মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪ ।। ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :
সৌদির সেবা কোম্পানির সঙ্গে হজ এজেন্সির চুক্তির নির্দেশনা মহেশখালী থানার বিশেষ অভিযানে পরোয়ানাভুক্ত ১১ জন আসামি গ্রেফতার বৃষ্টির সময় কাবা প্রাঙ্গণে নামাজ আদায় ওমরা পালনকারীদের নিউ বসুন্ধরা রিয়েল এস্টেট গ্রাহকদের মূলধন ফেরত পাওয়ার দাবিতে সংবাদ সম্মেলন মাওলানা আতহার আলীকে বাদ দিয়ে জাতীয় ইতিহাস রচিত হতে পারে না: ধর্ম উপদেষ্টা জরুরি সভা ডাকল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কক্সবাজারে উৎসবমুখর পরিবেশে রোপা আমন ধান কাটা শুরু চাঁদপুর হিফজুল কুরআন প্রতিযোগিতায় জামিয়া ইসলামিয়া দারুস সুন্নাহর সাফল্য বগুড়ায় আন্দোলনে নিহত রিপনের মরদেহ কবর থেকে উত্তোলন কুমিল্লায় আন্তর্জাতিক ইসলামী মহাসম্মেলন অনুষ্ঠিত

৪ রজব জুমার বয়ানে মসজিদুল হারামে যা বলেছেন শায়েখ ড. মাহের মুআইকিলি

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

আওয়ার ইসলাম: দুনিয়া ও আখেরাতে নিজের মনখুশি ও চিত্তসুখ লাভের একটি উপায় অপরের মুখে হাসি ফোটানো বা অন্যের মনে খুশির সঞ্চার করা। মানুষ যত বদান্যতা প্রদর্শন করে, তার সুখ ও আনন্দও তত বাড়ে। সে যেমন কর্ম করে, তেমন ফলই বয়ে আনে। উত্তম কাজের প্রতিদান উত্তম ছাড়া আর কী।

মুজাম তাবারানিতে হাসান সনদে বর্ণিত হয়েছে- রাসুলুল্লাহ সা. বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো মুসলিম ভাইয়ের সঙ্গে তাকে খুশি করার জন্য তার পছন্দের কিছু নিয়ে সাক্ষাৎ করে, কেয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে খুশি করবেন।’ অতএব অন্যের মনে আনন্দ সঞ্চার করা একটি মর্যাদাপূর্ণ এবং আল্লাহর অতিপ্রিয় আমল। এটি আল্লাহর দয়া, ক্ষমা ও জান্নাত লাভের মাধ্যম।

ইবনে ওমর রা. থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি নবীজি সা. এর কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, আল্লাহর কাছে কোন লোক অধিক প্রিয়? কোন আমল আল্লাহর বেশি পছন্দের? রাসুলুল্লাহ সা. বললেন, ‘আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় ওই ব্যক্তি, যে অধিক পরোপকারী। আর আল্লাহর অধিক প্রিয় আমল হলো, কোনো মুসলিমের মনে খুশি প্রবেশ করানো, তার কোনো বিপদ দূর করা, তার কোনো ঋণ পরিশোধ করা অথবা তার ক্ষুধা দূর করা। আর অন্য ভাইয়ের প্রয়োজনে হেঁটে যাওয়া আমার কাছে এই মসজিদে (নববিতে) এক মাস ইতিকাফ করার চেয়ে উত্তম।’ (তাবারানি, হাসান সনদে)।

মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর একটি উপায়- তাদের পছন্দকে গুরুত্ব দেওয়া, তাদের অসুবিধা নিরসন করা কিংবা তাদের প্রয়োজন বা চাহিদা পূরণের জন্য পথচলা। নেকি ও কল্যাণ লাভের এ এক বিশাল দুয়ার। খাঁটি মোমিনদের একটি নিদর্শন। খাঁটি মোমিনরা পারস্পরিক দয়া, ভালোবাসা ও সহানুভ‚তি প্রদর্শনে একটি দেহের মতো। যখন দেহের একটি অঙ্গ রোগে আক্রান্ত হয় তখন শরীরের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ রাত জাগে এবং জ্বরে অংশগ্রহণ করে।

এ কারণেই ইসলামের মনীষী ও উম্মতের শ্রেষ্ঠ পূর্বসূরিরা অপরের প্রয়োজন পূরণ, তাদের উপকার সাধন ও কষ্ট দমনে চেষ্টা এবং ভালো সুপারিশের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভের চেষ্টা করতেন। বাইহাকির শুআবুল ঈমান গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে- একবার ইবনে আব্বাস রা. আল্লাহর রাসুলের সা. মসজিদে ইতিকাফ করছিলেন।

এক লোক এসে তাকে সালাম দিয়ে সামনে বসে গেল। ইবনে আব্বাস রা. তাকে বললেন, ‘হে অমুক ব্যক্তি, তোমাকে তো খুব চিন্তাগ্রস্ত ও ভগ্নমন দেখতে পাচ্ছি।’ বললেন- হ্যাঁ, আমার ওপর অমুক ব্যক্তির কিছু পাওনা আছে, যা আমি পরিশোধ করতে সক্ষম নই। ইবনে আব্বাস রা. বললেন, আমি কি তোমার ব্যাপারে তার সঙ্গে কথা বলব? তিনি বললেন, আপনি ভালো মনে করলে বলুন।

(বর্ণনাকারী) বলেন, ইবনে আব্বাস রা. উঠে দাঁড়ালেন এবং মসজিদের বাইরে চলে এলেন। লোকটি তখন বলল, আপনি কি নিজের অবস্থা (ইতিকাফ) ভুলে গেছেন? তিনি বললেন, না আমি ভুলিনি। তবে এই কবরবাসীকে আমি বলতে শুনেছি। তিনি বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের প্রয়োজনে অগ্রসর হয় আর তা সম্পাদন করে, এটি তার জন্য দশ বছর (নফল) ইতিকাফের চেয়ে উত্তম হবে।’

অন্যের মুখে হাসি ফোটানোর আরেকটি উপায়- অপরের সঙ্গে হাসিমুখে মিলিত হওয়া। রাসুলুল্লাহ সা. ছিলেন সবচেয়ে বেশি মুচকি হাসিসম্পন্ন। জারির বিন আবদুল্লাহ বাজালি রা. বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ সা. যখনই আমাকে দেখেছেন, আমার মুখে অবশ্যই হেসে দিয়েছেন।’ সুনান তিরমিজিতে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ সা. বলেন, ‘তোমার ভাইয়ের মুখে তোমার হাসিও তোমার জন্য একটি সদকা।’ মুজামু তাবারানিতে বর্ণিত হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের প্রয়োজন মেটাতে তার সঙ্গে হাঁটে আর সেটা মিটিয়ে দেয়, আল্লাহ তার পা স্থির রাখবেন, যেদিন পাগুলো টলে যাবে।’

অন্যের মুখে হাসি ফোটানোর আরেকটি উপায়- হাদিয়া বিনিময় করা। আল্লাহর বান্দারা, উপহার ভালোবাসা টেনে আনে, সৌহার্দ্য মজবুত করে, অন্তর আকর্ষণ করে এবং মনের হিংসা-বিদ্বেষ দূর করে। নবী সা. এর সুন্নত ছিল, তিনি হাদিয়া দিতেন এবং হাদিয়া কবুল করতেন। বোখারিতে বর্ণিত হয়েছে, নবী সা. এর কাছে কিছু কাপড় হাদিয়া এলো। যার মধ্যে একটি ছোট কালো বস্ত্রও ছিল। নবীজি বললেন, ‘এটি কাকে পরাবে বলে তোমরা মনে করছ?’ উপস্থিত লোকেরা নীরব রইল।

তিনি বললেন, ‘আমার কাছে উম্মে খালেদকে আনো।’ ছোট্ট মেয়ে যার জন্ম হাবশায়। তাকে কাঁধে করে আনা হলো। নবীজি সা. নিজ হাতে ওই ছোট বস্ত্রটি নিয়ে তাকে পরিয়ে দিলেন। মেয়েটি খুশিতে গদগদ হয়ে কাপড় দেখছিল। নবী সা. সানন্দে বলতে লাগলেন, ‘এটি পরো এবং পুরোনো করে ফেল। হে উম্মে খালেদ, এটা সানাহ। এটা সানাহ।’ হাবশার ভাষায় যার অর্থ- এটা বড় সুন্দর।

নবীজি সা. পরিবার ও সঙ্গী-সাথীদের মনে আনন্দ দিতে তাদের সঙ্গে কৌতুক করতেন। যেমন- মুসনাদ আহমাদে বর্ণিত হয়েছে- এক মরুবাসী সাহাবির নাম ছিল যাহের (বিন হারাম। তিনি মরু-অঞ্চল থেকে নবীজির জন্য ফলমূল, শাকসবজি উপঢৌকন নিয়ে আসতেন)। যাহেরকে মহানবী সা. ভালোবাসতেন। (ফলে তার সঙ্গে রসিকতা করতেন)।

যাহের দেখতে অসুন্দর ছিলেন। একদা তিনি নিজের পণ্য বিক্রি করছিলেন। এ অবস্থায় নবী সা. তার কাছে এসে পেছন থেকে বগলের নিচে হাত পার করে জড়িয়ে ধরে অথবা তার পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে চোখ দুটিতে হাত রেখে বলতে লাগলেন, ‘কে গোলাম কিনবে?’ ‘কে গোলাম কিনবে?’ যাহের বললেন, ‘তাহলে আমাকে সস্তা পাবেন!’ নবী সা. বললেন, ‘না বরং তুমি আল্লাহর কাছে সস্তা নও।’ কিংবা তিনি বলেছেন- ‘আল্লাহর কাছে তুমি মূল্যবান।’

তেমনি তাবুক যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করা তিন সাহাবির ঘটনায় আমরা দেখি সাহাবায়ে কেরাম রা. অন্যের মুখে হাসি ফোটানো এবং অন্যের আরাধ্য বিষয়ের সুসংবাদ দিতে কীভাবে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতেন।

রাতের শেষ প্রহরে কাব রা. ও তার দুই সাথীর তওবা কবুল করে আল্লাহ তায়ালা আয়াত নাজিল করেন। নবী সা. তখন ছিলেন উম্মে সালামা রা. এর ঘরে। রাসুলুল্লাহ সা. বললেন, ‘হে উম্মে সালামা, কাবের তওবা কবুল হয়েছে।’ উম্মে সালামা রা. বললেন- তাকে সুসংবাদ দেওয়ার জন্য কাউকে তার কাছে পাঠাব? নবী সা. বললেন- এখন খবর পেলে সব লোক এসে জড়ো হবে। তারা তোমাদের সারারাতের ঘুম নষ্ট করে দেবে। রাসুল সা. ফজরের নামাজ আদায়ের পর (সবার সামনে) তিন সাহাবির তওবা কবুল হওয়ার কথা ঘোষণা করে দিলেন। তৎক্ষণাৎ কোনো সাহাবি নিজের ঘোড়া নিয়ে ছুটলেন সুসংবাদ আগে পৌঁছে দিতে। কেউ আবার ‘সাল’ পর্বতে উঠে চিৎকার করে সুসংবাদ ঘোষণা করে উঠলেন।

কাব রা. বলেন, আমি যখন আল্লাহর বিবরণ দেওয়া সেই অবস্থায় ছিলাম- মন সংকুচিত। প্রশস্ত হওয়া সত্তে¡ও পৃথিবী আমার জন্য সংকীর্ণ- এক চিৎকারকারীর আওয়াজ শুনতে পেলাম। ‘সাল’ পাহাড়ে উঠে সে উচ্চৈঃস্বরে চিৎকার করে বলছে, ‘হে কাব বিন মালিক! সুসংবাদ গ্রহণ কর!’

কাব বলেন, আমি আল্লাহর দরবারে সিজদায় পড়ে গেলাম। আমি অনুধাবন করতে পারলাম যে, এবার সংকট কেটে গেছে। আমি রাসুল সা. এর সঙ্গে সাক্ষাতের উদ্দেশে বের হলাম। পথে দলে দলে লোকজন আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করছিল এবং তওবা কবুল হওয়ার জন্য আমাকে মুবারকবাদ জানাচ্ছিল। তারা বলছিল, তোমার তওবা কবুল করে আল্লাহ তোমাকে যে পুরস্কৃত করেছেন, এজন্য তোমাকে মুবারকবাদ। কাব রা. বলেন, এভাবে আমি মসজিদে প্রবেশ করলাম। সেখানে রাসুলুল্লাহ সা. লোকজন পরিবেষ্টিত হয়ে বসেছিলেন।

কাব রা. বলেন, তারপর আমি রাসুলুল্লাহ সা. কে সালাম দিলাম। তখন খুশিতে তাঁর চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। রাসুল সা. বললেন, ‘হে কাব, তোমার মা তোমাকে জন্ম দেওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত অতিক্রান্ত দিনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো দিনের সুসংবাদ গ্রহণ কর!’ কাব বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল সা.! এ (ক্ষমা) আপনার পক্ষ থেকে, না আল্লাহর পক্ষ থেকে? তিনি বললেন, না, এ তো আল্লাহর পক্ষ থেকে। রাসুলুল্লাহ সা. যখন খুশি হতেন, তখন তাঁর চেহারা একফালি চাঁদের মতো উজ্জ্বল হয়ে উঠত। আমরা চেহারা দেখে তাঁর খুশি বুঝতে পারলাম। (বর্ণনায় বোখারি)।

অতএব, হে আল্লাহ ও রাসুলে বিশ্বাসী বান্দারা, আপনার ভাইদের হৃদয়ে তাদের অনুপস্থিতিতে খোঁজখবর নেওয়া, অসুস্থতায় দেখতে যাওয়া, পরস্পর সংশোধন করে দেওয়া, কষ্ট ও দুশ্চিন্তা লাঘব করা, ক্ষুধার্তকে আহার করানো এবং ঋণ পরিশোধ করে দেওয়ার মাধ্যমে আনন্দ সঞ্চার করুন। বুদ্ধিমান ও সচেতন ব্যক্তি তার মুসলিম ভাইকে আনন্দিত করার কোনো সুযোগ হাতছাড়া করে না।

জেনে রাখবেন, আনন্দিত হওয়া এবং আনন্দিত করা আল্লাহর একটি গুণ। সহিহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে, রাসুল সা. বলেন, ‘বান্দা যখন আল্লাহর কাছে তওবা করে, তখন আল্লাহ ওই ব্যক্তির চেয়েও অধিক খুশি হন, যে বিশাল বিস্তৃত ভ‚মিতে সফর করছিল, হঠাৎ তার বাহন পালিয়ে গেল, যে বাহনে তার খাদ্য ও পানীয় ছিল। কোনো উপায় না দেখে সম্পূর্ণ নিরাশ হয়ে মৃত্যুর অপেক্ষায় একটি বৃক্ষের ছায়ায় শুয়ে পড়ল।

এমতাবস্থায় হঠাৎ বাহনটি তার পাশেই উপস্থিত পেল। সে লাগাম হাতে নিয়ে আনন্দের আতিশয্যে বলে ফেললো, আল্লাহ! তুমি আমার বান্দা এবং আমি তোমার প্রভু। অতি আনন্দে ভুল বলে ফেলল।’

সূত্র: ৪ রজব ১৪৪১ হিজরি মক্কার মসজিদে হারামে প্রদত্ত খুতবার সংক্ষিপ্ত ভাষান্তর। ভাষান্তর: আলী হাসান তৈয়ব।
-এটি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ