মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪ ।। ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


ইসলামে শ্রমের মর্যাদা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

হাবীব আনওয়ার।।

মানুষ জীবন ধারণের জন্য যেসব কাজ করে, তাকে শ্রম বলে। ধনী-গরীব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ছোট-বড়, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব মানুষই কোনো না কোনো কাজ করে। আর কাজ করতে প্রয়োজন হয় শ্রমের। শ্রম ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। আমরা প্রত্যেকেই কিছু না কিছু শ্রম দিয়ে থাকি।

আল্লাহর নবী সা. নিজেও শ্রম দিয়েছেন। জুতা মেরামত করেছেন। কাপড় সেলাই করেছেন। এমনকি পাহাড়ের পাদদেশে বকরী চড়িয়েছেন। আদম আ. কৃষি কাজ করতেন। দাউদ আ. বর্ম তৈরী করতেন। হযরত মুসা আ. ও শ্রম দিয়েছেন। হযরত উতবাহ ইবনুল নুদ্দার রা. বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সা.-এর নিকট উপস্থিত থাকা অবস্থায় তিনি সূরা তা-সীন-মীম পাঠ করলেন। শেষে মূসা আ. -এর ঘটনা পর্যন্ত পৌঁছে তিনি বলেন, মূসা আ. আট অথবা দশ বছর যাবত নিজেকে শ্রমিকরূপে নিয়োজিত রেখেছিলেন নিজের লজ্জাস্থান হেফাজতের (বিবাহ) ও পেটের আহারের বিনিময়ে। সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ২৪৪৪

হযরত আলী রা. মজদুরীর তালাশে ঘর থেকে বের হয়ে যেতেন আর রাত্র পর্যন্ত কোন ইহুদীর ক্ষেতে কাজ করে কিছু খাবার নিয়ে ঘরে ফিরে আসতেন।কিন্তু কখনো ভিক্ষার হাত বাড়াননি। নবী দুলহান হযরত ফাতেমা রা. পানি বইতে বইতে বুকে-পিঠে দাগ পড়ে যেত। যাঁতা ঘুরাতে ঘুরাতে হাতে ফোসকা পড়ে যেত, তবুও শ্রমবিমুখ হননি।

হযরত উমর রা. অনেক সময়ই অত্যন্ত জোর দিয়ে বলতেন, "তোমাদের মধ্যে কোনো ব্যক্তি যেন মেহনত করে অর্থ উপার্জনের কাজ বন্ধ না করে দেয় এবং এই বলে বেকার বসে না থাকে, হে খোদা! তুমি আমার খাবার দাও।কারণ, তোমারা ভালো করেই জান আকাশ থেকে সোনা-চাদি ঝরে পড়ে না!" (ইসলামে শ্রমিকের অধিকার, পৃ.৫৫)

নবী করীম সা. শ্রমের মূল্যায়ন ও ভিক্ষাবৃত্তির প্রতি অনিহা প্রকাশ করতে গিয়ে বলেন, তোমরা কেউ দড়ি নিয়ে পাহাড়ের দিকে চলে যাবে, লাকড়ি জমা করে পিঠে বোঝা বয়ে এনে তা বিক্রি করবে এবং এমনি ভাবে আল্লাহ তার প্রয়োজন মিটিয়ে দেবেন, দ্বারে দ্বারে ভিক্ষার জন্য ঘুরে করুণা ও লাঞ্ছনা পাওয়ার চেয়ে অনেক ভালো। (বুখারী)

হযরত আবদুল্লাহ ইবনু ‘উমার রা. বর্ণনা করেন, নবী সা. বলেন, তোমাদের কেউ কেউ মানুষের কাছে ভিক্ষা চাইতে চাইতে আল্লাহ্‌র সাথে এমন অবস্থায় মিলিত হবে যে তার মুখমন্ডলে গোশতের কোন টুকরা অবশিষ্ট থাকবে না। সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ২২৮৬। অন্য হাদীসে ভিক্ষাকে জাহান্নামের আগুনের সাথে তুলনা করা হয়েছে!

হযরত হুবশী বিন জুনাদাহ রা. থেকে বর্ণিত আল্লাহর রসূল সা. বলেছেন, যে ব্যক্তি অভাব না থাকা সত্ত্বেও ভিক্ষা করে (খেলো), সে ব্যক্তি যেন জাহান্নামের অঙ্গার খেলো। সহীহ তারগীব হাদীস নং ৮০২

ইসলাম একজন শ্রমিকের যথার্থ মর্যাদা দিয়েছে। শ্রমিকের সাথে সদ্যব্যবহার করতে নির্দেশ দিয়েছে। কেননা শ্রমিকই হলো সকল উন্নয়ন ও উৎপাদনের চাবিকাঠি। যে জাতি যত বেশি পরিশ্রমী সে জাতি তত বেশি উন্নত। শ্রম আল্লাহ্ প্রদত্ত মানব জাতির জন্যে এক অমূল্য শক্তি ও সম্পদ। এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন, “নিশ্চয়ই আমি মানুষকে শ্রমনির্ভর করে সৃষ্টি করেছি” (সূরা বালাদ : ৩)

“অতঃপর যখন নামায শেষ হবে, তখন তোমরা জমিনের বুকে ছড়িয়ে পড় এবং রিযিক অন্বেষণ কর।” (সূরা: জুমা, আয়াত-১০)

তবে দুঃখজনক হলেও সত্য যে আমাদের বর্তমান সমাজ ব্যবস্থা শ্রমকে বিভিন্ন শ্রেণীতে বিন্যস্ত করেছে। যারা দামি গাড়িতে করে গিয়ে বড় দালানে শ্রম দেয়, মাস শেষে মোটা অংকের মাইনা পায় তাদের শ্রমকেই কেবল মূল্যায়ন করা হয়। আর যারা সারাদিন রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে খেতে খামারে অথবা রিক্সা চালিয়ে শ্রম দেয় আমাদের সমাজ ব্যবস্থা তাদের খুব বাকা চোখে দেখে।মাসের পর মাস অতীবাহিত হলেও তাদের পাওয়ানা পরিশোধ করা হয় না। বরং উল্টা তাদের সাথে অসাধাচারণ করা হয়। অথচ হাদীসে শ্রমিকের ঘাম শুকানোর আগেই তার পারিশ্রমিক দেওয়ার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমার রা. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, শ্রমিকের দেহের ঘাম শুকাবার পূর্বে তোমরা তার মজুরী দাও। সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ২৪৪৩

হযরত আবূ সাঈদ খুদরী রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, যখন তুমি কোন শ্রমিকের দ্বারা পরিশ্রম করাতে ইচ্ছা কর, তখন তার পারিশ্রমিক ঠিক করে নিও। সুনানে আন-নাসায়ী, হাদিস নং ৩৮৫৭

অন্য হাদীসে যারা শ্রমিক দিয়ে কাজ আদায় করে নেয় অথচ, মজুরী দেয় না তাদের সম্পর্কে আল্লাহর নবী বলেন, হযরত আবূ হুরায়রা রা. বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, কিয়ামতের দিন আমি তিন শ্রেণীর লোকের বিরুদ্ধে বাদী হবো। আর আমি যার বিরুদ্ধে বাদী হবো, তার বিরুদ্ধে জয়ী হবো। কিয়ামতের দিন আমি যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করবো তারা হলো; যে ব্যক্তি আমার নামে অঙ্গীকার করে, পরে সে অঙ্গীকার ভঙ্গ করে। যে ব্যক্তি অর্থ উপার্জনের জন্য স্বাধীন মানুষ বিক্রয় করে এবং যে ব্যক্তি শ্রমিক নিয়োগ করে তার থেকে পূর্ণরূপে কাজ আদায় করে নেয়, কিন্তু তার পূর্ণ মজুরী দেয় না। সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ২৪৪২

আমাদের দেশের অবস্থার দিকে তাকালে শ্রমিকদের করুণ পরিণতি চোখে পরে। শ্রমিকদের ঘাম ঝড়ানো টাকা আত্মসাৎ করে সম্পদের পাহাড় গড়ে। দেশে বিদেশে ফ্লাট বাড়ি কেন। কিন্তু শ্রমিকের প্রাপ্য মজুরী দিতে তালবাহানা করে। ক'দিন পর পরেই বেতন ভাতার দাবিতে রাস্তা অবরোধ, কারখানা বন্ধ, এমনকি সংঘর্ষ পর্যন্ত দেখা যায়। আবার অন্যদিকে শ্রমিকদের উপরে চালানো হয়, অমানবিক নির্যাতন। অথচ, ইসলাম শ্রমিকদের উপর হাত তোলা, কিংবা তাদের হত্যা করতে নিষেধ করেছে।

হযরত হানযালাহ আল-কাতিব রা. বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সাঙ্গে যুদ্ধ করলাম। আমরা এক নিহত নারীর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম, যার নিকট লোকজন ভীড় জমিয়েছিল। লোকেরা তাঁর জন্যে পথ করে দিলো। তিনি বলেন, যারা যুদ্ধ করে, সে তো তাদের সাথে যুদ্ধ করতো না! অতঃপর তিনি এক ব্যক্তিকে বলেন, তুমি খালিদ ইবনুল ওয়ালিদকে গিয়ে বলো, রাসূলুল্লাহ সা. তোমাদের এই বলে নির্দেশ দিয়েছেন, তোমরা কখনো শিশু ও শ্রমিককে হত্যা করো না। সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ২৮৪২

কিন্তু আমাদের সমাজে শ্রমিকদের সাথে খারাপ আচারণ, মজুরী কম দেওয়া, কাজ বেশি করানটা কেমন যেন একটা ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। এই তো মাস দু'এক পূর্ব এক নারী নেত্রী কর্তৃক একজন রিক্সা চালককে অনর্থক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে।

১৮৮৬ সালের ১ মে আমেরিকার শিকাগো শহরের ‘হে’ মার্কেটে অধিকার বঞ্চিত শ্রমিকরা ৮ ঘণ্টা কাজসহ বিভিন্ন দাবিতে সংগঠিত হয়ে আন্দোলন শুরু করে। বিক্ষোভ সমাবেশে নিরীহ শ্রমিকদের ওপর গুলি চালায় পুলিশ। নিহত হন অনেক শ্রমিক। শ্রমজীবী মানুষের আপসহীন মনোভাব ও আত্মত্যাগের ফলে মালিক পক্ষ শ্রমিকদের দাবি অনুযায়ী, ৮ ঘণ্টা কাজের স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়।

১ মে বিশ্ব শ্রমিক দিবস হিসেবে পালিত হয়। মে মাসের ১ তারিখ আসলে শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের নামে বিভিন্ন মিছিল মিটিং, র‌্যালী-সামাবেশে যারা শ্রম অধিকারের শ্লোগান দিয়ে গলা ফাটায়। দিনশেষে তাদের কাছেই শ্রমিকরা নির্যাতনের শিকার হয়। ১০ টাকা রিক্সা ভাড়ার জন্য বাবার বয়সী লোকটির গায়ে হাত তুলেও দ্বিধা করে না। তাই আসুন! শুধু আনুষ্ঠানিকতা নয়, সত্যিকারে শ্রমের মূল্য দিই। শ্রমিকদের প্রাপ্য অধিকার ফিরিয়ে দিই।

লেখক: শিক্ষার্থী, হাটহাজারী মাদরাসার, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।

-এএ


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ