সাখাওয়াত রাহাত
আলহামদুলিল্লাহ! ছাত্রজীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বেশ কয়েকজন মুশফিক উস্তাদের সান্নিধ্য পেয়েছি।কাছ থেকে তাদের দেখেছি আর অভিভূত হয়েছি।জাগতিক শিক্ষায় শিক্ষিত পরিবারের সন্তান হিসেবে স্রোতের বিপরীতে এসে মাদরাসায় লেখাপড়ার ক্ষেত্রে যখনই পা হড়কানোর সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, তখনই তাদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ দিক নির্দেশনায় আবারো ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি পেয়েছি। সেসব মুশফিক উস্তাদের অন্যতম ছিলেন আল্লামা ইসহাক ফরিদী রহঃ। সংক্ষেপে যার পরিচয় দেয়া যায় এভাবে- 'একটি নাম। একটি আদর্শ। একটি দর্শন। একটি ইতিহাস। একটি চলন্ত লাইব্রেরী। একজন কিংবদন্তি।'
আব্বুর সাথে প্রথম যেদিন কুমিল্লা রানীর বাজার মাদরাসায় ভর্তি হতে যাই সেদিনই তাঁর নামটি প্রথম শুনি। মাদরাসার গেটের সামনেই দেখি এক বই বিক্রেতা নানারঙা বইয়ের পসরা সাজিয়ে বসে আছে। ছোটবেলা থেকেই ছিলাম বইয়ের পোকা। আব্বুর কাছে তাই বই কিনে দেয়ার বায়না ধরলাম। আব্বু কিনে দিলেন ইসহাক ফরিদী রহ. রচিত ছোট বই 'সিনেমার কুফল'। এরপর নুরানী মকতবের পাট চুকিয়ে হিফজ বিভাগে ভর্তি হওয়ার পর ঘন ঘন তাঁর নাম শুনতে লাগলাম। হিফজ বিভাগের উস্তাদ হাফেজ আমান উল্লাহ সাহেবের অধিকাংশ নসিহতেই হুজুর রহ. নাম উচ্চারিত হতো। পরে জানতে পারি, তিনি ছিলেন ইসহাক ফরিদী রহ. আপন খালাতো ভাই।
হিফজ যখন শেষের দিকে তখন কিতাব বিভাগের সেরা ছাত্র জহির ভাইয়ের সাথে আমার হৃদ্যতা গড়ে ওঠে। তার হস্তাক্ষরও ছিল মাদরাসার মধ্যে সবচে' সুন্দর। আলাপ করে জানতে পারি তিনি শুরুতে পড়েছেন ইসহাক ফরিদী রহ. এর চৌধুরীপাড়া মাদরাসায়। হাতের লেখার হাতেখড়িও সেখানেই। মনে মনে সংকল্প নিয়ে ফেলি- হিফজ পরবর্তী শিক্ষাদীক্ষা তাহলে সেখানে গিয়েই হবে।
বাসায় যখন বললাম কিতাব বিভাগের লেখাপড়া ঢাকার চৌধুরীপাড়া মাদরাসায় করতে চাই, আব্বু আম্মু কেউই রাজি হলেন না। প্রথমত কুমিল্লা ছেড়ে সুদূর ঢাকায় অতটুকু আমি কীভাবে থাকবো? দ্বিতীয়ত, আব্বুর ধারণা- মাদরাসা যেহেতু আমি পসন্দ করেছি তাই বেশি ভালো হবে না। অগত্যা মেজমামাকে ধরে অনেক কষ্টে বাসায় রাজি করালাম। তবে আব্বু শর্ত এঁটে দিলেন__ মাদরাসা তার কাছে ভালো না লাগলে আমাকে নিয়ে সোজা কুমিল্লা চলে আসবেন।
রোজার ঈদের সপ্তাহখানেক পর আমরা চৌধুরীপাড়া মাদরাসার উদ্দেশ্য রওয়ানা হই। মাদরাসার গেটে ঢুকার পর ভর্তিচ্ছু ছাত্রদের ভীড় দেখে অবাক হলাম। কুমিল্লায় কখনো নতুন ছাত্রদের এতটা ভীড় চোখে পড়েনি। ব্যাপারটা আব্বুর মনে ধরল। ভীড় ঠেলে তিনি ভর্তিফরম সংগ্রহ করলেন। প্রাথমিক কাজ শেষে যখন ফরম জমা দিতে গেলেন, বিপত্তিটা ঘটল তখনই। ভাইস প্রিন্সিপাল সাহেব সাফ জানিয়ে দিলেন__ কোটা শেষ, তাই ভর্তি নেওয়া যাবে না! আব্বুও নাছোড়বান্দা, যেভাবেই হোক আমাকে ভর্তি করাবেন। এ সময় আব্বু দেখা পান আমার আরেক প্রিয় উস্তাদ মাওলানা জাফর আহমদ আশরাফী রহ. এর। (আব্বুর কাছে পরে শুনেছি__ আমি যখন কোলের বাচ্চাটি তখন তাঁর কোলেও কিছুটা সময় অবস্থান করেছিলাম।) পূর্ব পরিচিত ডাক্তার সাহেবের ছেলেকে ভর্তি করাতে এবার এগিয়ে এলেন প্রিয় উস্তাদ জাফর আশরাফী রহ.।
আমাদের নিয়ে তিনি সরাসরি চলে গেলেন প্রিন্সিপাল ইসহাক ফরিদী রহ. এর রুমে। এই প্রথম দেখতে পেলাম বহুল প্রতীক্ষিত সেই নুরানী চেহারা। তবে মনের ক্যানভাসে তাঁর যেই ছবি এঁকেছিলাম, বাস্তবে তিনি তেমন নন। একেবারে সাদাসিধে, নিপাট ভদ্রলোকটাইপ। মাঝে মাঝে মুচকি হাসি যেন তাঁর ভেতরে লুকিয়ে থাকা সৌন্দর্যের বিচ্ছুরণ ঘটাচ্ছিল। ভয় আর উত্তেজনায় আমি রীতিমতো কাঁপছিলাম। মাঘের হাড়কাঁপানো শীতেও আমার শরীর ঘেমে একাকার। ইসহাক ফরিদী রহ. আমাকে বললেন, খোকা! একটু তিলাওয়াত শোনাও তো। কাঁপা কাঁপা গলায় একটু পড়লাম। হুজুর রহ. বললেন, ভালো করে লেখাপড়া করবে খোকা। যেন ভালো ফলাফল অর্জন করতে পারো। মুহাক্কিক আলেম হতে পারো।
চৌধুরীপাড়া মাদরাসায় ভর্তি হয়ে পড়া শুরু করলাম। কিন্তু যাকে উদ্দেশ্য করে এখানে ভর্তি হলাম, কেন জানি তাঁর কাছে যেতে খুব ভয় পেতাম। নিচের দিকে পড়তাম বলে ক্লাসেও তাঁকে পেতাম না। ভিতরে ভিতরে একটা অতৃপ্তি কাজ করছিল। উপর শ্রেণীর ভাইদের কাছে যখন হুজুরের ক্লাসের বিবরণ ও নানান খুনসুটির কথা শুনতাম, হাহাকারটা আরো বেড়ে যেত। ভাবতাম, ইশ! কবে যে উপরের শ্রেণীতে উঠবো!
হুজুর যেহেতু আমাদের ক্লাস নেন না, তাই আমার ধারণা ছিল তিনি হয়তো আমার নামও জানেন না। কিন্তু আমার এ ধারণা যে অমূলক ছিল কিছুদিন পরেই টের পেলাম। একদিন সকালে ছাত্রাবাসের ছাদে আনমনে কিছু একটা করছিলাম। হঠাৎ পরিচিত কণ্ঠে অপ্রত্যাশিতভাবে নিজের নামটি শুনে আঁতকে উঠি। 'সাখাওয়াত! একটু এদিকে এসো তো।' এযে স্বয়ং ইসহাক ফরিদী রহ.!
হুজুর রহ. প্রখর ধীশক্তি দেখে ঈর্ষা হতো। মাদরাসার ছোট বড় প্রায় সব ছাত্রকেই তিনি চিনতেন। অধিকাংশের নামও জানতেন। এজন্যই মসজিদের দোতলায় সকল ছাত্রকে জমায়েত করে যখন উপদেশ দিতেন, তখন সহস্রাধিক ছাত্রের মাঝেও অন্য কোন মাদরাসার ছাত্র দেখলে তাকে চিহ্নিত করতে পারতেন সহজেই।
যে বছর 'নাহবেমীর' ক্লাসে পড়ি, সে বছর হুজুর রহ. কুমিল্লায় হাফেজ মাওলানা উবায়দুল্লাহ রহ. এর ইকরা রওযাতুল আতফাল মাদরাসায় এলেন। আব্বু ছিলেন এ প্রতিষ্ঠানের সভাপতি। উবায়দুল্লাহ রহ. আব্বুকে হুজুর রহ. এর সাথে পরিচয় করাতে যাবেন, এমন সময় হুজুর রহ. বললেন, আমি তাকে চিনি। তিনি হচ্ছেন ডাক্তার সাহেব। তার ছেলে আমার মাদরাসায় 'নাহবেমীর' ক্লাসে পড়ে। আব্বু রীতিমতো অবাক হলেন। তিন বছর আগের সেই সামান্য সাক্ষাতে আব্বুকে তিনি মনে রেখেছেন!
ইসহাক ফরিদী রহ. এর মাঝে অনেক গুণের সন্নিবেশ ঘটেছিল। তিনি বহুছাত্রের লেখাপড়ার খরচ চালাতেন। এমনকি কোন কোন ছাত্রকে দারুল উলুম দেওবন্দেও পাঠিয়েছেন। তাঁর মেহমানদারির হাত ছিল অনেক প্রশস্ত। হুজুরকে কখনো একা খাবার খেতে দেখা যেত না। কোন ছাত্রকে দিয়ে কিছু আনালে খুচরো টাকা কখনো ফেরত নিতেন না। পরীক্ষার ছুটিতে একবার তিনদিনের জন্যে তাবলিগে গেলাম মধ্যবাড্ডার এক মসজিদে। দুপুরে 'দস্তরখানের আমল' শেষে সবাই ঘুমিয়ে আছি। ঘুম থেকে জেগে দেখি হুজুর তিন-চার রকমের ফল, বিস্কুট, চানাচুর ইত্যাদি নিয়ে হাজির। হাস্যোজ্জ্বল মুখে বলছেন__ 'আল্লাহর রাস্তায় বের হওয়া প্রিয়জনদের নুসরত করতে চলে এলাম।'
সময়ের প্রতি তিনি ছিলেন খুবই যত্নবান। দেখা যেত তিনি কিছু একটা লিখছেন এর মাঝে মোবাইলে কল এলো, লেখা বন্ধ না করেই তিনি কথা বলছেন! শত ব্যস্ততার মাঝেও কোন পড়া নিয়ে তাঁর কাছে গেলে তিনি খুব সুন্দর করে তা বুঝিয়ে দিতেন।
তাঁর যে বিষয়টি আমাকে সবচে বেশি আলোড়িত করেছে তা হলো, মাদরাসার দুষ্টু ও বিগড়ে যাওয়া ছাত্রদের ব্যাপারেও তিনি ছিলেন যথেষ্ট আশাবাদী। তাঁর থিওরি ছিল, এরা আলেম না হলেও অন্তত ভালো মানুষ হোক! এমনও হয়েছে বহুবার, কোন ছাত্র আর পড়বেনা বলে বাড়ি চলে গেছে; হুজুর নিজে সে ছাত্রের বাড়ি গিয়ে তাকে মাদরাসায় ফিরিয়ে এনেছেন।
জুমার নামাজে তাঁর কান্নাভেজা তিলাওয়াত শুনে চোখ ভেজাননি এমন মুসল্লি নুর মসজিদে খুব কমই ছিল। ছাত্রদের জন্য চেষ্টা-মেহনতের পাশাপাশি তাদের জন্য প্রাণ খুলে দোয়া করা ছিল তাঁর অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
শিল্প সাহিত্যেও ছিল তাঁর অবাধ বিচরণ। আমাদের গুলিস্তাঁ ক্লাসে একবার একটা 'মাসনভি' এলোঃ
خلاف رائے سلطاں راۓ جستن
بخون خويش باشد دست شستن
اگر شہ روز را گويد شب ست ايں
ببايد گفت اينک ماہ و پروين
যে হুজুর 'গুলিস্তাঁ' পড়াতেন, কি মনে করে যেন পংক্তিগুলোর অর্থ করতে গিয়েও করলেন না। আমাদের সহপাঠী ইসহাক ফরিদী রহ. এর একমাত্র ছেলে সায়েম ভাইকে বললেন, আগামীকাল তোমার আব্বুর কাছ থেকে এর অর্থ জেনে এসে আমাদের বলবে। পরদিন সায়েম ভাই যে অর্থ বললেন তা শুনে আমরা সকলেই মুগ্ধ হয়ে গেলাম।
অনুবাদটি ছিল নিম্নরূপ-
''রাজার বিপরীত কথা বলাটা,
তরবারি তলে নিজ মাথা রাখাটা।
রাজা যদি বলে- 'এটা দিবা নয়; রজনী',
'ঐ চাঁদ তারা দেখা যায়'- বলা চাই তখনি।''
সেদিনের পর থেকে হুজুরের কাছে ক্লাস করার তৃষ্ণাটা বেড়ে যায় বহুগুণে। বছরের শেষ দিকেই বাতাসে খবর ভাসতে থাকে__ তিনি আমাদেরকে হিদায়াতুন্নাহু কিতাবটি পড়াবেন। রমজানের পর দেখা গেল গুঞ্জনটা মোটেও মিথ্যে ছিলনা। সত্যিই তিনি আমাদের পড়াবেন।
দরসের প্রথমদিন সামান্য নসিহতের পর তিনি দশ-পনের মিনিটে এমনভাবে ইলমুননাহু তথা আরবি ব্যাকরণশাস্ত্রের সারসংক্ষেপ আলোচনা করলেন__ নাহুশাস্ত্রে আমাদের সবচে' দূর্বল ছাত্রটিও নতুন করে আশাবাদী হলো। তাঁর দরস দানের ধরণ ছিল বৈচিত্র্যময়। প্রথমে তিনি কঠিন শব্দগুলোর পরিচয় সহজভাবে তুলে ধরতেন। এরপর পুরো সবকটি নিজের মতো করে বুঝিয়ে দিতেন। দু'য়েক জনের কাছ থেকে তা শুনতেন। এরপর কিতাব থেকে ধরিয়ে দিতেন। কিতাবের বাইরের বিভিন্ন উদাহরণ দিয়ে নাহুর নিয়ম-কানুন বুঝিয়ে দিতেন। এ ক্ষেত্রে বাংলায় এর ব্যবহার কেমন সেটাও দেখিয়ে দিতেন। সবশেষে কিতাব বন্ধ করে ইবারত (মূলপাঠ)-সহ মুখস্থ বলে দিতেন। এসব কারণেই হয়তো তাঁর পড়ানো কিতাবটিকে সবচে' সহজ মনে হতো।
নিঃসন্দেহে তিনি ছিলেন আল্লাহ তায়ালার প্রিয়বান্দা। তাহাজ্জুদে নিয়মিত কয়েক পারা তিলাওয়াত করতেন। মাঝে মাঝে আসরের পরে তাঁর রুমে উঁকি দিয়ে দেখতাম আবু বকর সোহাইল ভাইয়ের কণ্ঠে 'আমার লাশের খবর বন্ধু আসবে একদিন জানি..' শুনছেন আর চোখের জলে তাঁর গাল ভিজে যাচ্ছে।
হতভাগা আমি 'হিদায়াতুন্নাহু'র বছর দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষার খেয়ার (ক্লাস বিরতি) চলাকালে তাঁকে হারিয়ে ফেলি চিরতরে। নানুপর মাদরাসায় যাওয়ার পথে ২০০৫ সালের ৫ই জুন দিবাগত রাতে সড়ক দুর্ঘটনায় শাহাদাত বরণ করেন প্রিয় রাহবার, প্রিয় মনীষী আল্লামা ইসহাক ফরিদী রহ.। আমার জীবন গঠনে তাঁর অবদান সবচেয়ে বেশি। মোনাজাত করি আল্লাহ তায়ালা যেন তাঁকে জান্নাতে উঁচু মাকাম দান করেন।
আমিন।