মুসা আল হাফিজ (জন্ম : ১৯৮৪ খ্রি.) বাংলা সাহিত্যের ভাববাদী-ঐতিহ্যবাদী সড়কে গতিমান এক সুস্বর কবি। কবিতার পাশাপাশি দর্শনচিন্তাও তাঁর মননে সদা প্রবাহমান। সেই চিন্তা থেকেই রচিত হয়েছে তাঁর নক্ষত্রচূর্ণ। কথামালার আবহে এ গ্রন্থে দর্শনের সূত্রবদ্ধ জ্ঞান বাস্তব জীবনের পরিপ্রেক্ষিতে উপস্থাপিত হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) কণিকা কাব্যগ্রন্থে যেমন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয়কে তাঁর কাব্য রচনার উপজীব্য হিসেবে গ্রহণ করেছেন, তদ্রুপ কবি মুসা আল হাফিজ জীবন ও জগতের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয়কে স্বীয় দর্শনচিন্তার বাহন হিসেবে গ্রহণ করেছেন।
নক্ষত্রচূর্ণ গ্রন্থে লেখকের বোধ ও জীবনদৃষ্টি পাঁচটি স্বতন্ত্র প্রবাহে উপস্থাপিত হয়েছে এগুলোর শিরোনাম : ‘নক্ষত্রচূর্ণ’, ‘উড়ন্ত সাক্ষাৎকার’, ‘প্রকৃতির পাঠশালা’, ‘বোধির বৃষ্টিজল’ এবং ‘কথা ও কথিকা’। ‘নক্ষত্রচূর্ণ’ লেখকের জ্ঞান ও প্রজ্ঞাস্নিগ্ধ কথামালার সমাহার এবং এ অধ্যায়ের শিরোনামেই গ্রন্থনাম নির্বাচিত হয়েছে। নক্ষত্রকে ভাঙলে যেমন অসংখ্য চূর্ণ পাওয়া যায়, এ রচনাও তদ্রুপ অসংখ্য চূর্ণের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে।
এখানে রয়েছে লেখকের ৪০টি ধারণা বা দর্শনচিন্তা, যে চিন্তায় ব্যক্তি মানুষ ও সামাজিক মানুষের মনোভাবনা বিকশিত হয়েছে। ব্যক্তি মানুষের আমিত্ব আর সামষ্টিক মানুষের পরিপুষ্টি নিয়ে লেখকের বক্তব্য অত্যন্ত স্পষ্ট। ব্যক্তি মানুষের জ্ঞান, প্রজ্ঞা, মেধা, শিক্ষা, সংস্কৃতি, মনোভূমি বর্ণনার পাশাপাশি লেখক সামষ্টিক মানুষের সমাজ, রাজনীতি, পাপ, বিভিন্ন সম্প্রদায় সহ বিচিত্র বিষয়ে তাঁর চিন্তার বিস্ফোরক উপস্থাপন করেছেন। যেমন
জ্ঞান প্রসঙ্গে বলেন, ‘অধিকাংশ ‘আমি’রাই ‘আমি’কে জানে না। কারণ একদিক থেকে জানাটাই জানা নয়।’ (নক্ষত্রচূর্ণ : ১)।
মেধা সম্পর্কে তাঁর ভাষ্য- ‘ মেধা হলো সারের মত। তাকে ধরে রেখো না, ছিটিয়ে দাও ফসল ফলবে।’(নক্ষত্রচূর্ণ : ৩)।
শিক্ষা প্রসঙ্গে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গী- ‘শিক্ষা আছে, সংস্কৃতি নেই, মানে কোনটাই নেই।’ (নক্ষত্রচূর্ণ : ১০)
সংস্কৃতি বিষয়ে তাঁর মতামত :‘শিক্ষা শুধু শিক্ষা, সংস্কৃতি শুধু সংস্কৃতি নয়, স্বাধীনতাও। (নক্ষত্রচূর্ণ : ১১)
মনোভূমি নিয়ে তাঁর চিন্তা : ‘আমার একটি মাতৃভূমি আছে, যেখানে আমি জন্মেছি। আমার আরেকটি মাতৃভূমি আছে, যেখানে আমার মাতৃভূমি জন্মেছে। (নক্ষত্রচূর্ণ : ১২)
রাজনীতি সম্পর্কে তাঁর দর্শন : ‘বাংলাদেশের রাজনীতিতে ঈমানের চেয়ে তাহাজ্জুদের গুরুত্ব বেশি। (নক্ষত্রচূর্ণ : ১৫)
বিভিন্ন সম্প্রদায় সম্পর্কে তাঁর উপলব্ধি : ‘এমন বহু প্রকল্প আছে, যার পরিকল্পনা করে কিছু ইহুদি, টাকা দেয় কিছু খ্রিস্টান, বাস্তবায়ন করে কিছু মুসলিম।’ (নক্ষত্রচূর্ণ : ২৫)
প্রজ্ঞা সম্পর্কে তাঁর অভিমত, ‘প্রজ্ঞা বিশ্বাসের দুধভাই’ (নক্ষত্রচূর্ণ : ৩১)
পাপ প্রসঙ্গে তাঁর চিন্তা : ‘পাপ যেখানে পরিপূর্ণ হয়ে যায়, মশাও সেখানে বাঘ হয়ে যায়।’ (নক্ষত্রচূর্ণ : ৩৩)
সমাজ সম্পর্কে তার মতামত : ‘এই অসুস্থ সমাজে সফল ব্যক্তি মানেই ভালো ব্যক্তি নয়। (নক্ষত্রচূর্ণ : ৩৭)
‘উড়ন্ত সাক্ষাৎকার’এ গ্রন্থের দ্বিতীয় অধ্যায়। যাতে অনেকগুলো সাক্ষাৎকার সংকলিত হয়েছে। এগুলো কয়েকটি উপশিরোনামে বিভক্ত। যথা ‘প্রথম বৈঠক’ ‘দ্বিতীয় বৈঠক’ ‘বিবিধ প্রসঙ্গ’ ও ‘পরাবাস্তব আলাপ।’ এ অধ্যায় গঠিত হয়েছে দার্শনিকতার প্রাচীন ও চিরায়ত একটি ধারা প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে। নিজের সাথে নিজের সংলাপ ও সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে নিবিড় গহীন জীবনবার্তা এখানে উচ্চকিত। প্রতিটি আলাপই দুই লাইনের।
‘মহৎ’, ‘আচরণ’, ‘কৃষকের জীবনী’, ‘ফটকা উন্নয়ন’,‘ করাত ও বৃক্ষের সম্পর্ক’,‘হাডুডু’, চাঁদের গায়ে কলো দাগ’, ‘ভালবাসা’, ‘সংশয়’, ‘অন্ধত্ব’, ‘নদী’, ‘দৃষ্টিবান’,‘মন’, ‘করণীয় কর্ম’, ‘প্রেম’, ‘ধর্ম’, ‘ভূমি ও ভাষা’, ‘অসুন্দর স্বভাব’, ‘বয়স’ ও ‘উচ্চতা’ বিষয়ে এ দার্শনিকের চিন্তা সাক্ষাৎকার আকারে প্রকাশিত হয়েছে। এ দার্শনিকের কিছু ভাবনা নিচে উদ্ধৃত করছি :
প্রেম সম্পর্কে মুসা আল হাফিজের দর্শন হলো : ‘চোখের বদলে চোখ, দাঁতের বদলে দাঁত, প্রাণের বদলে প্রাণ।’ (উড়ন্ত সাক্ষাৎকার: দ্বিতীয় বৈঠক -০১ )
ধর্ম সম্পর্কে তাঁর চিন্তা হলো : ‘ধর্ম এক বিপুল খেত, নৈতিকতা যে খেতের ফসল।’ (দ্বিতীয় বৈঠক: ৩)
অসুন্দর স্বভাব সম্পর্কে তাঁর চিন্তা : ‘স্বভাবে যে অসুন্দর সেও স্বভাবের অসৌন্দর্যকে ভালবাসে না। ( দ্বিতীয় বৈঠক: ৯)
মানুষের উচ্চতা সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গী : ‘মানুষের আসল উচ্চতা ফিতা দিয়ে ইঞ্চি ইঞ্চি করে মাপা যায় না। মানুষের প্রকৃত উচ্চতা তার মনের সমান।’ (দ্বিতীয় বৈঠক: ১১)
ভূমি ও ভাষা সম্পর্কে তাঁর অভিমত : ‘ভূমিকে কবি ভাষা বানাবে, ভাষাকে বানাবে ভূমি।’ (উড়ন্ত সাক্ষাৎকার: বিবিধ প্রসঙ্গ: ৩)
‘প্রকৃতির পাঠশালা’ আলোচ্য গ্রন্থের তৃতীয় অধ্যায়। এ অধ্যায়ে প্রকৃতি থেকে আহরিত ৭০ টি বিষয়কে লেখক সূত্রবদ্ধ করেছেন। মানব জীবনে প্রকৃতির দান অপরিসীম। প্রকৃতির রাজ্যে লালিত ও পালিত হয় মানুষের জীবন। ঘর থেকে বের হলেই আমরা অনুভব করি প্রকৃতির পরশ। কখনও কোমল-মধুর, আবার কখনও রুদ্র-কঠোর।
প্রকৃতির সকল ছোঁয়া-ই মানব জীবনকে ফুলে ফলে সুশোভিত করেছে। মানুষের শ্বাস প্রশ্বাস, খাদ্য, চিকিৎসা, আরাম-আয়েশ, দৈনন্দিন জীবন-যাপনসহ প্রতিটি মুহূর্ত প্রকৃতির রঙে রঞ্জিত। এই প্রকৃতির ক্ষুদ্র বা বৃহৎ বিষয়গুলিকে লেখক চমৎকার চিন্তার বন্ধনে উপস্থাপন করেছেন। যেমন তিনি বলছেন: ‘ নরম মানেই নিরাপদ নয়। কত নরম শামুকের মুখ, কিন্তু তার আছে ২৫ হাজার দাঁত।’ (প্রকৃতির পাঠশালা-০১)।
গতি মানুষের কাছে এক শক্তির আধার। সূর্যের আলোর গতি, রকেটের গতি, বিমানের গতি, ট্রেনের গতি, বাসের গতি, ক্রিকেট বলের গতি বা মানব জীবনে চলার গতি বিচিত্রধর্মী। তবে সেই গতি দিয়েই সব সময় সফলতা অর্জন করা যায় না। বীর হতে হলে গতির সাথে নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতাও প্রয়োজন। এজন্য তাঁর দর্শন : ‘গতি দিয়েই বীর হওয়া যায় না। একটি নোংরা মাছিও মিনিটে ৮ কিলোমিটার উড়তে পারে।’ (প্রকৃতির পাঠশালা-০২)।
পশুপাখির ভেতর এমন প্রাণী আছে, যারা সব কাজ নিজ দায়িত্বে গ্রহণ করে, ভাগাভাগি করে যে কোন কাজ সম্পন্ন করে। এ প্রসঙ্গে লেখক উটপাখির উদাহরণ উপস্থাপন করেছেন। যেমন: ‘উটপাখির থেকে শেখার আছে। সংসারের সামান্য কাজকেও তারা একার উপর চাপিয়ে দেয় না। নিজেদের ডিমে তা দিতেও করে ভাগাভাগি। দিনের বেলায় স্ত্রী উটপাখি ডিমে তা দেয়, রাতের বেলায় দেয় পুরুষ উটপাখি।’(প্রকৃতির পাঠশালা-১৬) পিঁপড়া, সাপ, ব্যাঙ, হাতি, বাঘ, কুকুর, হরিণ, শকুন, ঈগল, ছাগল, কুমির, ষাঁড়, মাছ, পরগাছা, কাক প্রভৃতি প্রাণী থেকে মানুষের অনেক কিছু শেখার আছে, যা লেখক তত্ত¡ আকারে পরিবেশন করেছেন।
‘বোধির বৃষ্টিজল’ আলোচ্য গ্রন্থের চতুর্থ অধ্যায়। ইতঃপূর্বের অধ্যায়গুলোতে তত্ত¡সমূহ ক্রমিক নম্বর দিয়ে লেখক উল্লেখ করেছেন, কিন্তু আলোচ্য অধ্যায়ে বিষয়ের শিরোনাম দিয়ে তিনি তত্ত্ব বিবৃত করেছেন। এতে ৬৫টি তত্ত্ব বর্ণিত হয়েছে। ছোট-বড় নানান বিষয়ে তিনি পাঠকের মনকে আন্দোলিত করেছেন।
লেখক প্রথমেই আত্মকথনে মগ্ন হয়েছেন। ‘মুসা আল হাফিজ, তোমার কী হয়েছে ? দিনে তুমি দৃশ্যের সাথে ঝগড়া করো, রাতে অদৃশ্যের সাথে।’ (আপন লড়াই)। ‘দেহ ও আত্মা’, ‘সাম্প্রতিক মানসিকতা’, ‘সারাৎসার’, ‘জরুরি মদ’, সমস্যা ও সমাধান’, ‘বাংলাদেশ ২০১৮’, ‘মানবেতর নীতি’, ‘নাবালেগ রাজনীতি’, ‘মূল্য ও ইনসাফ’, ‘বিজয়ী ও বিজিত’, ‘সামষ্টিক আত্মহত্যা’, ‘প্রেমের প্রকৃতি’, ‘হুশিয়ারি’, দেয়ালিকা’, ‘আসল আমরা’ ‘ভোগ আর ত্যাগ’, ‘কাজ বনাম কাতুকুতু’, ‘সুখ-দুঃখ’ ‘প্রাণ ও প্রকৃতি’ ‘জুলুম’, ইত্যাদি নানা মাত্রায়, নানা স্বাদ ও মেজাজে দার্শনিক সত্য ভাষারূপ পেয়েছে। লেখক মানবসত্তার অসীম সম্ভাবনাকে সুন্দরভাবে প্রকাশ করেছেন। অলসতা ও কর্মবিমুখতা বাঙালি তরুণ সমাজের প্রধান ত্রুটি। এ ত্রুটি থেকে মুক্তি পেতে প্রয়োজন আত্মসচেতনতা । এজন্য তিনি বলেছেন-
সূর্যে যে কিরণ, তার ২৩ কোটি ভাগের মাত্র এক ভাগ পায় পৃথিবী। তাতেই সেরে যায় নিখিলের প্রয়োজন।
একজন মানুষ ধারণ করতে পারে সূর্যেরও অধিক আলো, যদি সে সঠিকভাবে চায় আর সঠিকভাবে প্রয়াসী হয়।
আলোকধারী এক মানুষ দিয়ে এক পৃথিবী কেন, পৃথিবীর অধিক প্রয়োজন পুরো হওয়ার কথা।
হায়! মানুষ যদি গুরুত্ব দিতো তাঁর সম্ভাবনাকে! (সম্ভাবনার আগার)
বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের পরাজয় আর লাঞ্ছনার মূল কারণ হলো তাদের আদর্শচ্যুতি। এ কারণে অমুসলিম রাজনীতিবিদগণও মুসলিমদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য উপলব্ধি করেছেন। ইসরাইলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী গোল্ডা মেয়ার (১৮৯৮-১৯৭৮) কে জানানো হয়:
‘মুসলিমরা বিশ্বাস করে, ইহুদিদের সাথে তাদের একটি চূড়ান্ত লড়াই হবে। সেখানে তারা জিতবেই। গোল্ডা মেয়ার বললেন, এ মুসলিমদের দিয়ে সেটা হবে না। ইহুদিদের তখনই মুসলিমরা হারাতে পারবে, যখন ওদের ফজরের জামাতে জুমআর মত মুসল্লির সমাগম হবে। (বিজয়ের জোর)।
সামাজিক জীব হিসেবে মানুষ রাজনীতি সচেতন। কেউ সরাসরি রাজনীতি করে, কেউ সাপোর্ট দেয় আবার কেউ থাকে রাজনীতি বিমুখ। তথাপি রাষ্ট্র ও সমাজ জীবনে রাজনীতির গুরুত্ব অপরিসীম। দার্শনিক মুসা আল হাফিজ এ প্রসঙ্গে বলেন :
‘রাজনৈতিক সচেতনতা হচ্ছে, একটি সম্ভাব্য সুযোগের জন্য একটি সুযোগকে পরিহার না করা। কৌশল হচ্ছে একটি বড় লক্ষ্য অর্জনের পথে ছোট লক্ষ্য দ্বারা প্রতারিত না হওয়া।’ (জনতা ও রাজনীতি)।
নক্ষত্রচূর্ণ গ্রন্থের ৫ম বা সর্বশেষ অধ্যায়ের শিরোনাম : ‘কথা ও কথিকা’। আলোচ্য অধ্যায়ে লেখক সংলাপ ও বর্ণনার মাধ্যমে দর্শনশাস্ত্রের তত্ত্বপ্রণেতাগণকে পাঠক সমীপে উপস্থাপন করেছেন। তাদের সাথে জমিয়েছেন কল্পকথন। জগৎবিখ্যাত দার্শনিক {সক্রেটিস (খ্রিস্টপূর্ব-৪৭০-খ্রিস্টপূর্ব ৩৯৯) , প্লেটো (খ্রিস্টপূর্ব ৪২৭ খ্রিস্টপূর্ব-৩৪৭) চাণক্য ( খ্রিস্টপূর্ব-৩৭১- খ্রিস্টপূর্ব ২৮৩) , ইবনে খালদুন (১৩৩২-১৪০৬), ডেভিড হিউম ( ১৭১১-১৭৭৬ খ্রি.), ইমানুয়েল কান্ট (১৭২৪-১৮০৪ খ্রি.) আর্থার শোপেনহাওয়ার (১৭৮৮- ১৮৬০ খ্রি.), সোরেন কিয়ের্কেগার্ড (১৮১৩-১৮৫৫ খ্রি.) টলস্টয় (১৮২৮-১৯১০ খ্রি.) আল্লামা ইকবাল (১৮৭৭-১৯৩৮ খ্রি.) গণের সঙ্গে তাঁদের প্রদত্ত থিওরি নিয়েই লেখক সংলাপে মেতে উঠেছেন।
পাঠক কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া দার্শনিককে এই সংলাপের মাধ্যমে যেন প্রত্যক্ষ করেন। এটি লেখকের চরম সফলতা। এখানে দার্শনিকদের সাথে তার সাক্ষাৎ হয় ভাবলোকে। ডিভাইন কমেডিতে মহাকবি দান্তেকে দেখি ভাবলোকে এক জগত থেকে আরেক জগতে সফর করেন, কথোপকথন ও প্রশ্নোত্তরে মগ্ন হন অতীত-বর্তমানের নানা চরিত্রের সাথে ।
আল্লামা ইকবাল তার জাভিদনামায় উর্ধ্বজগতে যাত্রার বিবরণ দেন, তিনি সফর করেন রুমীর হাত ধরে, সংলাপ চালান অতীতের বহু মনীষীর সাথে। মুসা আল হাফিজের এ সাক্ষাৎ সেই স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়। তিনি পাতালে বা আকাশে যান না, এখানেই থাকেন। শুধু অতিক্রম করেন সময়কে। যেন টাইম মেশিনে অতীতে চলে যাওয়া। কিন্তু অতীতে চলে গেলেও তিনি বর্তমানের চিত্র উপস্থাপন করেন। ফলে তিনি যেন বর্তমান কালের সন্তান হিসেবে নিজের সময়ের প্রতিনিধি হয়ে দার্শনিক সভায় হাজিরা দেন। প্রসঙ্গত সক্রটিসের সঙ্গে মুসা আল হাফিজের সংলাপের চুম্বক অংশ নিচে উদ্ধৃত হলো :
প্রশ্নকর্তা সক্রেটিস, উত্তরদাতা মুসা আল হাফিজ...
: দেশ মানে কী ?
: দল
: দল মানে কী ?
: রাষ্ট্র
: রাষ্ট্র মানে কী ?
: এক ব্যক্তি
: সরকার মানে কী ?
: একটি বিশেষ জেলা
: আইন মানে কী ?
: ব্যক্তির ইচ্ছা
: বিচার মানে কী ?
: তালগাছটা আমার
: উন্নয়ন মানে কী ?
: সেতু
: সেতু মানে কী ?
: উপরি কামাই
: আইন শৃঙ্খলা মানে কী ?
: প্রতিপক্ষ দলন...
সক্রেটিস বললেন এইসব অদ্ভুত সংজ্ঞা পেলে কই ?
বললাম এটাই ডিজিটাল রাষ্ট্রদর্শন। (সক্রেটিসের সান্নিধ্যে)
এভাবে প্রতিটি সংলাপই বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে রচিত হয়েছে। মনোযোগী পাঠক এ অংশকেই সবচেয়ে হৃদয়গ্রাহী হিসেবে গ্রহণ করবেন। মুসা আল হাফিজের দর্শনচিন্তা অভিনব ও পাণ্ডিত্যপূর্ণ। দর্শনের অলি-গলিতে তিনি বিহার করেছেন। সিঞ্চন করেছেন হিরা-জহরত মণি-কাঞ্চন। শুধু চিন্তার জন্য চিন্তা তার আদর্শ নয়। এ গ্রন্থে তাই ব্যক্তি ও সমষ্টির মানসিক পরিগঠনের প্রয়াস জোরদার। মানসিক পরিগঠন যেহেতু তত্ত্বীয় ঐতিহ্যের একটি অংশ, মুসা আল হাফিজ তাই ডিস্কার্সিভ ট্রাডিশন বা তত্ত্বীয় ঐতিহ্যকে আপন দার্শনিক বয়ানে সম্প্রসারিত করেন। এ ক্ষেত্রে বিশ্বাস ও মূল্যবোধ তাকে করে শক্তিশালী। নক্ষত্রচূর্ণ সেই ধারায় জীবনবোধের ঘনত্ব ও সংগতিতে ঋদ্ধ একটি গ্রন্থ। বাংলা ভাষাভাষী সব শ্রেণির পাঠকই তাঁর রচিত এ জাতীয় গ্রন্থপাঠে আহ্লাদিত হবেন, অনুপ্রাণিত হবেন এবং জীবনের গভীরতর তাৎপর্যে অবগাহন করবেন- এ আমার একান্ত বিশ্বাস।
লেখক: ড. ইয়াহইয়া মান্নান, বাংলা বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর।
আরএম/