বেলায়েত হুসাইন
আরব ও ইসলামি জনগণের জন্য চরম অপমান ও হতাশার দিন ২০২০ সালের ২৮ জানুয়ারি মঙ্গলবার। এদিন সমগ্র আরব ও মুসলিম উম্মাহর ওপর নকল একটি শান্তিচুক্তি আরোপ করে কার্যত তাদের ধর্মীয় ও আপন কর্তৃত্বের শেষ শক্তিটুকু উপহাসে রূপান্তর করে ছেড়েছে আমেরিকা।
তথাকথিত ডিল অব সেঞ্চুরি বা শতাব্দীর সেরা চুক্তির নামে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি আনয়নের জন্য ফিলিস্তিন বিরোধী যে শান্তিচুক্তির ঘোষণা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দিয়েছেন- গোটা মুসলিম জাহানের ওপর এটা নির্ঘাত একটি জাতিবিনাশী আক্রমণ। এটার প্রতিরোধ করতে না পারলে মুসলিম উম্মাহ বিশেষত ফিলিস্তিনিরা আরেকটি জাতীয় অস্তিত্ব সংকটের মুখে পতিত হবে। ট্রাম্পের এই শান্তিচুক্তি মূলত ইসরায়েলকে বৈধতা দেয়ার নতুন পরিকল্পনা।
সন্ত্রাসবাদের আশ্রয় নিয়ে সম্পূর্ণ একপেশে নীতিতে মুসলিমের স্বার্থসংশ্লিষ্ট চুক্তি তাদের সমর্থন ছাড়াই ঘোষণা করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের মধ্যকার চলে আসা দীর্ঘদিনের তিক্ততার অবসানে এই চুক্তি- ট্রাম্প এরকম দাবি করলেও বাস্তবিকপক্ষে এটা ফিলিস্তিনের থেকে নতুন করে ভূমি দখল করার অভিনব এক কৌশল। এই চুক্তির অন্যতম শর্ত হল, পবিত্র নগরী আল কুদস (জেরুজালেম)কে ইহুদিবাদী অবৈধ রাষ্ট্র ইসরায়েলের রাজধানী করা হবে। আর ফিলিস্তিনকে রাজধানী হিসেবে দেয়া হবে পূর্ব জেরুজালেমের সামান্য একটু অংশ। এবং পশ্চিমতীরে ইসরাইলি বসতিকে অনুমোদন দেয়া। যদিও অন্য বেশিরভাগ দেশ মনে করে এসব বসতি অবৈধ।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মুসলিম বিশ্বের নামি-দামি নেতাকর্মীদের বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কিভাবে এই চুক্তি ঘোষণা করলেন- এই প্রশ্নের উত্তরে সবার আগে বলতে হয়, পূর্ব থেকেই সৌদি সরকার যদি ট্রাম্পের ধারাবাহিক স্বেচ্ছাচারিতায় সমর্থন যুগিয়ে না আসতো, তেলবেচা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার তার হাতে না দিয়ে নিজেদের স্বতন্ত্র ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারতো, তাহলে ট্রাম্প কখনোই শান্তিচুক্তির নামে এই অশান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের দুঃসাহস দেখাতো না। আসলে স্বেচ্ছাচারিতায় ডুবে সৌদি প্রশাসন নিজ দেশকেও আরেক অশান্তি নগরী হিসেবে গড়ে তুলেছে; দেশের বুদ্ধিজীবী, আন্তর্জাতিক ইসলামি দাঈ ও সাহসী সাংবাদিকদের কারাবন্দী, গৃহবন্দী করে সৌদি আরবকে সুন্দর (!) একটি পরাধীন রাষ্ট্র হিসেবে উপস্থাপন করেছে। ফলশ্রুতিতে নিজেদের ক্ষমতা টিকেয়ে রাখতেই সৌদি সরকার মহানুভব (!) ট্রাম্পের দ্বারস্থ হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে তারা কিভাবে মুসলিম উম্মাহর স্বার্থ নিয়ে মাথা ঘামাতে পারে!
ডোনাল্ড ট্রাম্প রাতারাতি ডিল অব সেঞ্চুরি বিশ্বের সামনে প্রকাশ করেননি- এজন্য তাকে অনেক পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। মিসর ইয়ামেন সিরিয়া ইরাকসহ মুসলিম রাষ্ট্রগুলোতে হত্যাযজ্ঞ পরিচালনা করে হাজার হাজার জানবাজ দেশপ্রেমিক যুবক মুজাহিদদের শহীদ করার পরে ট্রাম্প আজকের জায়গায় উপনীত হওয়ার ঝুঁকি নিতে সমর্থ হয়েছেন। এমনও হয়েছে, যারা ট্রাম্পের হাত থেকে রেহাই পেয়ে অন্যত্র আশ্রয় খুঁজছিলেন, তাদেরকে ওই দেশের সরকারই মূর্তিমান ট্রাম্প সেজে তাদেরকে হত্যা করেছে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বলেছে, যাক! দেশদ্রোহীকে জাহান্নামে পাঠালাম!
ডোনাল ট্রাম্পরা নিমিষেই মুসলিমদের বিরুদ্ধে এরকম ভয়ংকররূপে আবির্ভূত হননি- এজন্য তারা মিডিয়াকে ব্যবহার করেছেন অত্যন্ত সুকৌশলে। প্রতিটি মুসলিম দেশের মিডিয়াতে তাদের এজেন্ট বসিয়েছেন, ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহকে নিয়ে ধারাবাহিক নেতিবাচক সংবাদ ছড়িয়ে দিয়ে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে মুসলিমদের প্রতি বিদ্বেষভাব মহামারী আকারে বিস্তার করেছেন। খবরের শিরোনামে মুসলিম শব্দ দেখলেই মন আঁতকে ওঠে-আবার কি নাশকতা করল কোন মুসলিম! উগ্রবাদীতার চূড়ান্ত সীমায় মুসলমানদের অবস্থানকে উন্নিত করে ছেড়েছে আমেরিকা, আর মুসলিমদের ওপর অমুসলিমদের এই আচরণ অনন্তকাল ধরে অব্যাহত রয়েছে। ফলশ্রুতিতে বিশ্ব ক্রীড়া মঞ্চে দখলদার মিত্রতে রূপান্তরিত হয়েছে, প্রতিষোধ হয়ে ওঠেছে শত্রুতা। অত্যাচার রূপ নিয়েছে ইনসাফে, প্রতিরোধকে বলা হচ্ছে সন্ত্রাসবাদ ও হিংস্রতা।
অনেক পরে হলেও মুসলিম উম্মাহর সম্বিৎ কিছুটা ফিরে এসেছে। বহিরাগত শত্রুকে আঁচ করতে পারছে তারা। কিন্তু অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও ক্ষমতালিপ্সুতা আজও তাদেরকে ছত্রভঙ্গ করে রেখেছে। বাইরের শত্রুর কি মুকাবিলা তারা করবে! যেখানে ভিতরের শত্রুর আক্রমণের তীর ফিরাতে ফিরাতে তারা আজ বড্ড ক্লান্তশ্রান্ত। তবে শেষ কথা, মুসলিম উম্মাহ বুঝতে পারছে যে, তারা আজ বিজাতীয়দের গভীর ষড়যন্ত্রের অতল গহ্বরে অবস্থান করছে।
মুসলমানদের অনুভূতি শক্তি জাগ্রত হচ্ছে। হিজরতের পর মদিনার আনসারি ও মক্কার মুহাজির সাহাবাদের মধ্যে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দ্বীনের ভিত্তিতে ভ্রাতৃত্বের যে বন্ধন জুড়ে দিয়েছিলেন সেটা যে আজ তাদের মাঝে অনুপস্থিত- এটা অনুভব করছেন তারা। তারা প্রয়োজন বোধ করছেন ' মু'মিন বান্দারা পরস্পর ভাইভাই' মহান আল্লাহ তায়ালার এই বাণী বাস্তবায়নের। যদি তাদের এই বিশ্বাস দৃঢ় হয়, তাহলে অচিরেই সমগ্র মুসলিম উম্মাহ ঐক্যবদ্ধ হয়ে পৃথিবীতে সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে পারবে।
-এটি