মাওলানা মুহাম্মদ ওলীউর রহমান।।
সারা বিশ্বের ন্যায় আমাদের দেশেও আজ এক কঠিন পরিস্থিতি বিরাজ করছে। আমরা এক ভয়াবহ সময় পার করছি। করোনা ভাইরাসের কারণে বিশ্বের উন্নত ও শক্তিধর দেশগুলোও নিজিদের করুন অসহায়ত্বের কথা বার বার প্রকাশ করছে। করোনার ভয়াবহ ছোবল থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য সরকারী-বেসরকারী অফিস, দোকান-পাঠ, শপিংমল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কল-কারখানা ও গণপরিবহণ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। মানুষকে ঘরে রাখার জন্য পুলিশের পাশাপাশি সেনাবাহিনীকে মাঠে নামানো হয়েছে। করোনার প্রাদুর্ভাব রোধে বিভিন্ন জেলাকে লকডাউন করা হয়েছে, মসজিদের জামাতকে সীমিত করা হয়েছে। এ অবস্থায় করোনা আতঙ্কের পাশাপাশি নিম্ন বিত্ত ও মধ্য বিত্ত পরিবারগুলোতে খাদ্যের জন্য হাহাকার শুরু হয়েছে।
সমাজের বিত্তবান ব্যক্তিবর্গ, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য এগিয়ে এসেছেন। যার যার সামর্থের আলোকে ত্রাণ বিতরণ করছেন। সরকারের পক্ষ থেকে করোনা প্রাদুর্ভাবের সম্ভাব্য ক্ষতি পুষিয়ে ঊঠতে প্রায় ৭৩ হাজার কোটি টাকার প্রনোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে।
কিন্তু মানুষের কান্না থামছে না, মানুষ বেরিয়ে পড়ছে রাস্তায়। মিছিল করছে। করোনা আতঙ্কের চেয়ে এখন তাদের কাছে জঠর জ্বালাই বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। দেশ ও জাতির এই মহা দুর্যোগের সময় কিছু কিছু জনপ্রতিনিধি, মেম্বার, চেয়ারম্যান দরিদ্র মানুষের জন্য বরাদ্দকৃত ত্রাণ ও স্বল্পমূল্যের চাল আত্মস্যাৎ ও লুটপাটে মেতে উঠেছেন। মাটির নিচে লুকিয়ে রাখছেন শত শত বস্তা চাল, বিছানার নিচে লুকিয়ে রাখছেন শত শত লিটার তেল। গোটা জাতি যখন করোনা ভাইরাসের কারণে আতঙ্কিত, নিম্ন ও মধ্য আয়ের লোকেরা যখন করোনা আতঙ্কের চেয়েও খাদ্যের অভাবে বেশি পেরেশান, এই কঠিন সময়েও যারা নিঃস্ব মানুষের খাবার চুরি করছেন এরা কত নিকৃষ্ট চোর? গোটা জাতি আজ মর্মাহত ও হতাশ হয়েছে। শুধু রাজনীতিবিদ নয় বরং গোটা জাতিকে ওরা কলঙ্কিত করেছে, জাতি আজ এই চোরদের কারণে বিশ্বের কাছে চরমভাবে অপমানিত ও লজ্জিত।
মানুষ আর কোনভাবে জনপ্রতিনিধিদের বিশ্বাস করতে পারছেনা, তাই সর্বত্র দাবি উঠছে যে, ত্রাণ বিতরণ করা হোক সেনাবাহিনীর মাধ্যমে। জাতি এখন এই চোরদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চায়, বিচার দেখতে চায়। লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রেসিডেন্ট ড. কর্নেল (অব) অলি আহমদ এদেরকে প্রকাশ্যে মৃত্যুদন্ড দেয়ার দাবি জানিয়েছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বলব, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘মানুষ পায় সোনার খনি আর আমি পেলাম চুরের খনি’। এই চোরদেরকে যদি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না দেয়া হয়, তাহলে চোররের খনি থেকে শুধু চোরই বের হবে, ভাল মানুষ বের হবেনা। এজন্য প্রয়োজন কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা।
ইসলামী শরিআ আইনে যদি এদের বিচার করা হয় তাহলে শতভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে বলা যায় যে, এ অবস্থার অবসান ঘটবে, চোরের খনির সোনার খনিতে রূপান্তরিত হবে’।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ আইন চালু আছে। সম্প্রতি ব্রæনাই এ আইন চালু করেছে। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘যে পুরুষ চুরি করে এবং যে নারী চুরি করে, তাদের হাত কেটে দাও তাদের কৃতকর্মের শাস্তি হিসাবে। আল্লাহর পক্ষ থেকে হুশিয়ারী। আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।’ (সূরা মায়িদা, আয়াত-৩৮) এছাড়া আর কোনভাবে বাংলাদেশের তেল চোর এবং চাল চোরদের দমন করা যাবে বলে মনে হয়না।
ত্রাণ আনতে গিয়ে কেউ কেউ ত্রাণ বিতরণকারী জনপ্রতিনিধিদের হাতে লাঞ্চিত হয়েছেন, শারীরিকভাবে নির্যাতনেরও শিকার হয়েছেন কেউ কেউ। সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখা গেছে একজন চেয়ারম্যান ত্রাণ বিতরণের সময় দরিদ্র মানুষের সাথে চরম দুর্ব্যবহার করছেন, নারীদের আচল ধরেও টানা হেচড়া করছেন।
আরেক জনপ্রতিনিধি ত্রাণ বিতরণ করে ছবি তুলার পর ত্রাণের প্যাকেট কেড়ে নিয়েছেন। এক কৃষকের মেয়ে ত্রাণ আনতে গিয়ে এক জনপ্রতিনিধির দ্বারা ধর্ষনের শিকার হয়েছে। দুই কেজি চাল দিয়ে ছবি তুলেছেন ১৫ জন।
অর্থাৎ ত্রাণ নয় ছুবি তুলাই মুখ্য উদ্দেশ্য, দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়ানো বা তাদের সাহায্য করা নয় বরং তাদের গাড়ে পাড়া দিয়ে নিজেকে তুলে ধরাই মূল উদ্দেশ্য। গোটা জাতি চরম দুশ্চিন্তায় করোনার ভয়াবহতা নিয়ে, বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা অনুযায়ী বাংলাদেশে করোনায় আক্রান্তদের লাশের মিছিল নিয়ে, খাদ্য সঙ্কট নিয়ে, সর্বোপরি দেশে ও জাতির দুরঅবস্থা নিয়ে, কিন্তু ত্রাণ বিতরণকে কেন্দ্র করে এমন পৈশাচিক অবস্থার সৃষ্টি হবে তা তো আমরা কল্পনাও করতে পারেননি। দরিদ্র মানুষের দারিদ্রতা নিয়ে এসব খেল-তামাশা বন্ধ করা দরকার, এরকম নোংরা মানসিকতা পরিবর্তন করা দরকার। দেশ প্রেম ও মানব প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে বিপদগ্রস্ত মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসা দরকার।
এমন সাহায্য করলাম- দরিদ্র লোকেরা সাহায্য নিতে এসে মান-সম্মান হারালো, ত্রাণের পুঁটলীর সাথে অপমানের বোঝা মাথায় নিয়ে ফিরল, কোন অবস্থায় এটা গ্রহণযোগ্য নয়। ইসলাম এমন দান-সাদকার তীব্র সমালোচনা করেছে এবং এমনভাবে সাহায্য-সহযোতিা ও দান-সাদকা করতে নির্দেশ দিয়েছে যাতে সাহায্য প্রার্থীরা অপমানিত বোধ না করে। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘যারা আল্লাহর রাস্তায় স্বীয় ধন-সম্পদ ব্যয় করে, তাদের উদাহরণ একটি বীজের মত, যা থেকে সাতটি শীষ জন্মায়।
প্রত্যেক শীষে একশ’ করে দানা থাকে। আল্লাহ অতী দানশীল, সর্বজ্ঞ। যারা স্বীয় ধন-সম্পদ আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করে, এর পর ব্যয় করার পর সে অনুগ্রহের কথা প্রকাশ করেনা এবং কষ্টও দেয় না, তাদেরই জন্য রয়েছে তাদের পালন কর্তার কাছে পুরস্কার এবং তাদের কোন অশংকা নেই, তারা চিন্তিতও হবেনা। নম্র কথা বলে দেয়া এবং ক্ষমা প্রদর্শন করা ঐ দান-খয়রাত অপেক্ষা উত্তম যার পরে কষ্ট দেয়া হয়। আল্লাহ তায়ালা সম্পদশালী, সহিষ্ণু।’ (সূরা বাকার, ২৬১-২৬৩)
মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে প্রকাশ্যে দান-খয়রাত করা বা ত্রাণ বিতরণ করা দোষনীয় নয়, যাতে অন্যরাও একাজে উদ্বুদ্ধ হয়, এগিয়ে আসে। তবে এক্ষেত্রেও দান গ্রহীতার মান-সম্মানের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে। যাতে কোনভাবে তারা নিজিদের মান-মর্যাদা হারাতে না হয়। অবশ্য আমাদের সমাজে এমন বহু লোক রয়েছেন যারা দিন-রাত মানুষকে সাহায্য সহযোগিতা করে যাচ্ছেন অথচ কেউ টেরও পাচ্ছেনা।
দেশ ও জাতির এই মহা বিপদের সময় যারা নিজেদের জীবন বাজি রেখে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন, চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন, লাশ দাফন করছেন চলমান সংগ্রামে এরাই আসল বীর যোদ্ধা, জাতি এই বীর যোদ্ধাদের চিরকাল স্মরণ রাখবে।
-এটি