উবায়দুল্লাহ তাসনিম।।
ভারত উপমহাদেশে যে সকল মনীষী বহুমুখী যোগ্যতা ও পান্ডিত্যের অধীকারি ছিলেন, তাদের অন্যতম ছিলেন সায়্যিদ মানাযির আহসান গিলানি রহ.। তাফসির, হাদিস, ফিকহ সবশাস্ত্রেই তার ভালো জানাশোনা ছিলো। মাকুলাত (যুক্তিবিদ্যা) শাস্ত্রে তিনি ছিলেন বেশ পারদর্শী।
উনবিংশ শতাব্দীতে লিখনীর ময়দানে যারা আলোড়ন তুলছিলেন, তাদের নামের সাথে ‘মানাযির’ নামটাও আসে। ইসলাম সুরক্ষার তাগিদে তিনি সময়ের ভাষায় উত্থাপিত প্রশ্নের জবাব দিতেন। দেওবন্দি চিন্তাধারা ছিলো তার চরিত্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ। দেওবন্দি চেতনায় তিনি নতুন প্রজন্মকে গড়ে তুলতে চাইতেন।
জন্ম: ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দের ২ অক্টোবর মোতাবেক ১৩১০ হিজরীর ৯ রবিউল আওয়াল ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য বিহারের পাটনা জেলার 'ইস্তানওয়া'তে তার জন্ম। এটা তার নানার বাড়ি। পিতার বাড়ি বিহারের 'নালন্দা' জেলার গিলানে।
তাদের খান্দানের নাম ছিল 'হুসাইনিয়া ওয়াসিতিয়্যাহ'। তাদের খান্দান ছিল মৌলভী খান্দান। তার দাদা মুহাম্মদ আহসান গিলানী ছিলেন বিহারের বড় মাপের একজন মাকূলি (যুক্তিবিদ্যায় পারদর্শি) উস্তাদ। চাচা মাওলানা হাকিম আবু নসর গিলানি দরসে নেজামি পড়ুয়া আলেম ছিলেন। ছিলেন মজবুত হানাফি আলেম। সেসময়ের গায়রে মুকাল্লদিদদের সাথে তার প্রায়ই তর্ক-বিতর্ক হতো। সে একালায় খুবই বিখ্যাত ছিল তাদের পরিবার।
শৈশব: তার শৈশবটা ছিল দুরন্ত টাইপের। শুধু দুরন্তপনা না; দুষ্টোমি করার সাথে সাথে ভালো রকমের পড়াশোনাও করতেন। একাডেমিক পড়াশোনার চেয়ে গল্প উপন্যাসের প্রতি তার জোঁক ছিলো প্রবল। হঠাৎ ঘরে পাওয়া, উপরের পৃষ্ঠা নেই এমন একটা গল্পের বই দিয়ে তার আউট বই পড়া শুরু।
গল্পের বইগুলোর মাঝে দাস্তানে আমীর হামযা' (উর্দূ) তাকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করে। বইটির অনেকগুলো চরিত্রের একটা চরিত্র ছিলো (কাল্পনিক) কাফেরদের উপর (কাল্পনিক) মুসলমানদের বিজয়'। এর প্রভাব কিছুটা পড়েছে তার জীবনের জিহাদি প্রেরণায়। তার ভাষায়, কুফুরের মোকাবেলায় ইসলাম বিজয়ের যে জযবা অামার মধ্যে সদা জাগ্রত,তাতে ওসব কাহীনি -উপন্যাসের কিছু না কিছু দখল অবশ্যই আছে।
শিক্ষা: নিজ বাড়িতেই চাচার তত্ত্বাবধানে কুরআন মজিদ, উর্দূ, ফারসি নাহব, সরফ ইত্যাদি প্রাথমিক পড়াশোনা শিখেন।
চাচার ইচ্ছে ছিল ইংরেজি পড়াবেন। গ্রামে থাকাকালেই তিনি ইংরেজি ভাষার প্রথমিক দু'য়েকটা বই পড়েও ফেলেছেন। ভাগ্যপুর স্কুলে চাচাজান ভর্তিও করিয়ে দেন। কিন্তু কোন কারণে আর তার স্কুলে পড়া হয়নি। চাচার স্বপ্নের অকাল মৃত্যু ঘটে।
এরপরের যাত্রা বিহার থেকে রাজপুতনা। সেখানে তার আত্মীয়, টোংকের প্রসিদ্ধ মানতেকি (তর্ক বিদ্যায় পারদর্শী) আলেম বারাকাত আহমদ বিহারি থাকতেন। তার কাছে যাওয়ার পর চঞ্চল জীবন ও গল্প-উপন্যাসে কিছুটা ভাটা পড়ে। মন মানসিকতার অনেক পরিবর্তন হয়।
১৩২৪ হিজরী মোতাবেক ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে টোংকের নামকরা আলেম সায়্যিদ আবুল বারাকাত টোংকির কাছে সাহিত্য, ফিকহ, মানতেক (তর্কবিদ্যা) ও মাকূলাত (যুক্তিবিদ্যা) শাস্ত্রের উচ্চতর পাঠ গ্রহণ করেন। ১৩৩১ হিজরীতে দারুল উলূম দেওবন্দে ভর্তি হন। এসময় তিনি শায়খুল হিন্দ, কাশ্মীরি, উসমানি, মাদানি প্রমুখ আকাবিরের নিকট হাদিসের দরস লাভে ধন্য হন।
তিনি যে পরিবেশে গড়ে উঠেছিলেন সে পরিবেশটা ছিলো মুকাল্লিদ গায়রে মুকাল্লিদের গরম তর্ক-বিতর্কের সময়।
এ বিষয় নিয়ে কিছু ঘাটাঘাটিও করেছেন। যার নিরসনে আব্দুল ওয়াহহাব শারনির কিতাবাদি বিশেষভাবে 'আল-মিযানুল কুবরা' তার মনে প্রশান্তি জাগায়। মাওলানা আব্দুল লতিফ রাহমানির 'তাযকেরায়ে আযমের মাধ্যমে এ ক্ষেত্রে সঠিক চিন্তার মৌলিক সম্পাদনার কাজটা সহজ হয়। এছাড়া দেওবন্দের দাওরায়ে হাদিসের দরস বিশেষভাবে শায়খুল হিন্দ ও কাশ্মীরির দরসের প্রভাবে তিনি হানাফি মাযহাবে সুদৃঢ় হন।
শিক্ষকতা: পড়াশুনা সমাপ্ত হবার পর দারুল উলূমের দরস -তাদরিসের কাজে জুড়ে পড়েন। সেসময় দারুল উলূমের প্রকাশিত 'আল-কাসিম ও আর-রশিদের সম্পাদনার কাজও তিনি করতেন। ১৩৩৮ হিজরী মোতাবেক ১৯২০ সালে জামিয়া উসমানিয়া হায়দারাবাদে শিক্ষকতায় নিয়োগ পান। সেখানে তিনি হামীদুদ্দিন ফারাহির সাহচর্য পান। তার কুরআন বিষয়ে প্রচুর গবেষনা ছিলো। ফারাহির সাহচর্যে মানাযির আহসান গিলানির সামনে কুরআনের আশ্চর্যের কিছু দিক উন্মোচিত হয়। তিনি সেখানকার ‘দ্বীনিয়্যাত’ (ধর্মীয়) শাখার প্রধান ছিলেন। ১৯৪৯সালে খেদমত থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
রচনা: তার রচনাশৈলী ছিলো মন কেড়ে নেওয়ার মতো। প্রতিটা রচনাই ছিলো সাহিত্যের রসে টুইটুম্বর। সবকটি রচনাতেই সুচিন্তার গভীর ছাপ রয়েছে। সহজেই পাঠক তার লেখার যাদুতে আটকে যেতো। গদ্যের মতো পদ্যেও ছিলেন তিনি সিদ্ধহস্ত।
তিনি তার জাদুময় লেখা নিয়ে ইসলামের অনেক খেদমত আঞ্জাম দিয়েছেন। সুলাইমান নদভির ভাষায়, মানাযির একটি নাম। যার কলম ইসলামের সুরক্ষায় দূর্দান্ত গতিতে কাজ করে যাচ্ছে। তিনি ইলমে দ্বীনের এমন বিশাল খেদমত আঞ্জাম দিচ্ছেন, যা সকল মুসলমানদের শুকরিয়ার বিষয়।
ইতিহাসে পাতায় তার গভীর পদাচারণা ছিল। তার রচনাবলীতে তিনি ইতিহাসের অনেক দিকই তুলে আনতেন। বিশেষ করে তিনি ‘তাদবীনে হাদিস’-(হাদিস সংকলনের ইতিহাস) এর আলোচনায় এক ধরনের নতুনত্ব সৃষ্টি করেছেন। এ বিষয়ে চমৎকার একটা কিতাব লিখেছেন,যা আজকের ইলমি অঙ্গনে সুবিদিত। নাম 'তাদবীনে হাদিস'। কিতাবটির মূল্যায়নে সুলাইসান নদভীর বক্তব্যটা পড়ুন, (এ কিতাবটিতে) তিনি যুগের ভাষা ও উপস্থাপনায় ইলমে হাদিসের পরিচয়, গুরত্ব ও তাদবিনে হাদিসের উপর মুহাক্কিকানা (গবেষণাধর্মী) আলোচনা করেছেন।
তিনি তার কিতাবটিতে হাদিসে নববীকে ইতিহাস হিশেবে দেখেছেন।তার বক্তব্য, হাদিসের ইতিহাস একটি বৈপ্লবিক ইতিহাস। এর সাথে পৃথিবীর অন্য কোন ইতিহাসের তুলনা হয় না। নির্মলতা,বিশুদ্ধতা ও নির্ভরযোগ্যতার প্রশ্নে এ ইতিহাস অন্যসব ইতিহাসকে ছাড়িয়ে।
তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, অতীত বর্তমানের অন্য যে কোন ইতিহাস যতই চাকচিক্য নিয়ে আসুক তা নির্ভরযোগ্যতা ও বিশুদ্ধতার ক্ষেত্রে হাদিসের ইতিহাসের সামনে দাঁড়াতে পারে না। অন্য যে কোন ইতিহাসের সাথে এর বিস্তর পার্থক্য রয়েছে।
তিনি তার বয়ানে অনেকগুলো পার্থক্য তুলে ধরেছেন। প্রথমত, এ ইতিহাসের পরিধি অন্যান্য ইতিহাসের মতো ব্যাপক (গোটা জাতিগোষ্ঠী সম্পর্কিত) পরিমন্ডলে না হয়ে ব্যক্তিবিশেষে (শুধু নবীজীবন) সীমাবদ্ধ থাকায় এর বিশুদ্ধতা ও নির্ভরযোগ্যতা বেশি।
দ্বিতীয়ত, এ ইতিহাসের একজন দু'জন নয়,বহুজন চাক্ষুসদর্শী রয়েছে। তারা (সাহাবায়ে কেরাম) এ ইতিহাস (নবীজি সা.এর জীবন) নিজের চোখে দেখেছেন এরপর বর্ণণা করেছেন। এরকমভাবে অন্য কোন ইতিহাসে এর প্রত্যক্ষদর্শী পাওয়া বিরল। ফলে অন্য ইতিহাসের সূচনাটা হয় অস্পষ্টতার ভিত্তিতে। সময়ের আবর্তনে তা হয় আরও সংশয়পূর্ণ।
পরবর্তী জেনারেশনের হঠাৎ কারো মন চাইলো, আর সে স্বার্থের নিক্তিতে ইচ্ছেমতো ইতিহাসের কিছুটা নিলো, কিছু ছুঁড়ে মারল এটা অন্যান্য ইতিহাসের বাস্তবতা। এছাড়া ওসব ইতিহাসে অনেক ক্ষেত্রে রাজনীতি ইত্যাদির প্রভাব থাকে। ফলে একপেশে হওয়া বা একই মোড়লে চলে যাওয়া অসম্ভবের কিছু না। পশ্চিমাদের ইতিহাসকরণ এ নিয়ম ধরেই চলছে।
তৃতীয়ত, এ ইতিহাসের প্রত্যক্ষদর্শীদের প্রত্যেকেই একেকটা জীবন্ত ছবি। অর্থাৎ সাহাবায়ে কেরাম নবীজি সা. থেকে যা দেখতেন, যা শুনতেন সঙ্গে সঙ্গে আমলও করতেন। যার মধ্যমে সেই ইতিহাসের জীবন্ত ছবি ফুটে উঠে। ফলত, এ ইতিহাসের নির্মলতা, বিশুদ্ধতা ও নির্ভরযোগ্যতা নিশ্চিত হয়। অন্য যে কোন ইতিহাসে এ জীবন্ত ছবির সংকট রয়েছে। সুতরাং অন্য ইতিহাসের চেয়ে এর নির্ভরযোগ্যতা বেশি।
সর্বোপরি এ ইতিহাস বিকাশের প্রশ্নে রয়েছে কঠোর হুঁশিয়ারী। নবীজি সা. বলেছেন, যে ব্যক্তি আমার ব্যাপারে মিথ্যা বলবে সে যেনো তার ঠিকানা জাহান্নাম বানিয়ে নেয়। যা অনেক ক্ষেত্রেই সঠিক বিকাশের নিশ্চয়তা দেয়।
এছাড়াও রয়েছে তার দারুণ কিছু কিতাব। এগুলোর মাঝে আন-নাবিয়্যুল খাতাম, হিন্দুস্তান মেঁ মুসলমানোঁ কা নেযামে তালিম ওয়া তারবিয়াত, আবূ যর গিফারি, ইসলামি মায়াশিয়াত, ইমাম আবু হানিফা কি সিয়াসি যিন্দেগি, তাযকিরায়ে শাহ ওয়ালিউল্লাহ, সাওয়ানেহে কাসেমি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
বাইয়াত: তিনি যখন হায়দারাবাদে ছিলেন, তখন শায়খ হাবিব আল-আইদারুস থেকে কাদরিয়্যাহ তরিকার (হিন্দুস্থানে প্রচলিত তাসাউওফের চার তরিকার একটি) তরবিয়ত শিখেন এবং তার থেকে খেলাফতও লাভ করেন। পাশাাপাশি সময়ে হায়দারাবাদের আরেকজন বুযুর্গ মাওলানা মুহাম্মদ হুসাইন সাহেব থেকে চিশতিয়া তরিকার (চার তরিকার আরেকটি) খেলাফত পান। অবশ্য এর আগে তিনি শায়খুল হিন্দ রহ এর কাছেও বায়াত গ্রহণ করেছিলেন।
মৃত্যু: ১৩৭৫ হিজরির ২৫ শাওয়াল মোতাবেক ১৯৫৬ ঈসায়ীর ৫ জুন পরাপারে পাড়ি জমান। নিজের গ্রামের বাড়ি গিলানেই তাকে দাফন করা হয়। মৃত্যুর সময় তার বয়স ছিলো ৬৪ বছর।
লেখক: শিক্ষানবিশ, জামিয়াতুল উলূমিল ইসলামিয়া মুহাম্মদপুর, ঢাকা
-এটি