জুবায়ের আহমাদ।।
করোনাকালীন বন্ধের কারণে চরম সঙ্কটের দিকে যাচ্ছে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা। অনেক শিক্ষার্থী আছে যারা এমনিতেই পড়ালেখার ব্যাপারে উদাসীন। শিক্ষকবৃন্দ ও পিতামাতার চাপে কিছুটা লেখাপড়া করে। প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় তারা আরো উদাসীন হয়ে পড়ছে। জাড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন বাজে নেশায়। পিতামাতার পক্ষেও তাদের নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব হয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘ বন্ধের কারণে অনেক শিক্ষার্থীর পড়ালেখা একেবারেই বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। কিশোররা বিভিন্ন জায়গায় বসে আড্ডা দিচ্ছে। আশঙ্কাজনকভাবে কিশোর অপরাধ বাড়তে পারে।
সবচেয়ে বেশি সঙ্কটে কওমি মাদরাসাগুলো। হিফজ বিভাগের লাখো শিক্ষার্থী মুখস্থ করা অংশ ভুলে যাচ্ছে। দীর্ঘ সময় এলাকায় থাকায় এদের চলাফেরা, আচার-আচরণে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। ৪-৫ বছরের অর্জন খোয়াতে বসেছে এসব শিক্ষার্থীরা। সরকারি/এমপিওভুক্ত শিক্ষকগণ সরকারি বেতন পাচ্ছেন কিন্তু কওমি মাদরাসার লাখ লাখ শিক্ষক কোনোরকম বেতন-ভাতা না পেয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় আর্থিক সঙ্কটে অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাবে। সব মিলিয়ে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা।
করোনাপরিস্থিতির দ্রুত সমাধান হবে বলেও মনে হচ্ছে না। তাহলে কি মাসের পর মাস এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধই থাকবে? এভাবে বছরখানেক বন্ধ থাকলে শিক্ষাব্যবস্থার পরিণতি কী হবে? করোনা, সামাজিক দূরত্ব ও নিরাপত্তার পাশাপাশি এগুলোও তো মাথায় রাখা দরকার। করোনা ভাইরাস ও শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্ত থেকে রক্ষা করা এ দুটো বিষয়কেই মাথায় রেখে বিকল্প কোনো ব্যবস্থার কথা ভাবতে সংশ্লিষ্টদের অনুরোধ করছি।
বিশেষত কওমি মাদরাসাগুলো খুলে দেয়ার ব্যাপারে চিন্তার অনুরোধ করছি। কারণ কওমি মাদরাসাগুলোর শিক্ষার্থীদের থাকা ও লেখাপড়ার পদ্ধতিটা একটু ভিন্ন। আমাদের দেশের হিফজ মাদ্রাসাগুলোর প্রায় সবই আবাসিক। এখানে শিক্ষার্থীরা বাইরে বের হয় না। অনেকটা পরিবারের মতোই। একটি শিক্ষার্থী যেমন পরিবারে ভাই-বোনের সঙ্গে থাকে, কওমি মাদরাসায়ও এভাবেই থাকে। বলা যায় একেকটা কওমি মাদরাসা বৃহদাকারের একেকটি পরিবার।
হিফজ প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকায় বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই নিজের গ্রামে ওপেন ঘোরাফেরা করছে। মানুষের সঙ্গে মিশছে। আমার মনে হয় এরচেয়ে মাদরাসার আবাসিক পরিবেশেই তারা বেশি নিরাপদ থাকবে। পরিবারে যেভাবে তারা থাকছে এভাবে মাদরাসায়ও তো থাকা যায়। সুস্থ থাকা নিশ্চিত হয়ে, দেহের তাপমাত্রা পরীক্ষা করে শিক্ষার্থীদের জন্য আবাসিক মাদরাসাগুলো খুলে দেয়া যায় কি-না এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের ভেবে দেখার অনুরোধ করছি।
অনেক প্রতিষ্ঠান আছে এমন, যেগুলোতে ওই এলাকার শিক্ষার্থীরাই পড়ে। বাইরের শিক্ষার্থী পড়ে না। আর ওইসব এলাকায় কোনো করোনা রোগী শনাক্তও হয়নি। প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিশুরা এলাকাজুড়ে ঘুরছে, বাজারে যাচ্ছে, ঘুড়ি উড়াতে বিকেলে দৌড়াচ্ছে হাজারো মানুষের সঙ্গে মিশছে। তাহলে সংশ্লিষ্ট এলাকার মাদরাসায় যেতে সমস্যা কোথায়? এদের জন্য উন্মুক্ত করে দিলেই বেশি ভালো। প্রতিষ্ঠান খোলা থাকলে শিশুরা একটি সীমাবদ্ধতার মধ্যে থাকবে। যা এখনের উন্মুক্ত অবস্থার চেয়ে বেশি নিরাপদ বলে মনে হয়।
কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান বিশাল বিশাল ক্লাসরুম আছে। তারা চাইলে ৩ ফুট নয়, ৫ ফুট দূরত্ব বজায় রেখেও শিক্ষার্থীদের বসাতে পারবে। ৩-৪ ফুট দূরত্ব বজায় রেখে এসব প্রতিষ্ঠান ক্লাস চালাতে পারে কি-না তা-ও ভেবে দেখা যায়। স্কুল-কলেজ ও আলিয়া মাদরাসায় সরকার চাইলে এমন নিয়ম করতে পারে, প্রতি ক্লাসে প্রতিদিন অর্ধেক শিক্ষার্থী ক্লাস করবে। জোড় রোল একদিন বিজোড় রোল একদিন। পাশাপাশি নিয়ম মানার ব্যাপারে প্রতিষ্ঠান প্রধানদের কঠোর নির্দেশনা। তাহলে শিক্ষার্থী কম হলে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে পাঠদান কিছুটা হলেও অব্যাহত রাখা যাবে।
শিক্ষা ব্যবস্থাকে বড় ধরণের ক্ষতি থেকে রক্ষা করতে হলে বিকল্প কিছু বোধহয় আমাদের ভাবতেই হবে। আশা করি কর্তৃপক্ষ ভেবে দেখবেন। লেখক: কলামিস্ট; পরিচালক, বাইতুল হিকমাহ একাডেমি, গাজীপুর
-এএ