড়াব। স্কুলের পড়াশোনার পাশাপাশি কায়দা-কোরআন শেখাব।
মসজিদভিত্তিক সকালের মকতবগুলো তো বন্ধই হয়ে গেছে প্রায়, সেটার বিকল্প কিছু তো করতে হবে। নইলে বাংলাদেশের কোটি কোটি শিশু কোরআন শিখবে কোথা থেকে? প্রাথমিক চিন্তা এমনই ছিল। কীভাবে সেই চিন্তা মজবুত হলো, সে গল্প বলব ধাপে ধাপে। আজ শুধু বলি, কীভাবে জাস্ট শুরু করে দিলাম।
রমজানে দুই চাচাতো ভাইয়ের দুই ছেলে-মেয়ে,সাজিদ আর তাবাসসুম কায়দা পড়তে আসত বউয়ের কাছে। বউ তাদের আলিফ বা, তা পড়াতেন আর দোয়া-কালাম শেখাতেন। ওদের পড়াতে গিয়ে বউয়ের পড়ানোর নেশা আরও তেতে উঠে। আবার ভাতিজা-ভাতিজি দুজনও তাদের চাচিকে ফুঁসলাতে থাকে, ‘বড়আম্মা, আপনে একটা মাদরাসা দেন। রোজা শ্যাষ হয়া গেলে তহনও আমরা ওইনে পড়ুম। আমরা আপনের কাছে পড়ুম।’
বউকে এবার পায় কে!
গত রমজান থেকে পাক্কা নিয়ত করে ফেললাম, ঈদের পর থেকে দুজনে মিলে পড়ানো শুরু করব। প্রয়োজনে চাচাতো ভাইয়ের বউয়েরা আছে, চাচাতো বোনেরা আছে, তারাও পড়াবে। যেহেতু করোনার কারণে স্কুলগুলো বন্ধ, বাচ্চারা সব পড়াশোনা বাদ দিয়ে সারাদিন হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়ায়, ঘুড্ডি উড়ায়। সেগুলোকে গলায় দড়ি বেঁধে ধরে এনে মকতবস্কুলে বসিয়ে দেব।
যাকগে, ঈদের পরপর শুরু করা না গেলেও বেশি একটা দেরি করলাম না। ভাতিজা-ভাতিজির সঙ্গে আরও দু-তিনজনকে যোগাড় করে বউ আমাদের ড্রয়িংরুমে পড়ানো শুরু করলেন। এটা গত জুনের ২০/২১ তারিখের কথা। ড্রয়িংরুমে জায়গা কম, ফ্লোরে পাঁচ-ছয় জন একসঙ্গে বসা কষ্ট। তাহলে আর জায়গা পাব কই?
ছোট চাচার দোতলা বাড়ির দোতলায় দুটো রুম খালি পড়ে আছে। চাচাকে গিয়ে এক সন্ধ্যায় বললাম, রুম দুটোয় পাড়ার পোলাপানকে পড়াতে চাই। চাচা খুশিমনে রাজি হয়ে গেলেন। শুরু করার চার-পাঁচ দিন পর শিক্ষার্থীদের নিয়ে দুটো রুম পরিষ্কার করে সেখানে পড়ানো শুরু হলো। একটা প্রাতিষ্ঠানিক প্রাতিষ্ঠানিক ভাব এলো। অবশ্য ছাত্র-ছাত্রী তখনও সর্বসাকুল্যে সাত-আট। করোনার কারণে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অবশ্য খুব বেশি কাউকে বলাও হয়নি। বাধ্যবাধকতার ব্যাপার আছে।
পরদিন বাজার থেকে একটা ঝাড়ু কিনে আনলাম ৭০ টাকা দিয়ে, মকতবস্কুলের জন্য প্রথম ব্যয়। মসজিদের একটা হোয়াইট বোর্ড ছিল মকতবের বাচ্চাদের পড়ানোর জন্য। কিন্তু মকতব বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ওটা বেকার পড়ে ছিল। পোলাপান নিজেরাই গিয়ে সেটা নিয়ে এলো। আমি একটি মার্কার পেন আর ডাস্টার কিনে আনলাম। বউ হোয়াইট বোর্ডে লিখে লিখে সুর করে পড়াতে লাগলেন, আলিফ খালি বা’র নিচে এক নোকতা...! চলবে...!