মুহাম্মদ এহসানুল হক।।
বর্তমানে আমরা খুবই নাজুক সময় পার করছি। করোনা ভাইরাসের সামনে গোটা পৃথিবী আজ অসহায়। গত কয়েক শতাব্দীতে এমন বিপর্যয় পৃথিবীতে আসেনি। এক দিকে মানুষ গণহারে মৃত্যু বরণ করছে। অপর দিকে ঘনীভূত হচ্ছে অর্থনৈতিক সংকট। অন্য সব সেক্টরের মত কওমি মাদরাসাগুলোও এই সংকট থেকে মুক্ত নয়। লকডাউনের সময়কাল এখনো শেষ হয়নি। এখনই বিভিন্ন মাদরাসা থেকে অর্থ সংকটের কথা সামনে আসছে। শিক্ষকদের বেতন হচ্ছে না, মাদরাসায় বাড়ি ভাড়া দেয়া যাচ্ছে না। মাদরাসা শিক্ষকদের বেতন এমনিতেই কম, তাও যদি না পায় তাহলে কিভাবে চলবে। সামনের দিনগুলোতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। এই শঙ্কা থেকেই এখন আওয়াজ উঠেছে দুই লাখ মাদরাসা শিক্ষকের কি হবে? দুই লাখ মাদরাসা শিক্ষদের দেখার কেউ নেই।
দুইটা সম্ভবনাকে সামনে রেখে এই আওয়াজ উঠেছে। এক. কওমি মাদরাসা শিক্ষার যেহেতু এখন সরকারী স্বীকৃতি হয়েছে, তাই এক্ষেত্রে সরকার কওমি মাদরাসাকে সহযোগীতা করতে পারে। একটা অনুদান দিতে পারে। সরকার তো কত জায়গায় লক্ষ কোটি টাকা ব্যয় করছে, সরকার ইচ্ছে করলেই আমাদের সাহায্য করতে পারে। দুই. আমাদের মাদরাসা বোর্ড এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে। বোর্ড আমাদের কাছ থেকে যুগ যুগ ধরে চাঁদা নেয়। বোর্ডের ফান্ডে যথেষ্ট টাকাও আছে। তারা চাইলেই সাহায্য করতে পারে।
আমাদের এই কথাগুলো আত্মঘাতী মনে হচ্ছে। কারণ কওমি মাদরাসার একেবারে মৌলিক একটা আদর্শগত বিষয় হলো, কওমি মাদরাসা সরকারী সাহায্য সহযোগীতায় চলে না। কওমি মাদরাসা সরকারী অনুদান নেয় না। কওমি সনদের স্বীকৃতি নেয়ার সময়ও এই আলোচনা বারবার হয়েছে যে, আমরা সরকারি সাহায্য নেব না।
আমার প্রশ্ন হলো, এখন পনের দিনের লকডাউনেই আমাদের সুর পাল্টে গেল কেনো? আমাদের এতকালের সরকারী অনুদান না নেয়ার শপথ কোথায় গেলো? দুই লাখ শিক্ষক এর মধ্যে এক লাখ শিক্ষক কি এই সংকট এ পড়েছে? পঞ্চাশ হাজার শিক্ষক কি হাত পাতার পর্যায়ে পড়েছে? আমি বিশ্বাস করি এই পরিস্থিতি হয়নি। তাহলে এত দ্রুতই কেন আমরা হাহাকার শুরু করলাম?
অনেকে হয়তো বলবেন, আমার প্রয়োজন নাই, আমার ক্ষুদা নাই, তাই আমি এসব কথা বলছি। আমি স্বীকার করছি আমার প্রয়োজন নাই। যারা এই দাবি তুলেছেন তারাও কিন্তু আমার মতই। তারাও নিজে সমস্যায় পড়েনি। বাস্তবে যারা সংকটে পড়েছে তারা কিন্তু এখনো মুখ বুজে আছে। মুখ বুজেই থাকবে।
যারা এই দাবি তুলেছেন তাদের নিয়ত বা আন্তরিকতা নিয়ে আমার কোন প্রশ্ন নাই। নিঃসন্দেহে তারা অসহায় মাদরাসা শিক্ষকদের কল্যাণ চিন্তা থেকেই এই দাবিগুলো তুলেছেন। আমি তাদের চিন্তাকে অন্তর থেকে শ্রদ্ধা জানাই। কিন্তু আমাদের সচেতন থাকতে হবে, উপকার করতে গিয়ে যেন ক্ষতি না হয়। আমাদের এই দাবির মাধ্যমে কওমি মাদরাসায় সরকারী অনুদান প্রবেশের দরজা খুলে দিবে। একবার যদি অনুদান নেয়া শুরু হলে কিছু দিন পরপরই নানারকম প্রয়োজন দেখা দিবে, তখন সেটা আটকাবেন কি করে?
শুধু তাই নয়। কোন বোর্ডের হাতে কত টাকা আছে সেই হিসাব অনেকভাই ফেসবুকে দিচ্ছেন কোন বিবেচনায়? মাদরাসা বোর্ডের ফান্ড নিয়ে পাবলিক প্লেসে এভাবে কথা উঠতে থাকলে একসময় সেটা মিডিয়ায় আসবে। তারপর সেখানে সরকারী হস্তক্ষেপের পরিস্থিতিও সৃষ্টি হতে পারে। তা যদি নাও হয়, তবুও আমি মনে করি ফেসবুকের মত জায়গায় এই জ্ঞানগুলো না থাকলেই ভালো। আমাদের তরুণরা এমনিতেই বড়দের ব্যাপারে কথা বলতে অসংযত। এরপর যদি তাদের হাতে এসব অস্ত্র তুলে দেয়া হয় তখন তাদের কে ঠেকাবে?
আজকে যদি সরকার ঘোষণা দেয়, সরকার মাদরাসাগুলোতে সহযোগীতা দিবে। আপনি কি মনে করেন সবাই এই সহযোগীতা নিবে? অবশ্যই অধিকাংশ মাদরাসা এটা প্রত্যাখান করবে। গ্রহণ করবে না। সরকার যদি দিতে যায় তখন সেই অনুদানের বিরুদ্ধেও ফেসবুকে জিহাদ হবে।
তাই আমি আহবান করি, মাদরাসা শিক্ষকদের নিয়ে এ ধরনের আলোচনা থেকে বিরত থাকুন। মাদরাসা শিক্ষকগণ এখনো এতো অসহায় হয়ে যায়নি। আমি বিশ্বাস করি, আমাদের দেশে যদি ইটালি বা অন্য দেশের মত ভয়াবহ পরিস্থিতি না হয়, তাহলে আরও এক মাস লকডাউন থাকলেও ইনশাআল্লাহ কওমি মাদরাসায় সরকারী অনুদানের প্রয়োজন হবে না। আলেমদের উদ্যোগে এখন লক্ষ লক্ষ টাকার ত্রাণ বিতরণ হচ্ছে। সবাই মিলে বিপদগ্রস্ত মাদরাসা গুলোর দিকে নজর রাখলেই চলবে।
আমাদের বোর্ডের কাছে কত টাকা আছে, বোর্ড কাকে কত টাকা অনুদান দিয়ে দিয়েছে এই হিসাব এভাবে প্রদান করা উচিত না। তবে এটা ঠিক, আমাদের বেফাক ও হাইআর উদ্যোগে বা সহযোগীতায় অনতিবিলম্বে শিক্ষক কল্যাণ ট্রাস্ট জাতীয় কিছু করা জরুরি। শুধু বোর্ডগুলোই নয়, সকল মাদরাসায় আপতকালীন বিশেষ ফান্ড থাকা প্রয়োজন। আর হ্যাঁ, কওমি মাদরাসাগুলোতে কিছু অর্থ সংকট সব সময় ছিল, সামনের দিনগুলোতেও থাকবে। তাই বলে সরকারী অনুদান চাই না।
লেখক: শিক্ষক, জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া
-এএ