মুফতি মামুন আব্দুল্লাহ কাসেমি।।
এক.
মারকাযুদ্ দিরাসাহ্ আল ইসলামিয়্যাহ্-ঢাকা এর মাদরাসা ভবনের বিদ্যুৎবিলে অনেক দিন যাবতই বড় ধরনের অসংগতি দেখা যাচ্ছে। মাদরাসা বিরতি থাকলে যেখানে সর্বোচ্চ দুই হাজার টাকা বিল আসার কথা সেখানে এপ্রিল ২০২০ এ বিল এসেছে মাত্র (!) বিশ হাজার টাকা। অসঙ্গতিগুলো দূর করার উদ্দেশ্যে অফিসিয়াল কিছু জরুরী কাজ করার জন্য এক ভাইয়ের স্মরণাপন্ন হই। আলোচনা করার জন্য আজ গিয়েছিলাম মিরপুর-১৩ এর দিকে।
দুই.
মাগরিবের আজান হলে নামাজের জন্য উপস্থিত হলাম মুহতারাম ভাই মাওলানা মুফতী রেজাউল হক মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ সাহেবের পরিচালনাধীন মাদরাসা মিরপুর কেন্দ্রীয় মসজিদ সংলগ্ন দারুল উলূম ঢাকা,মিরপুর-১৩ এ।
এখানে আমার প্রায়ই আসা-যাওয়া হয়। দারুল উলূম দেওবন্দের শাইখুল হাদীস,আমার পীর ও মুরশিদ হজরত আল্লামা কমরুদ্দীন আহমাদ গৌরখপুরীর একটি আঞ্চলিক খানকাও এই জামেয়ায় অবস্থিত। দারুল উলূম ঢাকা এর উল্লেখিত মুহতামিম সাহেব হযরত আল্লামার একজন স্নেহধন্য খাদেম ও খাস খলীফা। হযরত আল্লামার ঢাকা সফরকালীন একাধিকবার এখানে আসা যাওয়া, রাত্রিযাপন এবং আতিথেয়তা গ্রহন আজ বেশ কয়েক বছরের নিয়মিত ঘটনা। এখানের আসাতিযায়ে কেরামও সহকর্মীর মতোই কথা বলেন আমার সাথে।
মুহতামিমের মেহমানদারিতে যে প্রশস্ত হৃদ্যতা এবং বংশীয় আভিজাত্য ও কৌলিন্য ফুটে ওটে তার বিবরণ আজ না হয় নাই দিলাম। একইসঙ্গে মুহতামিম মুফতী রেজাউল হক মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ সাহেব একজন সজ্জন সাহিত্যপ্রেমী সুলেখক এবং সামাজিক ও সদালাপী ভদ্র মানুষ। এজন্য বিশেষ কোন কাজ ছাড়া শুধু گفت و شنید এর জন্যও আসা হয় কখনো কখনো । করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে সৃষ্ট স্থবিরতায় কিছুটা মানুষিক একঘেয়েমি অনুভূত হওয়ায় আজ জরুরী কাজের পাশাপাশি এমন একটু সময় কাটানোও উদ্দেশ্য ছিলো।
তিন.
মাগরিব পড়ে মুহতামিম সাহেবের দপ্তরে বসলাম। সালাম মুসাফাহার পরে পরস্পর কুশল বিনিময় হলো। বর্তমান প্রেক্ষাপটে মাদরাসা মসজিদ নিয়েও কথা হলো। এরই মধ্যে দৃষ্টি পড়লো কালের কন্ঠ(১ম খন্ড) নামে টেবিলে রাখা ঝকঝকে চমৎকার মলটের একটি বইয়ের উপর। হাতে নিয়ে দেখলাম ইসলামী বাংলা সাহিত্যের পুরোধা, বহু লেখক কলামিস্টের জনক,অবিসংবাদিত সাংবাদিক সাহিত্যিক মরহুম মাওলানা মুহিউদ্দীন খান রহ এর অমরকীর্তি মাসিক মদিনার প্রতিষ্ঠাকাল তথা ১৯৬১ হতে ১৯৬৯ পর্যন্ত সময়ের সম্পাদকীয় সংকলন। ভিতরে খুলে প্রথমেই নজরে পড়লো সম্পাদক মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের লেখায় মাসিক মদীনার জন্মকথা। আমার অভ্যাস অনুযায়ী বই সম্পর্কে ধারনা নেওয়ার জন্য লেখকের ভূমিকাটা মনে করে পড়তে লাগলাম।
কিন্তু মাওলানা মুহিউদ্দীন খান মানেই সুখপাঠ্য কিছু। মুখবন্ধ পড়তে গিয়ে কিছু কিছু জায়গায় চোখের কোনে পানিও জমে উঠলো। বিশ পৃষ্ঠা ব্যাপৃত 'জন্মকথা'টি শেষ করতে পারলামনা। রাত বেড়ে যাওয়ায় এশার নামাজ পড়ে মুহতামিম সাহেবের কাছ থেকে বইটি নিয়ে মারকাযুদ্ দিরাসার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। জন্মকথা শীর্ষক লেখাটির উপর কিছু লিখতে গেলে কথা দীর্ঘ হয়ে যাবে, এব্যাপারে আজ আর কথা নয়। শুধু বলবো-খান সাহেবের স্বলিখিত আত্মজীবনী থেকে নেওয়া এ অংশসহ পুরো আত্মজীবনীটাই একজন কর্মবীর আলেম ফাযেলের জন্য সুখপাঠ্য এবং মাইলফলক। জীবনে কিছু করতে চায় এমন সবার জন্য পড়া উচিৎ বইটি।
চার.
কেন্দ্রীয় মসজিদের সাথেই একটি রিক্সা দাড়ানো। রিক্সাওয়ালাও আছে সাথে। থুতনীর নীচে অল্প দাড়ি, গায়ে সাদা গেঞ্জি, মাথায় পাঁচকল্লি টুপি। হালকা গতর, লুঙ্গি দিয়ে ঢাকা সতর। জীর্নশীর্ণ দেহ, গায়ের রং কালো, তবে কথাবার্তা নেহায়েতই ভালো।
কাছে গিয়ে বললাম-
যাবা?
কোথায়?
শেওড়াপাড়া জামতলা কাঁচাবাজার। কাজীপাড়ার সাথেই লাগানো,(ব্যাখ্যাটা দিলাম যেন ভাড়াটা কাজিপাড়ার হিসেবে চায়,মানে কম চায়)।
যামু।
কত নিবা?
দশ নম্বর থেকেতো পঞ্চাশ টাকা হয়।
আপনি এনতন কত দিবেন?
সেনপাড়া হয়ে ভিতর দিয়ে চলে যাবা,বেশিক্ষণ লাগবেনা,তুমি ত্রিশ টাকা নিও।
না,ত্রিশ টাকায় যামুনা।
কত হইলে যাইবা?
আপনেই কন।
চলো,চল্লিশ টাকা নিও।
না,হয় না।
তাইলে কত লাগবে?
পঞ্চাশ টাকা হইলে যামু।
আচ্ছা চলো বলে বসে পড়লাম।
সাধারণত রিক্সায় বসে আমি রিক্সা ওয়ালার সাথে টুকটাক কথা বলি। তাদের সুখ-দুঃখের কথা শুনি। তাদের সাথে কথা বললে আজব আজব কথা বের হয়ে আসে। কেও দেনা দায়ের কারনে রিক্সা চালায়,কেও ডাবল মাস্টার্স হেল্ডার হয়েও চাকরিতে মামু আর মামা না থাকায় শত যোগ্যতা নিয়েও চাকরির ইন্টার্ভিউতে ফেল।
মামা তো মামাই। আর মামু মানে টাকা অর্থাৎ ঘুসের টাকা। আবার কোন রিক্সা ওয়ালার দুই বৌ,তিন স্ত্রী। একজন এই টিনশেডে, আরেকজন ঐ বস্তিতে, ৩য় জন গ্রামে। আরো কত কি। কিন্তু মাসিক মদীনার জন্মকথার আকর্ষনে রাস্তার পথচারীদের জন্য জালানো সরকারি লাইটের টিমিটিম আলোতে পড়ার চেষ্টা করলাম। পরিস্কার বোঝা না যাওয়ায় দু এক লাইনের বেশি পড়তে পারছিলামনা। এরইমধ্যে মাদবরের পুকুরপাড় পার হয়ে দশ নম্বর গলির ভিতরে ঢুকতে রিক্সা ওয়ালা জিজ্ঞেস করলো-
তেরো নম্বর মাদরাসায় কি ভর্তি বন্ধ?
না,ভর্তি চলছে এখনো।
কেন? তোমার ছেলেকে ভর্তি করবা নাকি?
না,মাদরাসা খুলুক,তারপর দেখুমনে।
ভর্তি করলে বলো। আমি মুহতামিম সাহেবকে বলে দিমুনে,কম টাকায় ভর্তি নিয়ে নিবে। তাতেও কষ্ট হলে আমারও মাদরাসা আছে। এখানেও ভর্তি করতে পারো।
তোমার ছেলে কোথায়?
আমার ছেলে নাই।
তাইলে কাকে ভর্তির কথা ভাবছো?
আমি নিজেই মাদরাসায় পড়ি,এহনো বিয়া করি নাই।
আশ্চর্য ব্যাপার,বলো কি!
আমি খুব দ্রুত কথা বলতে লাগলাম। কারন-ইতোমধ্যে মাদরাসার গলিতে ঢুকে পড়েছি। অল্পতেই কথা শেষ করতে হবে।
কি পড়ো?
গতবছর হেদায়াতুন্নহু পড়েছি,এবছর কাফিয়া পড়বো
কোন মাদরাসায় পড়ো?
বক্তা মাওলানা আব্দুল বাসেত খানকে চিনেন?
হ্যাঁ,চিনি।
তার মাদরাসায় পড়ি।
মাদরাসার কি নাম?
জামিয়া ইসলামিয়া, রওহা,রায়গঞ্জ,সিরাজগঞ্জ।
ঢাকায় কবে এসেছো?
রোযার ঈদের পরে আসছি।
রিক্সা চালাচ্ছো কেনো?
করোনা ভাইরাসে আব্বার কাজ কাম বন্ধ। ঘরে ভাই বোন এবং মার খাওয়া দাওয়ার কোন ব্যাবস্থা নাই। তাই বাধ্য হয়ে রিক্সা হাতে নামলাম।
আহ্,হেদায়াতুন্নহু পড়ুয়া ছেলেটার বয়স বেশিনা। বাসা বাড়িতে মুতালাআ করার কথা ছিলো এখন তার। কিন্তু না,করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে সৃষ্ট অর্থ সঙ্কট তাকে সামান্য টাকা উপার্জনের জন্য রাস্তায় নামিয়ে দিয়েছে।
কোন কাজ এবং কর্মকেই ছোট করে দেখার আমি পক্ষে নই। কিন্তু তাই বলে স্কুল কলেজ আর মাদরাসার হোক একজন ছাত্রের এভাবে রাস্তায় নেমে পড়ার উদ্ভুত পরিস্থিতি তৈরী হওয়াও আমার কাছে ভালো লাগে না, আমার কষ্ট লেগেছে, ভীষন কষ্ট।
ব্যাথিত মনে জিজ্ঞেস করলাম-
পড়বানা আর?
নিয়ত আছে পড়ার।
কোথায় পড়বা?
সিরাজগঞ্জ ঐ মাদরাসাতেই পড়বো ইনশাআল্লাহ।
ঢাকাতে পড়ো,আমি ব্যাবস্থা করে দেই। তোমার কোন টাকা পয়সা লাগবেনা।
আমিতো ওখানে ভর্তি হয়ে গেছি। এ বছর থাক,আগামী বছর ঢাকায় আসার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।
ওহ,তোমার নামটা জানা হলোনা। কি নাম তোমার?
আমার নাম রবিউল, মানে রবিউল ইসলাম।
ততক্ষণে আমরা মারকাযুদ্ দিরাসার হেইটে দাঁড়ানো।
আচ্ছা,আমার মোবাইল নম্বরটা রাখো। প্রয়োজন মনে করলে যোগাযোগ কইরো, এমনকি এখানে চলেও আসতে পারো। আমি সাধারণত এখানেই থাকি।
জি আচ্ছা,দোয়া করবেন। আল্লাহ যেন আমাকে আলেম হওয়ার তাওফীক দান করেন।
বরং তুমি আমার জন্য দোয়া কইরো। তোমার যে ইস্তিকামাত ও দৃঢ়তা! আমাকে তা আবেগ আপ্লুত করেছে। তোমার মতো আমার জীবনে পরীক্ষা আসলে আমি ফেল করে যেতাম।
দোয়া চেয়ে চলে গেলো সে। তার যাওয়ার পথে অনেক্ষন তাকিয়ে রইলাম। কালপরিক্রমার বৈরিতার শিকার অবিচল একটি পর্বত মানব চলে যাচ্ছে মনে হলো আমার কাছে।
আহ্,না জানি কত রবিউল এভাবে রাস্তায় ধাক্কা খাচ্ছে। মাদরাসায় থাকলে তার হাতে থাকতো কুরআন। সে জায়গাটি দখল করে নিয়েছে এখন রিক্সায়র হ্যান্ডেল। মাদরাসাগুলো বিরান হয়ে আছে। মসজিদগুলো গির্জা সদৃশ হতে যাচ্ছে। অন্তরাত্মা সম্পন্ন আল্লাহ ওয়ালারা মসজিদ মাদরাসার নীরব অশ্রুবিসর্জনে অস্থির হয় আছেন। কবে এ অবস্থার অবসান ঘটবে?
লেখক: আলেম-শিক্ষাবীদ, পরিচালক: মারকাযুদ দিরাসাহ আল ইসলামিয়্যাহ-ঢাকা
-এটি