মাসউদুল কাদির।।
তবু এগিয়ে চলেছে শ্রমিক দিবস। একজন শ্রমিকের মর্যাদার জন্য একদা আন্দোলন সংগ্রাম হয়েছিল। দেশে-বিদেশে গণমাধ্যমকর্মীরাও শব্দ শ্রমিক। শ্রমিকের মর্যাদা নেই একটা গোষ্ঠীর। সেই কওমী মাদরাসা নিয়ে এখন কোনো কথা বলবার ইচ্ছা নেই। একটা পারিবারিক সম্মাননা উপস্থাপনের জন্য লেখাটা শুরু করলাম।
জন্মের পর থেকেই বাবার কড়া শাসনের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেছি। বাবা সামান্য ব্যবসা করতেন। দাদার কিছু জমিজিরাত ছিল, তবু তিনি ব্যবসা করতেন। অন্য পাড়াত অনেক কৃষক চাচাদের ছেলেরা বাবার পেশা ধরে মাঝে মাঝে উপহাস করতো। গ্রামে শুধু ধান চাষ করে গোলা ভরে ধান তোলাটাও সম্মানের। সম্মানের নিজের ঘরের চাউল খাওয়া। আবার চাউল বিক্রি করে তরিতরকারি কেনাও লজ্জার। এটা এমনি এমনি বলছি না। কখনো কখনো আমাকেও বাজারে চাউল বিক্রি করতে হয়েছে। আমার কাউকে দায়িত্ব দিয়ে আমাকে দূরে দাঁড় করিয়ে রেখে তরিতরকারি কিনে দিয়েছেন। চাউল বিক্রি করে তরকারি কিনছি, বিষয়টা যেনো অন্যরা বুঝতে না পারে।
খুব ছোটবয়সেই ঢাকায় চলে এসেছিলাম। বুঝলাম, এখানে চাকরি বা ব্যবসাটাও সম্মানের। কেউ কেউ আমাকে কৃষকের ছেলে বলে উপহাস করতে চায়। আমি তখন হিসাব মেলাতে পারি নে। আমাদের বিশাল পরিবার। পুরো টিমকে আগলে ধরে আমার বাবা আলহাজ আমির হোসাইন কীভাবে যে গ্রামের নিরন্তর মারামারি-কাটাকাটি- খুনোখুনির মাঝখান দিয়ে বড় করেছেন- তা বুঝতেই পারিনি।
আজকের শ্রমিক দিবসে তাকে আমাদের জীবনের সবচেয়ে সফল বাবা এবং শ্রেষ্ঠ শ্রমিক হিসাবে মূল্যায়ন করতে চাই। বাবার জায়গায় বসে আমার বড় ভাই এমন সব দায়িত্ব পালন করলেন, রাজধানীতে বাবার প্রয়োজন কখনো মনে হতেই দেননি। আমার মেঝো ভাই, তিনি এখন ইউরোপের ডাবলিনে বসবাস করেন। এরপর বড় অবদান তার।
বাবা, মা, ভাই-বোন-এমনকি ভাতিজা-ভাতিজির জন্য অতটা করে নিকট অতীতে আমার কাছে এমন নজীর নেই। প্রায় চল্লিশজন সদস্যের এত বড় পরিবারের প্রায় প্রত্যেকটি মানুষের মুখে হাসি ফোটাবার চেষ্টা করেছেন তিনি।
আমার বড় চার চার জন ভাই। তাদের প্রত্যেকেরই আমার উপর অনেক অনেক অবদান আছে। আমি যতটা নিষ্ঠুর হই ততটাই তাদের ভালোবাসার পরম মমতার হাতছানি যেনো আমাকে শীতল পরশ বুলিয়ে যায়। আমার তেমন সামর্থ্যও নেই। কোনো কিছু দিয়ে তাদের ঋণ কোনো দিন শোধ করা সম্ভবও নয়। তারা কোনো কিছু পাওয়ার জন্য নিজেদের শ্রমের পয়সা ব্যয় করেননি জানি, কেবল আমাদের জীবন রঙিন কসরত করেছেন। উপন্যাস, নাটক বা সিনেমায় এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে পারে। কিন্তু বাস্তবে ভাই ভাইয়ের জন্য অতখানী করতে পারে তা আমার জানা নেই।
লেখালেখিতে মনোযোগ দেয়ায় পড়ালেখা থেকে মন ওঠে যাচ্ছে কিনা বড় ভাই একবার আমার সব কাগজপত্র ছিঁড়ে ফেললেন। তখন কষ্ট পেয়েছিলাম। কখনোই কিছু বলতে সাহস পাইনি। চুপি চুপি আমি ঠিকই লেখালেখির কাজটা চালিয়ে গেছি। পরে যখন দৈনিকে আমার লেখা প্রকাশ পেতে শুরু করলো, তখন তাকে খুশি হতেও দেখেছি।
নতুন লেখক, কে তার বই প্রকাশ করবে। আমার একমাত্র বোন নিজের গলার চেইন বিক্রি করে দিয়ে দিলো, ভাই তুমি বই বের করো। আমার মেঝো ভাই, আমাকে খুশি করার জন্য বললেন, যতবার বই করবি আমি ততবার তোকে টাকা পাঠাবো। আমার প্রিয় গল্পের বই রাতুলের রঙধনু (২০০৪)- প্রকাশ করতে নিজেরও কিছু পয়সা দিতে হয়েছিল। প্রকাশিত এই বইটিই আমার লেখালেখি জীবনের প্রথম প্রেরণা। যে যত বড় কিছু হোক না কেন তার পেছনে পরিবারের বড় একটা অনুপ্রেরণা থাকে। সাহস থাকে। পরিবারের অন্যরা না চাইলেও কেউ কেউ বেড়ে উঠতে পারেন। তবে সেটা বিরল।
গর্ব করার মতো নিষ্ঠাবান একজন বাবা পেয়ে আমি সত্যিই আনন্দিত। হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা পেয়ে যে ভাইয়েরা নিজেদের শ্রম মাটি করেছেন তাদের প্রতি একরাশ অনুপম ভালোবাসা ছাড়া আর কীবা দিতে পারি আমি। করোনাকালের এই সন্ধিক্ষণে যে কেউ যখন তখন মারাও যেতে পারি। আল্লাহ আমাদের সবাইকে হেফাজত করুন।
প্রায় চল্লিশজন সদস্যের পরিবারকে আমার মা একলা যে শ্রম দিয়েছেন বাকি চল্লিশজনও অতটা দিতে পারিনি। আজকের শ্রমিক দিবসে স্যালুট বাবা-মা-ভাই ও বন্ধুরা।
লেখক: প্রেসিডেন্ট, শীলন বাংলাদেশ ও সহকরী সম্পাদক, দৈনিক আমার বার্তা
-ওআই/আব্দুল্লাহ আফফান