মুহাম্মদ শামসুল ইসলাম সাদিক।।
রমজান শব্দটি আরবি রমজুন ধাতু থেকে এসেছে। যার অর্থ পুড়িয়ে ফেলা, দহন করা, জ্বালিয়ে দেয়া। সারা বছর আমাদের শরীর এবং মনের ওপর যে আবর্জনার আস্তর জমে তা পুড়িয়ে ফেলে সুস্থতা আর শুদ্ধতার সন্ধান দেয় রমজান। রোজা হচ্ছে দ্বিমুখী- দেহশুদ্ধি এবং অন্তরশুদ্ধি।
না খেয়ে থাকাটা রোজার একটা অংশ। রোজার আরেকটি অংশ হলো- গীবত, রাগ, ক্ষোভ, ঘৃণা, ঈর্ষা অর্থাৎ যে অন্যায় মানুষের মনকে কলুষিত করে তা থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা এবং মানুষের পাশবিক ইচ্ছা ও জৈবিক চাহিদার মধ্যে সুস্থ ও স্বাভাবিক রাখা। রোজার দ্বারা মানুষ আত্মশুদ্ধি ও পবিত্রতা অর্জনের মাধ্যমে সফলতার স্বর্ণশিখরে আরোহন সহ সংযমী করে।
বিশ্বে ইতিহাসে এবারের রমজান মুসলিমদের কাছে ভিন্ন রকম এক চিত্র নিয়ে হাজির। যখন সমস্ত পৃথিবী করোনা ভাইরাস নামের মহামারীতে আক্রান্ত। এ মহামারী ইতিমধ্যে প্রথম মহাযুদ্ধের চেয়েও বেশি মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছে। আরও কত জীবন কেড়ে নেবে সে আশঙ্কায় ভুগছে বিশ্বের প্রতিটি মানুষ। বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া করোনা মহামারীর দরুন সবাই এখন ঘরবন্দি। দেশে দেশে চলছে লকডাউন ও কারফিউ।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ আছে মাসখানেক ধরে। পৃথিবীর ব্যস্ততম স্থানগুলোতে বিরাজ করছে পিনপুন নীরবতা। নেই মানুষের কোলাহল ও পদচারণ। এমন বিমর্ষ ও অচেনা বিষণ্ন পৃথিবীতে বছর ঘুরে ফিরে এলো রমজান। এই দুঃসময়ের মধ্যেও কোটি কোটি মুসলমান রোজা পালন করছেন মহান স্রষ্টার সন্তুষ্টির জন্য। ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের একটি এবং মর্যাদাপূর্ণ অবশ্যপালনীয় ইবাদত রোজা। রোজা যে মানবদেহের জন্য কল্যাণকর তা আধুনিক বিজ্ঞানও স্বীকার করে। রমজান একটি পবিত্র মাস। রমজানের রোজা মুসলমানদের উপর ফরজ।
ইরশাদ হচ্ছে- ‘হে ইমানদারগণ, তোমাদের জন্য রোজা ফরজ করা হয়েছে যেমন তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের প্রতি ফরজ করা হয়েছিল’ (সূরা বাকারার, আয়াত ১৮৩)।
রমজানের আগমনে খুলে দেয়া হয়েছে জান্নাতের সব দুয়ার। বন্ধ হয়ে গেছে জাহান্নামের সবক’টা দরজা। শয়তানকে বেঁধে রাখা হয়েছে শেকলে। এ মাসে একটি রজনী রয়েছে- যা অন্য হাজার মাসের থেকেও উত্তম। যে এ মাসের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হল সে যেন (জীবনের) সব কল্যাণ থেকেই বঞ্চিত হল।’ রাসুল (সা.) তাঁর সাহাবিদের রমজানের সুসংবাদ শোনাতেন। রমজানের মর্যাদার কথা বলতেন। ইবাদত ও সাধনায় মনোযোগী হওয়ার উপদেশ দিতেন। বেশি বেশি নেকি অর্জনে উৎসাহ জোগাতেন।
আমাদের কর্তব্য হল, ইবাদতের বসন্তকাল রমজান মাস কে যথার্থ মূল্যায়ন করা। তার প্রাপ্য সম্মান দেয়া। রমজান মাস দুহাত ভরে পাওয়ার মাস কারণ, আমরা যদি এর উপযুক্ত মূল্য দিতে না পারি, জান্নাত লাভের এমন সুযোগকেও হাতছাড়া করে ফেলি, রাসুল (স) বলেছেন, যে জীবনে রমজান মাস পেল কিন্তু তার ভুল-ত্রুটি অন্যায় পাপাচার থেকে বেরিয়ে আসতে পারল না, নিশ্চয়ই এ জগতে তার চেয়ে বড় হতভাগা আর কে হতে পারে! রোজাকে আল্লাহ নিজের দিকে সম্বোধিত করে বলেছেন, ‘মানুষের সব আমল তাঁর জন্য; তবে রোজা ছাড়া।
কেননা তা আমার জন্য এবং আমিই তার প্রতিদান দেব। রোজাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহর কাছে মিশকের চেয়ে বেশি সুগন্ধিযুক্ত’ (বুখারি)। অন্য হাদিসে এসেছে, ‘রোজা ঢালস্বরূপ, যতক্ষণ তা ত্রুটিযুক্ত করা হয়’ (সুনানে নাসায়ি)। সে জন্য রোজার মাধ্যমে মানুষ আত্মসংযমের শিক্ষা পায়।
এ সংযম মানুষকে শুদ্ধচারী হওয়ার পথ দেখায়। এছাড়া তাকওয়া বা আল্লাহভীতি অর্জন করা এবং এটা রোজার অন্তর্নিহিত প্রধান তাৎপর্য। কেননা ঘরে খাদ্য থাকতেও রোজা পালনের সময় সেই খাদ্য গ্রহণ থেকে মুমিনরা দূরে থাকে। আল্লাহর প্রতি ভয় তাদের দীর্ঘ সময় খাদ্য ও পানীয় থেকে দূরে থাকতে উদ্বুদ্ধ করে।
রমজান মাসে মহান প্রভু তাঁর বিশেষ অনুগ্রহে প্রত্যেকটি ভালো কাজের সওয়াব বা বরকত ৭০ গুণ বা তার বেশি পরিমাণ দিয়ে থাকেন। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এ মাস খাদ্য সংযমের মাস, পরিমিতিবোধের মাস, আত্ম উপলব্ধির মাস। কিন্তু বেনিয়াদী পুঁজিবাদীদের দিয়ে প্রভাবিত হয়ে আমরা অনেকে ভোগের উৎসবে মেতে উঠি।
সংযমী হয়ে নিজেকে পরিশুদ্ধির চেয়ে খাবারে, কেনাকাটায় বা আচরণে অসংযম, আসক্তি বা অস্থিরতা এখন দৃশ্যমান। আমরা যেন এ অভিশপ্তদের অন্তর্ভুক্ত না হই। আমরা যত সংকটেই পড়ি না কেন, মহামারী করোনার বিপদ-আপদ পেরিয়ে শত বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও আমরা যেন সিয়াম সাধনা থেকে বঞ্চিত না হই।
আমরা ইবাদতের মাধ্যমে এ মাসের দিন-রাতগুলো কাটানোর প্রস্তুতি নেব। দ্বিগুণ উৎসাহ ও নিষ্ঠার সঙ্গে আমল করব। জীবনকে সুন্দর অর্থবহ পরিতৃপ্তিময় ও বিকশিত করার জন্যে রোজার বিকল্প নাই। এ মাসের প্রথম ১০ দিন রহমতের, মাঝের ১০ দিন মাগফিরাত এবং শেষ ১০ দিন দোজখের আগুন থেকে পরিত্রাণ লাভের।
এ মাসে যে ব্যক্তি তার অধীনদের কাজ হালকা করে দেয়, আল্লাহ তাকে মাফ করে দেন এবং দোজখ থেকে নাজাত দান করেন। আমরা করোনার এই দুঃসময়ে গবির-দুঃখীরা যাতে সাহরি ও ইফতারের তৌফিক লাভ করে তা নিশ্চিত করতে তাদের পাশে দাঁড়াব। আল্লাহর কাছে বিশ্ববাসীকে করোনা ভাইরাসের থাবা থেকে মাফ করার প্রার্থনা জানাব। আল্লাহ রমজানে আমাদের প্রতি তাঁর রহমতের কুদরতী হাত বাড়াবেন- আমরা এমন আশা করতে চাই।
লেখক: প্রাবন্ধিক
-এটি