উবায়দুল্লাহ তাসনিম।।
ভারতজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে অন্ধকার। শিরক -বিদআতের ছড়াছড়ি। অপসংস্কৃতির সয়লাভে ভেসে যাচ্ছে ভারতের মুসলমানরা। সর্বত্র ইংরেজ আধিপত্যবাদের জোয়ার। চারদিকে শিখ শক্তির একটা জয়জয়কার প্রভাব। দেশের মানুষজন সেই শক্তির যাতাকলে নিষ্পেষিত। শোষিত। লুণ্ঠিত।
এমনই এক দুঃসময়ে আলোর মশাল হাতে নিয়ে এলেন এই মহান মনীষী। ঈমানি চেতনার বাতিঘর। সাহাবায়ে কেরাম ঈমানদীপ্ত জীবনের উত্তম নমুনা। দিশা হারানো জাতির সঠিক পথের দিশারী। সালাফের মহান উত্তরসুরী। ইংরেজ শাসিত ভারতকে 'দারুল হারব'( কাফের রাষ্ট্র) ফতোয়া প্রদানকারী শাহ আব্দুল আজিজ দেহলভির চেতনার ধারক, জিহাদি স্পৃহার রক্ষক, মহান দাঈ সাইয়েদ আহমদ শহিদ বেরলভি রহ।
ঊনবিংশ শতকের গোড়ার দিকে বাংলাসহ গোটা ভারতবর্ষে মুলমান কর্তৃক যে আন্দোলন চলমান ছিল এর প্রাণ পুরুষ ছিলেন আহমদ শহিদ বেরলভী রহ। 'তরীকায়ে মুহাম্মদিয়া ' নামে তিনি একটি সংস্কার আন্দোলনের ধারা চালু করেন। তার আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল শিখ ও ইংরেজদের প্রভাবে সমাজে ছড়িয়ে পড়া কুসংস্কার, অপসংস্কৃতির দূরীভূতকরণ এবং অখন্ড ভারতে ইসলামি শাসন কায়েম করা।
মূলত সাইয়েদ সাহেব দ্বিতীয় সহস্রাব্দের মুজাদ্দিদ শায়েখ আহমদ সেরহেন্দী (মুজাদ্দিদে আলফে সানী) ও শাহ ওয়ালিউল্লাহর সংস্কার আন্দোলনে চেতনাঋদ্ধ ছিলেন।
তিনি ১৭৭৬ সালের ১৮ ই নভেম্বর, ভারতের অযোধ্যার রায়বেলীতে জন্ম গ্রহণ করেন । ছোটবেলায় খেলাধুলার প্রতি বেশি মনোযোগ ছিল। কপাটি খেলা (সৈন্যদের বীরত্বমূলক খেলা) ছিল তার বেশ আগ্রহের। তিনি যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় বেশি আরামবোধ করতেন। প্রতিদিন সূর্যদোয়ের পর ঘন্টাখানেক সময় কুস্তিখেলায় পার করতেন। পারিবারিক রীতি অনুযায়ী চার বছর বয়সে তিনি মক্তবে ভর্তি হন।
তিনি তার যৌবনে (বয়স যখন ১৭/১৮) পদার্পন করলে, তার পিতা মারা যাবার পর পারিবারিক দায়িত্ব তার উপর অর্পিত হলেও তার লক্ষ্য অর্জনের পথে তা বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। ইংরেজ শক্তি খর্ব করার উদগ্র যে বাসনা ছোট বয়স থেকে তাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল তার ব্যত্যয় ঘটেনি।
২১ বয়সে (১৮০৭সাল) আহমদ শহিদ শাহ ওয়ালি উল্লাহর সুযোগ্য সন্তান শাহ আব্দুল আযিযের হাতে কাদরিয়া, চিশতিয়া, নকশবন্দিয়া তরিকায় বায়াত গ্রহণ করেন। শাহ আব্দুল আজিজের কাছে দিল্লিতে অবস্থানকালে তিনি নতুন উদ্যমে শিক্ষার প্রতি মনোনিবেশ করেন। কিছুদিন ভালো পড়াশোনা চললেও তা আর অব্যাহত থাকেনি।
পড়তে বসলেই সবকিছু কেমন হয়ে যায়। চোখে ঝাপসা দেখায়। বইয়ের অক্ষর নজরে আসে না। চোখের তারায় অদৃশ্য কি যেনো ভাসতে থাকে। শাহ আব্দুল আযিয তা বুঝতে পেরে পড়াশোনার ব্যাপারটা এখানেই বন্ধ করে দিলেন। তার চেতনাকে নিজস্বখাতে প্রবাহিত করলেন। আধ্যাত্মিক শিক্ষায় তাকে আরো উন্নীত করলেন।
দিল্লী থেকে মাতৃভূমি রায়বেরীলিতে আসার পর সাইয়েদ আহমদের বিবাহের কাজ সমাপ্ত হয়। বিবাহের পর দ্বিতীয়বার দিল্লীতে ভ্রমণ করলে শায়খের ইশারায় নওয়াব আলী খানের সেনাবাহিনীতে তিনি যোগদান করে ট্রেনিং নেন । ইংরেজ বিতাড়নের প্রশ্নে নওয়াব সাহেবের সাথে সাইয়েদ আহমদ শহিদের মিল ছিল।
অবশ্য পরবর্তীতে সাইয়েদ সাহেব যখন ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলেন, নওয়াব সাহেবের সাথে ইংরেজদের আপোষকামিতা হয়ে গেছে, তখন তিনি এই বিশ্বাসঘাতকতার ফলে স্পষ্ট বাহিনী থেকে কেটে পড়েন।
দিল্লীতে থাকাকালীন আহমদ শহিদ মুরব্বীর নির্দেশনা অনুযায়ী দিল্লির আকবরাবাদী মসজিদে অবস্থান করছিলেন। মূলতঃ শাহ আব্দুল আযিয কুসংস্কারের বেড়াজাল ছিন্ন করে বিশুদ্ধ ইসলামী সমাজ বিনির্মানের যে স্বপ্ন দেখে আসছিলেন, সে স্বপ্ন পূরণের দায়িত্ব সাইয়েদ সাহেবের উপর বর্তায়। তিনি সেখানে অবস্থানকালে তার হাতে বায়াত গ্রহণের জন্য দিকদিগন্ত থেকে ঈমানি চেতনাঋদ্ধ মানুশজন ছুটে আসে। বালাকোটের অন্যতম নেতা ঈসমাইল শহিদসহ বিভিন্ন আলেম উলামা তার মজলিশে হাজির হয়ে বায়াত গ্রহণ করেন। এ সময় দ্বীনি তাকাযা পূরণের নিমিত্তে নানান জায়গা থেকে চিঠি আসতে থাকে। দ্বীনি নেতৃত্ব পাওয়ার আশায় কাতর মানবতার ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি বিভিন্ন স্থানে সফর করেন।
সাইয়েদ সাহেব সামাজিক সংস্কার আন্দোলনে ব্যাপক অবদান রেখেছেন। কবর পূজা, মাজার পূজা ইত্যাদির মতো শিরকি বিষয়াদি ভারতের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়ছিল। তিনি এসব কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রাণপণ লড়ে যান। সেকালে বিধবা বিবাহকে দোষের মনে করা হতো, এর রোধকরণে আহমদ শহিদ নিজের ৮০ বছর বয়স্কা বিধবা বোনকে বিবাহ দেন। এবং তিনি নিজেও বিধবা নারী বিয়ে করেন।
তখন রাস্তার নিরাপত্তা অনিশ্চিত থাকার অজুহাতে হজ ফরজ নয় বলে জনসাধারণ্যে ফতোয়া প্রচলিত ছিল। ফলত, হজের মত একটি বিধানের অবলুপ্ত হওয়ার অবস্থা সৃষ্টি হয়। মহান হজের সেই পুণর্জাগরণে সাইয়েদ সাহেব তাই হজের পালনের দৃঢ় ইচ্ছা করেন। তিনি তার এই অভিপ্রায় চিঠি ইত্যাদি মারফত গোত্রীয় লোকজনসহ অন্যান্য ভক্তবৃন্দের জানিয়ে হজের প্রতি তাদের উদবোদ্ধ করেন।
১২৩৬ হিজরীর(১৮২১ সাল) শাওয়ালের শেষ তারিখে মহিলাসহ প্রায় ৪০০জনের একটা জামাত নিয়ে নিজ বাসভবন থেকে বেরিয়ে পড়েন হজের মহান সফরে। পথিমধ্যে বিভিন্ন স্থানে জাহাজ নোঙ্গর করে হাজার হাজার লোকজনের বায়াত নেন। তাদের ইসলাহে ওয়াজ নসিহত করেন। এরপর, কলকাতা থেকে ১১ টি জাহাজে করে ৬৯৩ জনের একটা কাফেলা নিয়ে পবিত্র মক্কা অভিমুখে রওয়ানা দেন। ১২৩৭ হিজরীর শাবানে কাফেলাটি মক্কা মুকাররমায় পৌঁছতে সক্ষম হয়। হজ সমাপান্তে কাফেলার লোকজনসহ সেখানে বেশ কিছুদিন (দুইবছর দশ মাস)অবস্থান করেন। ১২৩৮ হিজরীর ১৫ শাওয়াল মক্কা হতে প্রত্যাবর্তন করেন।
শাহ আহমদ শহিদ হজের এই সফরসহ বিভিন্ন সফরে মুজাহিদ সংগ্রহের কাজ করেছেন। তিনি তার মুরিদানদের থেকে ইসলাহের বায়াতের সাথে সাথে জিহাদেরও বায়াত নিতেন। এর মাধ্যমে মুজাহিদ সংগ্রহের কাজটার পাশাপাশি সেকালের প্রান্তিক সুফিদের তৈরী ' জিহাদ তরিকতের পরপন্থী' এই ধারণার বিলুপ ঘটান।
সাইয়দে সাহেব হজ থেকে এসে পূর্ণ উদ্যম নিয়ে আজাদি আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়েন। একের পর এক আন্দোলনের ধারা অব্যাহত থাকে। আর, বালাকোট ছিল সেসব আন্দোলনেরই শেষ ধাপ। ১৮৩১ সালের ৬ মে মোতাবেক ১২৪৬ হিজরীর ২৪ যুলকাদা জুমাবার সংগঠিত হয় ঐতিহাসিক বালাকোটের (বালাকোট শহর পাকিস্তানের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের খাইবার-পাখতুনখাওয়ার (সাবেক উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ) হাযারা অঞ্চলভুক্ত মানসেহরা জেলা থেকে ৩৮ কি: মি: পূর্ব-উত্তরে অবস্থিত। চারিদিকে উচ্চ পাহাড়ঘেরা দুর্গম এই ঐতিহাসিক শহরটি আকর্ষণীয় পর্যটনস্থল হিসাবে বেশ প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। শহরটি কাগান উপত্যাকার প্রবেশমুখ।
লালাসার লেক থেকে উৎসারিত কুনহার নদী এই শহরের মধ্য দিয়ে বয়ে পাকিস্তান শাসিত কাশ্মীরে ঝিলাম নদীর সাথে মিলিত হয়েছে। জনৈক বালাপীরের নামানুসারে এই অঞ্চলের নামকরণ করা হয় বলে জানা যায়। প্রাচীন বালাকোটে যেখানে ঐতিহাসিক যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল তা ছিল পার্শ্ববর্তী মেটিকোট টিলা ও ঝরণা এলাকায়। উল্লেখ্য, ২০০৫ সালের ৮ই অক্টোবর এক ভয়াবহ ভূমিকম্পে শহরটি সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। পরবর্তীতে সৌদি আরব, আরব আমিরাত ও পাকিস্তান সরকারের যৌথ প্রচেষ্টায় শহরটি আবার গড়ে তোলা হচ্ছে। সূত্র : উইকিপিডিয়া)
যুদ্ধ। সাইয়েদ সাহেবসহ অধিকাংশ মুজাহিদ মসজিদ -ই বালায় অবস্থান করেন। হঠাৎ তিনি শিখদের উপর আক্রমণের উদ্দেশ্য সেখান থেকে বেরিয়ে মসজিদে যেরিনে যান। এরপর সেখান থেকে মেটিকোট উপত্যকার পাদদেশের দিতে এগিয়ে গেলে পাদদেশে অবস্থানরত অনেক শিখ সেনা নিহত হয়। কিন্তু এরই মধ্যে মেটিকোট টিলা শিখ সৈন্যে ভ'রে গেছে। তারা বিভিন্ন দিক থেকে দলে দলে নেমে এসে মুসলিম বাহিনীতে জোরেশোরে আক্রমণ চালায়।
এই বিশাল অসম যুদ্ধে মুসলমানদের লড়তে হয়েছিল শিখ, ইংরেজ, কালের মুনাফেক সীমান্তের অধিবাসী পাঠান সম্মিলিত শক্তির বিরুদ্ধে। শিখদের সৈন্যসংখ্যা ১০০০০ হাজার (কেউ কেউ ২০ হাজারের কথাও বলেন)। মুসলমান সর্বসাকুল্যে ৭০০ জন। দৃশ্যটা কেমন যেনো বদর যুদ্ধের মতই। উভয় পক্ষের ভীষণ লড়াই শুরু হলে সাইয়েদ আহমদ শহীদ সবার সামনে থেকে লড়ে যান। যুদ্ধের একপর্যায়ে মেটিকোটের ঝর্ণায় তিনি শহিদ হন। মুজাহিদদের বড়ো একটা অংশ তখনও সাইয়েদ সাহেবের মৃত্যুখবর জানতে পারেননি। তার সন্ধানে ছুটোছুটি করে তাদের অনেকেই শহিদ হন।
যুদ্ধের এক পর্যায়ে তৃণমূল নেতা ঈসমাঈল শহিদও শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করেন। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নানা মুসলিম বাহিনী বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধ করে করে শহীদ হন।
ঐতিহাসিক বালাকোট ইস্যুটা ছিল বড়ই মর্মান্তিক। বড়ো বেদনার। সবকালেই কিছু জীবন্ত মুনাফিক থাকে। এখানেও এর ব্যতিক্রম হল না।
বালককোটের আগেও শিখদের সাথে মুসলমানদেন কয়েকটা যুদ্ধ হয়েছে এর সবকটিতেই মুসলমানদের পাল্লা ছিল ভারী। সরাসরি যুদ্ধে মুসলমানদের ঈমানদীপ্ত চেতনার সামনে কুলিয়ে ওঠা সম্ভব না। কূট কৌশল ও ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নিতে হবে। হলোও তাই। শিখরা সীমান্তবর্তী পাঠানদের প্রলোভন দিয়ে নিজের সহায়তা শক্তি সঞ্চয় করল। ষড়যন্ত্রের যাতাকলে আটকে পড়া পাঠানরা মুসলিম বাহিনীর সব তথ্য সরবরাহ করে শিখদের বিজয়ে সহায়তা করল।
যুদ্ধে ৩০০ মুসলমান শাহাদাত বরণ করেন। শিখরা মরে ৭০০জন। যুদ্ধ শেষে শিখরা বালাকেটের বাড়িঘর ইত্যাদিতে আগুন লাগিয়ে দিলে মুসলমানদেরকে বেশ ক্ষয়-ক্ষতির সম্মুখে পড়তে হয়। এতে সাইয়েদ সাহেবেরও অনেক গুরত্বপূর্ণ রচনা, পুস্তাকাদি, বিভিন্ন পত্রাবলীর পান্ডুলিপি, বক্তৃতার অনুলিপিসহ তার রোজনামচা ও জীবনবৃত্তান্তের বর্ণণায় রচিত 'নূরে আহমদি' ও ছিল।
বালাকোট সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসী ইংরেজ শক্তির খর্ব করে ভারতের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠায় অপূর্ব অবদান রেখোছে। বালাকোট পরবর্তী সাম্রাজ্যবাদ শক্তি বিলুপ সাধনে যতগুলো দুর্বার আন্দোলন গড়ে উঠেছে এ সবকটির পিছনে বালাকোটের ভূমিকা ছিল সক্রিয়।
বালাকোটের সাময়িক ব্যর্থতা পরিলক্ষিত হলেও মূলত এই বালাকোটের চেতনাঋদ্ধ পরবর্তী মর্দে মুজাহিরা অবিরাম লড়ে গেছেন আগ্রাসী ইংরেজ শক্তির বিরুদ্ধে। যেটা ১৮৫৭ সালে মহাবিপ্লবের (সিপাহি বিপ্লব) রূপ নেয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৮৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ঐতিহাসিক দারুল উলূম দেওবন্দ।
লেখক: শিক্ষার্থী
ওআই/আবদুল্লাহ তামিম