আব্দুল্লাহ আফফান
সহ-সম্পাদক
চাঁদ যখন পরিভ্রমণরত অবস্থায় কিছু সময়ের জন্য পৃথিবী ও সূর্যের মাঝখানে এসে পড়ে, তখন পৃথিবীর কোন দর্শকের কাছে সূর্য আংশিক বা সম্পূর্ণরূপে অদৃশ্য হয়ে যায় (কিছু সময়ের জন্য)। এই ঘটনাকে সূর্যগ্রহণ বলা হয়। মানুষ অত্যন্ত আনন্দ আর কৌতুহল নিয়ে সূর্যগ্রহণ এবং চন্দ্রগ্রহণ প্রত্যক্ষ করে।
অথচ সূর্য ও চন্দ্রগ্রহণের সময় হজরত মুহাম্মাদ সা. -এর চেহারা ভয়ে বিবর্ণ হয়ে যেত। তখন তিনি সাহাবিদের নিয়ে জামাতে নামাজ পড়তেন। কান্নাকাটি করতেন। আল্লাহর তায়ালার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতেন। সূর্যগ্রহনণের নামাজকে ‘সলাতুল কুসূফ’ বলে।
দশম হিজরীতে যখন পবিত্র মদীনায় সূর্যগ্রহণ হয়, ঘোষণা দিয়ে লোকদেরকে নামাজের জন্য সমবেত করেছিলেন রাসূল সা.। তারপর সম্ভবত তাঁর জীবনের সর্বাদিক দীর্ঘ নামাজের জামাতের ইমামতি করেছিলেন। সেই নামাজের কিয়াম, রুকু, সিজদাহ মোটকথা, প্রত্যেকটি রুকন সাধারণ অভ্যাসের চেয়ে অনেক দীর্ঘ ছিল।
জাহেলি যুগে মানুষ মনে করত, কোনো মহাপুরুষের জন্ম বা মৃত্যু কিংবা দুর্যোগ, দুর্ভিক্ষ প্রভৃতির বার্তা দিতে সূর্য বা চন্দ্রগ্রহণ হয়। ইসলাম এটাকে একটি ভ্রান্ত ধারণা আখ্যায়িত করেছে এবং ‘গ্রহণ’কে সূর্য ও চন্দ্রের ওপর একটি বিশেষ ক্রান্তিকাল বা বিপদের সময় বলে গণ্য করেছে।
মুগিরা ইবনু শু’বা রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেছেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পুত্র ইবরাহিমের মৃত্যুর দিনটিতেই সূর্যগ্রহণ হল। তখন আমরা সকলে বলাবলি করছিলাম, নবিপুত্রের মৃত্যুর কারনেই এমনটা ঘটেছে। আমাদের কথাবার্তা শুনে রাসূল সা. বললেন, সূর্য এবং চন্দ্র আল্লাহর অগণিত নিদর্শন সমুহের মধ্যে দু’টি নিদর্শন, কারোর মৃত্যু কিংবা জন্মগ্রহণের ফলে চন্দ্রগ্রহণ বা সূর্যগ্রহণ হয় না। (বুখারি: ১০৪৩, মুসলিম: ৯১৫)
সূর্যগ্রহণের নামাজ এবং করণীয়: সূর্য ও চন্দ্রগ্রহণের সময় মুমিনদের করণীয় হচ্ছে তাৎক্ষণিকভাবে একত্র হয়ে সালাত আদায় করা এবং আল্লাহর কাছে দোয়া করতে থাকা। এ সালাত আদায় করা নফল এবং এতে আজান ও ইকামত দিতে হয় না। তবে লোকজন ডাকার জন্য ‘আস-সালাতু জামিয়া’ (সালাত সমাগত) বা এ জাতীয় বাক্য ব্যবহার করা যাবে।
সমাবেশস্থলে জুমার নামাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত ইমাম উপস্থিত থাকলে তিনি সূর্যগ্রহণের সালাত জামাতে আদায় করাবেন। আর ইমাম বা তার প্রতিনিধি উপস্থিত না থাকলে একা একা সালাত করা যাবে। এ সালাত অন্যান্য সালাতের চেয়ে অধিক দীর্ঘ হওয়া উচিত। রাসূলুল্লাহ সা. এ সালাতের কেরাত, কেয়াম, রুকু, সেজদাসহ অন্যন্য আমলগুলোও অনেক দীর্ঘ করেছেন।
আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত তিনি বলেছেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জামানায় একবার সূর্যগ্রহণ হলো। গ্রহণ শুরু হবার সাথে সাথে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দ্রুত মসজিদের দিকে গেলেন এবং সকলকে মসজিদে আসতে আহ্বান জানালেন।
তিনি নামাজে দাঁড়ালেন এবং এত দীর্ঘ করলেন যে এই জামায়াতে আগে কখনো এমন করেননি। অতঃপর রুকূতে গেলেন এবং রুকূ এত দীর্ঘ করলেন যা আগে কখনো করেননি। অতঃপর দাঁড়ালেন কিন্তু সিজদায় গেলেন না এবং দ্বিতীয় রাকাআতেও কেরাত দীর্ঘ করলেন। অতঃপর আবার তিনি রুকূতে গেলেন এবং তা পূর্বের চেয়ে আরও দীর্ঘ করলেন। রুকূ সমাপ্ত হলে দাঁড়ালেন এবং এরপর সিজদায় গেলেন এবং তা এত দীর্ঘ করলেন যে, আগে কখনো এমনটা করেননি। অত:পর সিজদা থেকে দাঁড়িয়ে প্রথম দু’রাকাআতের ন্যায় দ্বিতীয়বারও ঠিক একইভাবে নামাজ আদায় করলেন। ততক্ষণে সূর্যগ্রহণ শেষ হয়ে গিয়েছে।
নামাজ সমাপ্ত হলে তিনি আল্লাহর হামদ (প্রশংসা) পেশ করে খুৎবা প্রদান করলেন, বললেন, সূর্য এবং চন্দ্র আল্লাহর অগণিত নিদর্শন সমূহের মধ্যে দু’টো নিদর্শন, কারোর মৃত্যু কিংবা জন্মগ্রহণের ফলে চন্দ্রগ্রহণ বা সূর্যগ্রহণ হয় না। অতএব, যখনই তোমরা চন্দ্রগ্রহণ বা সূর্যগ্রহণ প্রত্যক্ষ করবে তখনই আল্লাহকে ডাকবে, তাঁর বড়ত্ব ও মহত্ব প্রকাশ করবে এবং নামাজে রত হবে। (বুখারি: ১০৪৪, মুসলিম: ৯০১)
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বর্ণিত হাদিসে উল্লেখ আছে, রাসূলুল্লাহ সা. এ সালাতে কেয়াম, রুকু ও রুকু থেকে দাঁড়ানো অবস্থা অত্যধিক দীর্ঘায়িত করেছেন। এমনকি কেয়াম অবস্থায় প্রায় সূরা বাকারা তেলাওয়াত করার মতো সময় পরিমাণ অতিবাহিত করেছেন এবং রুকু থেকে দাঁড়িয়ে এর চেয়ে তুলনামূলক কম সময় অবস্থান করেছেন। আর দ্বিতীয় রাকাত প্রথম রাকাতের চেয়ে ছোট করেছেন। তিনি কেয়ামের মধ্যে কেরাত ছাড়াও তাসবিহ, তাহলিল, তকবির, তাহমিদ, দোয়া পড়েছেন বলে অন্য হাদিসে বর্ণিত আছে। সালাত আদায় শেষ হলে সূর্য পরিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত দোয়া করতে হয়।
হানাফি মাজহাবে অন্যান্য সালাতের মতো এ সালাতেও প্রতি রাকাতে একটি মাত্র রুকু আদায় করতে হয়। শাফিঈ মাজহাবে প্রতি রাকাতে দুটি রুকু করতে হয়।
অবশ্য হাদিসের বর্ণনাগুলোতে এ সালাতে রাসূলুল্লাহ সা. দুই বা ততোধিক রুকু করেছেন বলেই উল্লেখ রয়েছে। এ সালাতের রাকাত সংখ্যা দুই। তবে চার রাকাত বা তার বেশিও আদায় করা যায়। সে ক্ষেত্রে প্রতি দুই বা চার রাকাতের পর সালাম ফিরাতে হবে। সালাতের শেষে কোনো খুতবা পড়তে হয় না। কোনো কোনো বর্ণনায় রাসূলুল্লাহ সা. কর্তৃক খুতবা পাঠের কথা বর্ণিত থাকলেও তা সালাতের সংশ্লিষ্ট হিসেবে নয়; বরং তা ছিল ‘গ্রহণ’ সম্পর্কে জাহিলি যুগের ভ্রান্ত ধারণা নিরসনের জন্য প্রদত্ত বিশেষ বিবৃতি। (আল-আদাবুল মুফরাদ, ইমাম বুখারি)