কাওসার জামীল আল-মাদানী।।
বিগত দুই যুগ ধরে কওমি মাদরাসার দাওরায়ে হাদিস সমাপণকারীদের উচ্চশিক্ষা গ্রহনে দেশ-বিদেশের বিশেষায়িত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়া এবং গবেষণামুলক পড়ালেখার আগ্রহ ব্যাপকভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে এবং প্রতিনিয়ত এই আগ্রহ বেড়েই চলছে। এরই প্রেক্ষিতে, দেশের বাহিরে গিয়ে মানসম্মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির বিষয়ে ছাত্রদের আকাঙ্ক্ষা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষত,কওমি সনদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দাবির সময় থেকে এ বিষয়টি ছাত্রদের মাঝে আরো জোরালো হচ্ছে।
বিদেশে উচ্চশিক্ষার সার্বিকদিক চিন্তা করে,অনেকে বিভিন্ন দেশের স্কলারশিপপ্রাপ্তির বিষয়টি অনেক গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেন।সহজে স্কলারশিপ প্রাপ্তি ও কোর্সের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার পাশাপাশি ইসলামি বিভিন্ন সাবজেক্টে মানসম্পন্ন পড়ালেখার ক্ষেত্রে কওমি পড়ুয়াদের জন্য আমার দৃষ্টিতে সৌদি আরব হলো সবচেয়ে উত্তম দেশ।
এছাড়া, মক্কা-মদিনার ন্যায় পণ্যভূমি থাকার ফলে সউদীর প্রতি সবার আকর্ষণ আরো বৃদ্ধি করে।
তবে,দাওরায়ে হাদিস এর সনদকে স্বীকৃতিদানের নিমিত্তে সংসদে বিল পাস এবং পরবর্তীতে মহামান্য রাষ্ট্রপতি বিলে সম্মতিদানের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতির গেজেট হলেও এই সার্টিফিকেট দিয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য আবেদনের ক্ষেত্রে কিছু জটিলতা এখনো রয়ে গেছে।
এক. দাওরায়ে হাদিসের সনদকে ইসলামিক স্টাডিজ বা আরবি সাহিত্যে স্বতন্ত্র মাস্টার্স এর মান দেওয়া হয়েছে।এটাকে বলা হয় "ওয়ান-স্টপ মাস্টার্স"। এর মানে হলো,নীচের একাডেমিক ধাপগুলো ব্যতিরেখে আপনি সরাসরি মাস্টার্স পাস এবং এর আগের শিক্ষার একাডেমিক ধাপগুলো, যথাক্রমে- পিএসসি, এসএসসি, এইচএসসি ও অনার্স এর শিক্ষাস্তরগুলোর স্বীকৃতি নেই। নেই সার্টিফিকেট।
দুই. এই ওয়ান-স্টপ মাস্টার্স ডিগ্রিটি যেমনিভাবে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্জন করা মাস্টার্স ডিগ্রির সরাসরি মানের নয়,তেমনিভাবে ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে মান-পাওয়া দেশের আলীয়া মাদ্রাসারসূমহের "কামিল" ডিগ্রির ন্যায় মাস্টার্স ডিগ্রির সমমানের মতোও নয়।বরং,কওমি পড়ুয়াদের সার্বিক বিষয় বিবেচনা করে শুধুমাত্র শিক্ষিতশ্রেণী হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া জন্য ভিন্নতর এক স্বতন্ত্র মাস্টার্সের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে বলে আমার ধারণা।
তিন. প্রায় সকল দেশের উচ্চতর শিক্ষা (মাস্টার্স, এমফিল,পিএইচডি) অর্জন কিংবা যে কোন কর্মসংস্থানে যোগদানের জন্য অনার্সের একাডেমিক সার্টিফিকেটটিই মৌলিক ভিত্তি ধরা হয়। অনার্সের রেজাল্ট ও পাঠিত সিলিবাসকে সর্বাধিক বিবেচনা নেওয়া হয়। কওমী সনদটি ওয়ান-স্টপ স্বতন্ত্র মাস্টার্স ডিগ্রি হওয়াতে অনার্সের মতো মৌলিক ডিগ্রির স্বীকৃতি ও সার্টিফিকেট নেই।
যেমন ধরুন,এদেশের বিশ্ববিদ্যালয় মুঞ্জুরী কমিশনের স্বীকৃত নয়, এমন দেশ থেকে কেউ অনার্স সম্পন্ন করে দেশে এসে অনার্সের সে সার্টিফিকেট দিয়ে মাস্টার্স করা কিংবা কর্মসংস্থানে অংশগ্রহণের সুযোগ নেই।
চার. আন্তর্জাতিকভাবে মাস্টার্স ডিগ্রি প্রদানের দায়িত্ব ন্যাস্ত থাকে, যে কোন ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর। কোন শিক্ষা বোর্ডের উপর নয়। কিন্তু কওমী সনদকে স্বতন্ত্র মাস্টার্স ডিগ্রির মান দেওয়া হয়েছে বোর্ডের অধীনে।বোর্ড কর্তৃক মাস্টার্স ডিগ্রি প্রদান সর্বজন স্বীকৃত নয়।
উপরোক্ত মৌলিক কিছু জটিলতার ছাড়াও একাডেমিকভাবে মাস্টার্স ডিগ্রির আন্তর্জাতিক স্বীকৃত পাঠ্যক্রম ও পাঠদান পদ্ধতি পুরোপুরি অনুসরণ করা হয় না।বরং,এখনো অনেক তারতম্য রয়ে গেছে।তাই, দাওরায়ে হাদীস এর সনদ এখনো মাস্টার্সের স্বীকৃত মানদন্ডে উত্তীর্ণ হয় নি।
স্বীকৃত মানদন্ডে উত্তীর্ণ না হওয়ার ফলে এই সনদের এই স্বীকৃতি বহি:বিশ্বে এখনো গ্রহনযোগ্যতা পায়নি বলেই জানি।
পাশাপাশি কওমী মাদরাসাসূমহের সর্বোচ্চ শিক্ষাবোর্ড আল-হাইয়াতুল উলইয়ার পক্ষ থেকেও সউদী শিক্ষা মন্ত্রণালয় কিংবা স্বতন্ত্রভাবে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে এই সনদ দিয়ে ভর্তির আবেদন করার মুআদালা তথা মান নিরূপণ করে ভর্তির জন্য শিক্ষা-চুক্তি এখনো করা হয় নি।যেহেতু কওমী সনদ রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেয়েছে তাই সউদীতে উচ্চশিক্ষার জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে এবং ব্যক্তি বিশেষে চেষ্টা করা যেতে পারে।
তবে,হাইয়াতুল উলইয়ার পক্ষ থেকে এখনো মুআদালা করা না হলেও চট্টগ্রামের দুইটি কওমি মাদরাসার সাথে সউদীর বিভিন্ন বিশ্বিবদ্যালয়ের ভর্তির জন্য মুআদালা করা রয়েছে।
মুআদালাকৃত মাদরাসার একটি হলো, দারুল মাআরিফ আর অপরটি হলো,পটিয়া মাদ্রাসা। দাওরায়ে হাদিস সম্পন্ন করার পর দারুল মাআরিফের কুল্লিয়াতে পড়তে হয়। এটা দুই বৎসরের কোর্স। এই সার্টিফিকেট দিয়ে সৌদি বিভিন্ন ভার্সিটিতে আবেদন করা যায়। আর পটিয়া মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিস এর সার্টিফিকেট দিয়ে রিয়াদের কিং সাউদ বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করা যায়। উভয় মাদরাসার দায়িত্বশীলদের থেকে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যেতে পারে।
কওমি সনদ দিয়ে সৌদির সাথে মুআদালা বা শিক্ষা-চুক্তি আপাতত না থাকলেও কওমি শিক্ষা বোর্ড ও মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে নিয়মতান্তিক সত্যায়ন করিয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেকে স্কলারশিপের আবেদন করেছেন। অনির্ভযোগ্য সূত্রে জেনেছি, দুজন ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন।
এছাড়া যতটুকু জানি, দারুল উলুম দেওবন্দের সাথে মদিনা ভার্সিটির মুআদালা না থাকা স্বত্ত্বেও শুধুমাত্র দেওবন্দের সনদ দিয়ে আমার এক বিদেশি বন্ধু ভর্তি হয়ে মদিনাতে অনার্স সম্পন্ন করেছেন। তাঁর নাম আম্মার আযীয। ভারতের দেওবন্দের বাসিন্দা এবং মদিনা ভার্সিটিতে একই সাবজেক্টে আমার এক সেমিস্টার সিনিয়র ছিল।
সম্পর্কে আল্লামা তাকী উসমানী হাফিজাহুল্লাহ এর নাতি হোন। উল্লেখ্য, ১৯৪৭ সনে দেশ-বিভাগের পর তাকী উসমানী হাফিজাহুল্লাহ এর পূর্ব-পুরুষদের অনেকে পাকিস্তানে হিজরত করলেও আবার কেউ কেউ দেওবন্দেই থেকে যান।
মুআদালার বাহিরে বিচ্ছিন্নভাবে দু'একজন ছাত্র শুধুমাত্র কওমি সনদ দিয়ে ভর্তির সুযোগ পেলেও আদতে সৌদির বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তপক্ষ স্কলারশিপের আবেদন গ্রহনের বেলায় তাঁদের বর্নিত শর্তগুলোর প্রতি অনেক বেশি লক্ষ্য রাখে এবং খুব কমই ব্যতয় ঘটে।
প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় নিজেদের ওয়েবসাইটে স্পষ্ট করে শর্তগুলোসহ স্কলারশিপ ও কোর্স সংক্রান্ত আনুসাঙ্গিক বিস্তারিত তথ্য দেওয়া আছে। আবেদনের শর্ত, আবেদন গ্রহন,অফার লেটার, ভিসা-টিকেট ইত্যাদিসহ অন্যান্য বিষয়ের প্রসেস করা থেকে নিয়ে সবকিছু ব্যক্তিমাধ্যম ব্যতীত অনলাইনে এবং অত্যান্ত সতর্কতার সহিত যথেষ্ট স্বচ্ছতার সাথে করা হয়ে থাকে।
সৌদির বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক সাবজেক্টে পাঠ্যক্রম ও ছাত্রদের পূর্বের মৌলিক শিক্ষা ব্যাকগ্রাউন্ড বিবেচনা করলে এদেশ থেকে অন্যদের তুলনায় কওমী পড়ুয়া মেধাবীরা ভর্তির বেশি উপযুক্ত বলে মনে করি। কিন্তু একাডেমিক স্বীকৃত পাঠ্যক্রম ও পদ্ধতির অনুসরণ না করার দরূন বিশাল সংখ্যক কওমী পড়ুয়া শিক্ষার্থী সউদী আরবে উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
অথচ একাডেমিক স্বীকৃত পাঠ্যক্রমের অনুসরণ করার দরূন আলীয়া মাদ্রাসার শিক্ষাকোর্স এইচএসসি সমমান “আলীম” এর সার্টিফিকেট দিয়ে এবং শুধুমাত্র স্বীকৃত একাডেমিক পদ্ধতি অনুসরণের দরূন কলেজ এর এইচএসসি এর সার্টিফিকেটে দিয়ে সউদীতে অনায়সেই স্কলারশিপের আবেদন করা যায় এবং একাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ড ইসলামিক সাবজেক্টে না হওয়া সত্ত্বেও যে ইসলামিক সাবজেক্টে ভর্তি হওয়া যায়।তেমনিভাবে, দেশের অনার্স ও মাস্টার্সের সার্টিফিকেট দিয়ে যথাক্রমে মাস্টার্স ও পিএইচডি করা যায়।
কওমী মাদরাসার একাডেমিক শিক্ষার বৈশিষ্ট্য ও নিজেস্ব স্বতন্ত্রতা বজায় রেখে রাষ্ট্র থেকে যেভাবে স্বীকৃতি গ্রহন করেছে,অনুরূপভাবে সউদীর শিক্ষা মন্ত্রনালয় কিংবা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে প্রতিষ্ঠানিকভাবে কিংবা বোর্ড কেন্দ্রিক মুআদালা তথা ভর্তির আবেদন করার সুযোগদানের চুক্তি করা যেতে পারে।
যদি হাইয়াতুল উলইয়ার পক্ষ থেকে সর্বাত্মক উদ্যোগ নেওয়ার হওয়ার পাশাপাশি সরকারের শিক্ষা ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকেও চেষ্টা করা হয়, তাহলে কওমীর সনদ দিয়ে সউদীতে উচ্চশিক্ষার দ্বার উম্মোচিত হবে,ইনশাআল্লাহ।
এক্ষেত্রে আলেমদের একটি প্রতিনিধি দল বা দেশের দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ সউদীর শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বশীলদের সাথে দেখা করে জোরালো আবেদন করতে পারে।পাশাপাশি সউদীর দায়িত্বশীলদের এদেশের কওমী মাদরাসাসূমহ পরিদর্শনের জন্য আমন্ত্রণ করতে পারে।অন্তত,দেশের বড় কিছু কওমী মাদরাসায় গেলে ইলমী ও আমলী পরিবেশ দেখে চমৎকৃত হবে বলে আশা রাখি।এতদ প্রেক্ষিতে, মুআদালা হওয়াটা অনেকটা সহজ ও সম্ভব হবে।
দেশের প্রায় দশহাজারের অধিক দাওরায়ে হাদীস কওমী মাদরাসার মধ্যে মাত্র দুইটি মাদরাসার সাথে মুআদালা আছে।অথচ এদেশের আহলে হাদীস ভাইদের নিজেস্ব সামগ্রিক মাদরাসার সংখ্যা অতি সামান্য হওয়া সত্ত্বেও দশের অধিক মাদরাসার সাথে সউদীর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের মুআদালা আছে। আহলে হাদীস ভাইয়েরা এ ক্ষেত্রে আমাদের চেয়ে অনেক এগিয়ে আছে।
দেশ-বিদেশের বিজ্ঞ আলেমদের শিক্ষা জীবনে ইলমের জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে সফর করা যেন আবশ্যিক ভাবে হয়ে থাকে।ইলমের জন্য দেশান্তরের গুরুত্ব ও ফযীলত ছাড়াও অন্তত ইলমের জন্য সফর না করলে ইলম অর্জন যেন পূর্ণতা পায় না।
যদি সউদীর সাথে কওমী সনদের মুআদালা হয় তাহলে এদেশের কওমী তরুণ আলেমদের উচ্চশিক্ষার জন্য বিশাল দ্বার উম্মোচন হবে।শুধুমাত্র সউদীতে বিশের (২০) অধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক বিভিন্ন সাবজেক্টে ভর্তির সুযোগ হয়ে যাবে।
সাথে সাথে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো ও অন্যান্য মুসলিমদেশগুলোতেও উচ্চশিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি হবে।
পাশাপাশি আরবদের সাথে এদেশের আলেমদের পারস্পরিক ইমলী চর্চা অনেক হারে বৃদ্ধি পাবে ও দরূত্ব কমবে।বাড়বে ভ্রাতৃত্ব বোধ ও সহযোগিতা।পরবর্তীতে মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজারের সহায়ক অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজে আসবে এই উচ্চশিক্ষায় অংশগ্রহণকারী আলেমদের দিয়ে।
দেশের ইলমী চর্চা বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য সউদীর সাথে কওমী সনদের মুআদালা অত্যন্ত জরুরী।
লেখক: কাওসার জামীল আল-মাদানী, (লিসান্স, মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়), শিক্ষা সচিব, মাহাদু উলূমিল কুরআন,ঢাকা।