আওয়ার ইসলাম: ইসলামী শ্রমিক আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের রাজনৈতিক উপদেষ্টা মুহা. আশরাফ আলী আকন মে দিবস উপলক্ষে বলেন, মে দিবস বিশ্বের সকল শ্রমিকের কাছে মহান দিবস হিসেবে বিবেচিত। মে দিবস একই সাথে বেদনার, বিজয় উৎসবের এবং সংগ্রামী শপথ নেয়ার দিন। মে দিবসের কথা মনে আসলে ভেসে ওঠে পুজিবাদী অর্থনীতির একটি বিভৎস চেহারা। পুঁজিবাদের চেহারা যে কত কুৎসিত, কত ভয়ংকর, ও কত অমানবিক তার জীবন্ত সাক্ষী মহান মে দিবস। মে দিবসের ইতিহাস পাখির মতো গুলি করে শ্রমিকদের হত্যা করার ইতিহাস। মে দিবসের ইতিহাস অধিকার আদায়ে দাবী জানানোর অপরাধে ফাসির কাষ্টে ঝোলার ইতিহাস। মে দিবসের ইতিহাস মানবসৃষ্ট গোলামীর জিঞ্জির হতে মুক্ত হওয়ার ইতিহাস। মে দিবসের ইতিহাস জেল জুলুম ও মৃত্যুর ভয়কে জয় করার ইতিহাস।
তিনি বলেন, পৃথিবীতে অনেক আন্দোলন বিপ্লব ও রক্তক্ষয়ী ঘটনা ঘটেছে কিন্তু মে দিবসের ঘটনা এতই আবেদনময়ী হয়েছিলো তা সারা বিশ্বের মানুষের কাছে সাড়া জাগিয়েছিলো। আজ থেকে ১৩৪ বছর আগে শিকাগোর হে মার্কেট স্কোয়ারে যে রক্তগোলাপ বিকশিত হয়েছিলো তার সৌরভ ছড়িয়ে পরেছে পৃথিবীর এক প্রান্ত হতে অন্য প্রান্তে। ১৮৮৬ সালে শ্রমের সময় ৮ ঘন্টা, ন্যায্য মজুরীর দাবী ও নিপীরণ নির্যাতন বন্ধে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিলো তা আজও বাস্তবায়িত হয়নি।
তিনি আরও বলেন, পুঁজিবাদের বিষময় প্রতিক্রিয়া হিসেবে ১৯১৭ সালে আবির্ভাব ঘটেছিলো সমাজতন্ত্রের; যার মূল কথা ছিলো শ্রমিকরা সাধ্যনুযায়ী কাজ করবে, প্রয়োজন অনুযায়ী মজুরী পাবে। কিন্তু এই কথা কোনকালে কোনসময় বাস্তবায়িত হয়নি। পুজিবাদ যেভাবে শ্রমিকদের সাথে চরম জুলুম, নির্যাতন ও অধিকার বঞ্চিত করে চলেছে তদ্রুপ সমাজতন্ত্র শ্রমিকদের সাথে চরম প্রতারণা ও শোষণ করে চলেছে। সমাজতন্ত্র আজ পুঁজিবাদের লেজুরবৃত্তিতে পরিণত হয়েছে। ১০০ বছর যেতে না যেতেই সমাজতন্ত্রের মৃত্যুঘন্টা বেজেছে। শ্রমিকরা পুজিবাদ ও সমাজতন্ত্রের যাতাকলে পড়ে বার বার যে প্রতারিত হয়েছে এর একমাত্র কারন হলো মানবরচিত শ্রমনীতির কুফল।
আশরাফ আলী আকন বলেন, একমাত্র ইসলামী শ্রমনীতিই পারে কৃষক শ্রমিক মেহনতি মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করে উন্নত জীবন যাপনের নিশ্চয়তা প্রদান করতে। আজ থেকে ১৪০০ বছন পূর্বে সর্বকালের সর্বশেষ্ঠ মহামানব হযরত মুহাম্মদ স. শ্রমজীবি মেহনতি মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে প্রনয়ণ করেছিলেন ইসলামী শ্রমনীতি। ইসলামী শ্রমনীতির মূল কথাই হলো শ্রমজীবি মেহনতি মানুষের উপরে কোন ধরনের জুলুম নির্যাতন, অধিকার বঞ্চিত করা যাবে না। শ্রমিকদের সাথে কোন ধরনের খারাপ ব্যবহার করা যাবে না। শ্রমিকের গায়ের ঘাম শুকানোর আগে তার মজুরী প্রদান করতে হবে। মালিক শ্রমিকের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে তুলে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হতে হবে। মালিক যা খাবে শ্রমিক তাই খাবে। মালিক যা পরিধান করবে শ্রমিকদের তাই পরিধান করার ব্যবস্থা করতে হবে। শ্রমিকদের এমন মজুরী প্রদান করতে হবে যাতে খাওয়া দাওয়ার সাথে তার জীবনে সজীবতা ফিরে আসে। তাই ইসলামী শ্রমনীতি বাস্তবায়ন করে শ্রমিকের ন্যায্য অধিকার ফিরিয়ে আনার জন্য সকল শ্রমিকের প্রতি আহবান জানাচ্ছি।
এবছর করোনার প্রকোপে মে দিবসের অনুষ্ঠান যথাযতভাবে পালিত হচ্ছে না বিধায় শিল্প মালিক, ধনাঢ্য ব্যাক্তিবর্গের কাছে আকুল আবেদন জানাচ্ছি শ্রমিকরা যাতে দু’মুঠো ভাত খেয়ে জীবন যাপন করতে পারে সেজন্য আপনাদের যাকাত সহ ১০% সম্পদ গরীব শ্রমজীবী মানুষের জীবন জীবিকার জন্য ব্যায় করুন। এবং সম্মানিত সরকারী কর্মকর্তা কর্মচারীগনকে আবেদগন জানাই আপনাদের একমাসের বেতন অসহায় মানুষের সাহায্যার্থে দান করুন।
মে দিবস উপলক্ষে ইসলামী শ্রমিক আন্দোলনের কৃষক-শ্রমিকের মুক্তির ১৭ দফা
১. সভ্যতার কারিগর, উৎপাদন ও উন্নয়নের কর্ণধার, সুখী-সমৃদ্ধ কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অগ্রসৈনিক ও মানবতার কল্যাণে নিবেদিতপ্রাণ কৃষক শ্রমিকগণকে সম্মানিত নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দিয়ে তাদের ন্যায্য অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করতে হবে।
২. আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে সকল শ্রমিককে আইডি কার্ড প্রদান করে রেশনিং ব্যবস্থা চালু করতে হবে। তাদের পরিবারের শিক্ষা, চিকিৎসা ও পরিবহন ব্যয় অর্ধেক করতে হবে। এ ক্ষেত্রে দুর্নীতিবাজ, টাকা পাচারকারী ও ব্যাংকের ঋণ খেলাপীদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে উক্ত টাকার মাধ্যমে বিভিন্ন শ্রমিক সেক্টরে ও কৃষি খাতে ভর্তুকি প্রদান করতে হবে।
৩. ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে বেকারত্বের অবসান, অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে বিদেশী বিনিয়োগের মাধ্যমে নতুন নতুন কলকারখানা স্থাপন, বন্ধ কল-কারখানা চালু ও রুগ্নশিল্প কারখানাগুলোতে উৎপাদনের স্বাভাবিক পরিবেশ সৃষ্টি করে সাপ্তাহিক এবং মাসিক বেতনধারী শ্রমিকদের নিয়মিত বেতন ও বোনাস পরিশোধ করতে হবে।
৪. দ্রব্যমূল্যের আলোকে মানবিক দিক বিবেচনা করে সকল শ্রমিকের সর্বনিম্ন মজুরি ১৬,০০০/- (ষোল হাজার) টাকা নির্ধারণ করতে হবে। এছাড়া মজুরীর সাথে সম্মানজনক লভ্যাংশ দিতে হবে এবং শ্রমিকদের সর্বজনীন পেনশন স্কিমএর’ (Universal pension Scheme) আওতায় আনতে হবে। কর্মকালীন ফ্যাক্টরীতে শ্রমিক মারা গেলে ক্ষতি পূরণ বাবদ ৫ লক্ষ টাকা দিতে হবে।
৫. কথায় কথায় শ্রমিক ছাঁটাই শ্রমিকের ওপর কঠিন জুলুম ও অমানবিক। তাই যৌক্তিক কারণ ও ছাঁটাইয়ের শর্ত পূরণ ছাড়া শ্রমিক ছাঁটাই করা যাবে না এবং শ্রমিকের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
৬. ব্যাপক উৎপাদন ও উন্নয়নের স্বার্থে ইসলামী শ্রমনীতি বাস্তবায়ন সময়ের একান্ত দাবী। রাষ্ট্র ও শিল্প কারখানার সকল সেক্টর থেকে অসৎ ও অযোগ্য নেতৃত্ব অপসারণ করে সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ৭. শ্রমিকদের ওপর কোনো ধরনের খারাপ আচরন, শোষন-নিপীড়ন, নির্যাতন ও অধিকার বঞ্চিত করা যাবে না।
৮. মানবিক কারণে পায়েচালিত রিকশা, ভ্যান ও ঠেলা গাড়ির লাইসেন্স ফি মওকুফ করতে হবে এবং টোকেনপ্রথা বাতিল করতে হবে। ভারি ও হালকা যানবাহনসহ সকল ধরনের ড্রাইভারদের লাইসেন্স ফি অর্ধেক করতে হবে।
৯. হকার্স শ্রমিকদের পুনর্বাসন ছাড়া উচ্ছেদ করা অমানবিক, তাই পুনর্বাসনের আগপর্যন্ত জনসাধারণের চলাচলে বাধা সৃষ্টি না করে ফুটপাতের এক তৃতীয়াংশ জায়গা হকার বসার ব্যবস্থা করতে হবে।
১০. অটো ইজি বাইক ও সি.এন.জি বন্ধের পাঁয়তারা বন্ধ করতে হবে। এ জাতীয় যানবাহন চলাচলের জন্য আলাদা লেন করার ব্যবস্থা করতে হবে। ১১. মৎস্য শ্রমিকদের জীবনের নিরাপত্তার স্বার্থে সামুদ্রিক মাছ ধরার ট্রলারে অস্ত্রের লাইসেন্স দিতে হবে এবং সামুদ্রিক জেলেগণ যাতে অগ্রিম আবহাওয়ার পূর্বাভাস জেনে নিরাপদ আশ্রয় নিতে পারে সে লক্ষে সামুদ্রে নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে।
১২. ভ্রাম্যমান হকারদের রাস্তাঘাটে, বাস, ট্রেন এবং লঞ্চে পণ্য বিক্রির সুযোগ দিতে হবে এবং তাদের কোন ধরনের হয়রানি করা যাবে না। ১৩. হোটেল রেস্তোরাঁ শ্রমিকদের স্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ ও থাকার নিশ্চয়তা প্রদান করতে হবে। ডিউটিকালীন সময় ভাল পোষাক ও মানসম্মত খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। মাহে রমজান মাসকে কেন্দ্র করে শ্রমিক ছাঁটাই করা যাবে না এবং দুই ঈদে দুটি ফুল বোনাস প্রদান করতে হবে।
১৪. কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করে কাম্যমানের কৃষি পণ্য উৎপাদনের লক্ষে এবং কৃষকের উৎপাদন ব্যয় পুষিয়ে নেয়ার স্বার্থে সার, সেচ এবং বীজ অর্ধেক মূল্যে প্রদান করে তাদের মধ্যে বিনা সুদে প্রয়োজনীয় ঋণ প্রদান করতে হবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বীজ ও কীটনাশকের ভেজালের কারণে ফসল ক্ষতিগ্রস্থ হলে কৃষকদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। কাচা মাল ও ফলের পচন রোধকল্পে প্রক্রিয়া জাত করণের ব্যবস্থা ব্যপক ভিত্তিক করতে হবে।
১৫. বন্ধ হওয়া তাঁত শিল্প সচল করার স্বার্থে সূতা ও রংয়ের মূল্য কমাতে হবে। উন্নত তাঁত ক্রয়ের জন্য বিনা সুদে ঋণ প্রদান এবং বিদেশে তাঁত বস্ত্র রফতানির ব্যবস্থা করে তাঁত শ্রমিকদের বেতন বোনাসসহ সবধরনের সুযোগ-সুবিধা প্রদান করতে হবে। ১৬. কুঠির শিল্পের মানোন্নয়নের জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতি সরবরাহ ও কাঁচা মাল সহজ লভ্য করে কুঠির শিল্পের উৎপাদিত পণ্য বিদেশে রফতানির ব্যবস্থা করতে হবে। কুঠির শিল্পের শ্রমিকদের বেতন-বোনাস নিয়মিত পরিশোধ করতে হবে।
১৭. নদী বন্দর, সমুদ্র বন্দর, স্থল বন্দর ও বিমানবন্দরসহ সকল বন্দরে অশুভ চক্রের অবৈধ হস্তক্ষেপ ও চাঁদাবাজীসহ সকল প্রকার শ্রমিক হয়রানি বন্ধ করতে হবে এবং সকল বন্দরশ্রমিকের ন্যায্য প্রাপ্য নিশ্চিত করতে হবে। -বিবৃতি।
-এএ