কাউসার লাবীব ।।
সন্তান বাবা মা’র জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে অপার এক নেয়ামত। [বনি ইসরাইল : ৭] কেননা এ সন্তান শিশুকালে মিষ্টি হাসি হেসে ভালবাসায় সিক্ত করে মা বাবার মন। যৌবনে সন্তানের ব্যক্তিত্ব মা বাবাকে অনন্য এক সম্মানে সমাসীন করে। আর তারা যখন বয়োবৃদ্ধ হন, তখন এ সন্তান বাবা মা’র জন্য হয় কাঠফাটা রোদ্দুরে একচিলতে শান্তির ছায়া।
আবার সন্তানের অপরাধ ও অন্যায় মা বাবাকে ভাসায় দুঃখের ফেনিল সাগরে। আর সন্তানের সুনিপুন জ্ঞানা সাধনা, মহানুভবতা কিংবা সৎকাজ সর্বত্যাগী মা বাবাকে পার্থিব এ জীবনেই এনে দেয় স্বর্গের সিঁড়ি। তাই তো দয়ালু আল্লাহ বলেন, সন্তান হলো মানুষের পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য। [সুরা কাহাফ : ৪৬]
তবে পার্থিব এ জীবনে স্বর্গসিঁড়ির দেখা ওইসব পিতামাতাই পান, যারা তাদের সন্তানকে দিতে পারেন সঠিক শিক্ষা। মূল্যাবোধের দীক্ষা।
পৃথিবীর আলোবাতাস এমন অনেক পিতামাতা ছুঁয়েছে, যারা তাদের সন্তানকে দিয়েছেন সঠিক জীবনশিক্ষা। দিয়েছেন অনুপম আদর্শের ঘ্রাণ। দিয়েছেন সৎব্যক্তিত্বের ইস্পাত কঠিন অনুপ্রেরণা।
তাদের ছোঁয়ায় সন্তান হয়ে উঠেছে সমাজের এমন রাহবার। যাদের একবাক্যে মানে সচেতন সমাজ। যাদের চিন্তাচেতনা মানুষকে দেখায় শান্তির পথ ।
তবে কিছু সৌভাগ্যবান পিতা ও রত্নগর্ভা মা আছেন, যাদের ভাগ্যটা খুবই প্রশস্ত। যাদের ‘জীবন বসন্ত’ ভরা সবুজের সমারোহ আর পুষ্পের মোলায়েম ঘ্রাণে। যাদের বাগানের দুটি বৃক্ষ একসঙ্গে সৃষ্টিজীবকে ছায়া দেয়। শীতল বাতাসে জুড়িয়ে দেয় ক্লান্ত পথিকের প্রাণ।
আজ আমরা বাংলাদেশের এমন কয়েকজন আলেম সহোদরের জীবনপাতা ছুঁয়ে আসবো, যাদের প্রতিটি কথা মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যায়। যারা নিজেদের সপে দিয়েছেন মানুষের ইমান, আমল, চিন্তা-চেতনা, রাগ-অনুরাগ বিনির্মাণে।
মাওলানা আবদুল মালেক ও মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মদ আবদুল্লাহ
বর্তমান বাংলাদেশের এ দুজন নক্ষত্র ঢাকার মিরপুরে মারকাযুদ দাওয়া নামে একটি উচ্চতর গবেষণা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন।
মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মদ আবদুল্লাহ গবেষণামূলক উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মারকাযুদ দাওয়া আল ইসলামিয়া ঢাকা’এর প্রিন্সিপালের দায়িত্বে আছেন। পাশাপাশি তিনি এ প্রতিষ্ঠানের মুখপত্র, মাসিক আল কাউসারের প্রধান সম্পাদক।
আর ছোট ভাই মুফতি আবদুল মালেক মারকাযুদ দাওয়া আল ইসলামিয়া ঢাকা’র আমিনুত তালিমের দায়িত্বে আছেন। পাশাপাশি তিনি মাসিক আল কাউসারের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
ঢাকার শান্তিনগরের আজরুন কারীম জামে মসজিদের খতিব তিনি। তিনি ২০১২ সালে সরকার গঠিত বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা শিক্ষা কমিশনের একজন সদস্য।
ইসলামের জন্য এই দুই ভাইয়ের খেদমত অসীম। যা বাংলাদেশসহ বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা হাজারও ধর্মপ্রাণ মানুষ তাদের দ্যুতির ব্যাপারে অবগত।
আল্লামা ফরিদ উদ্দিন মাসঊদ ও মাওলানা আরিফ উদ্দিন মারুফ
এ আলেম সহোদরের নাম দেশের গুরুত্বপূর্ণ নানা কাজের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে। বড় ভাই আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ বর্তমানে জামিয়া ইকরা বাংলাদেশ নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন।
ফিদায়ে মিল্লাত সায়্যিদ আসআদ মাদানির খলিফা আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগাহের ইমাম এবং ইকরা বাংলাদেশের চেয়ারম্যান।
এছাড়াও তিনি জমিয়তুল উলামা’র সভাপতি। একসময় সুনামের সঙ্গে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন। তার অনেক বই সমাদৃত হয়েছে বাংলাদেশসহ আরব বিশ্বে। ইসলামে শ্রমিকের মর্যাদা তার মধ্যে অন্যতম।
তার ছোট ভাই মাওলানা আরিফ উদ্দীন মারুফ জামিয়া ইকরা বাংলাদেশের প্রিন্সিপাল এবং শায়খুল হাদিস। তাফসির বিষয়ে যিনি অনন্য পারঙ্গমতা দেখিয়ে সুনাম অর্জন করেছেন। বিদেশের মাটিতে তাফসির বিষয়ক বেশ কিছু ইভেন্টে তিনি প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন।
মাওলানা আরিফ উদ্দীন মারুফ কাকরাইল সার্কিট হাউস মসজিদের খতিব। দীর্ঘ দিন ধরে এখানে দেশের শীর্ষ ব্যক্তিদের সামনে নামাজ ও বয়ানের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
এছাড়াও তিনি কিশোরগঞ্জ জামিয়াতুল ইসলাহ’র শায়খুল হাদিস।
এই দুই ভায়ের তত্ত্বাবধানে জামিয়া ইকরা থেকে প্রকাশ হয় ‘পাথেয়’ নামের একটি মাসিক পত্রিকা। এছাড়াও ইসলাহুল মুসলিমিন নামের একটি সংগঠন রয়েছে যা সাধারণ মানুষের নানা প্রয়োজন ও সঙ্কটে কাজ করে থাকে।
মুফতি মাহফুজুল হক ও মুফতি মামুনুল হক
আলেম এ সহোদর দেশের দীনি পুরোধা ব্যক্তিত্ব শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক রহ. এর ছেলে। এদের মধ্যে মুফতি মাহফুজুল হক বয়সে সিনিয়র। তিনি বর্তমানে জামিয়া জানিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া সাত মসজিদ মোহাম্মদপুরের প্রিন্সিপাল। বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব এবং বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের (বেফাক) যুগ্ম মহাসচিব।
তার ছোট ভাই মাওলানা মামুনুল হক জামিয়া রাহমানিয়া মোহাম্মদপুরসহ বেশ কয়েকটি মাদরাসার শায়খুল হাদিস। তিনি বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের যুগ্ম মহাসচিব এবং যুব মজলিসের চেয়ারম্যান।
মাওলানা মামুনুল হক শিক্ষকতা ও রাজনীতির পাশাপাশি একজন ওয়ায়েজ। সারা বাংলাদেশে যিনি দীনি এ খেদমত সুনামের সঙ্গে আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন। একজন আলোচিত মিডিয়া ব্যক্তিত্বও তিনি। টিভি টকশোতে যার উজ্জ্বল ভূমিকা দর্শককে মোহিত করে।
জামিয়া রাহমানিয়া থেকে এ দুই ভাইয়ের তত্ত্বাবধানে একটি মাসিক পত্রিকাও বের হয়। রাহমানী পয়গাম নামের পত্রিকাটি শাইখুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক রহ. এর হাতেই সূচনা। বর্তমানে মাওলানা মাহফুজুল হক এটির তত্ত্বাবধায়ক এবং মাওলানা মামুনুল হক এর সম্পাদকের দায়িত্বে রয়েছেন।
মাওলানা মামুনুল হক লেখালেখিও করেন। যার বেশ কয়েকটি বই ইতোমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে। রাজনীতি ইস্যুতে একবার জেলে যাওয়ার পর সেই জেল জীবনের কথা নিয়ে বই লেখেন। যা সমাদৃত হয় পাঠক মহলে।
মাওলানা মাহফুজুল হক দেশের উলামায়ে কেরামের মধ্যে নেতৃস্থানীয় জায়গায় রয়েছেন। বেফাকের শীর্ষ পদে থেকে তিনি কওমি মাদরাসা, আলেম উলামা ও ধর্মপ্রাণ মানুষের নানা সমস্যার সমাধানমূলক কাজ আঞ্জাম দিচ্ছেন।
মাওলানা মাহফুজুল হক ও মামুনুল হকের আরেকজন ভাই রয়েছেন তিনি মাওলানা মাহবুবুল হক। রশিদিয়া কুতুবখানা নামের একটি প্রকাশনা সংস্থার কর্ণধার তিনি।
মুফতি রেজাউল করীম ও মুফতি ফয়জুল করীম
চরমোনাইয়ের মরহুম পীর, আধ্যাত্মিক গুরু মাওলানা ফজলুল করীম রহ. এর সন্তান এ আলেম সহোদর।
মুফতি সৈয়দ রেজাউল করীম ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমিরের দায়িত্ব পালন করছেন। পাশাপাশি তিনি ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এর অঙ্গসংগঠনগুলোর তত্ত্বাবধায়ক।
তার ছোট ভাই মুফতি সৈয়দ ফয়জুল করীম ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নায়েবে আমির। তিনি চরমোনাই জামিয়া রশীদিয়া আহসানাবাদসহ বেশ কয়েকটি মাদরাসার শায়খুল হাদিস।
দেশে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ও চরমোনাই সিলসিলার লাখো অনুসারী রয়েছে। যাদের দীনি পথে পরিচালনা, ইসলামের অবদানে কাজে লাগানোসহ সঠিক পথের দীক্ষা দিয়ে থাকেন।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নায়েবে আমিরের পাশাপাশি মুফতি ফয়জুল করীম আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত পরিষদের সহ সভাপতি।
এই দুই ভাইয়ের তত্ত্বাবধানে হয়ে থাকে আরও বেশ কিছু দীনি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। কুরআন শিক্ষাবোর্ড পরিচালনা, সারাদেশে মাদরাসা নির্মাণ, হাসপাতাল ও শিল্প কারখানা তৈরিসহ রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ অনেক কাজ।
খ্যাতিমান এ দুই সহোদরের আরও দুজন ভাই রয়েছেন যারাও দেশে দীনি খেদমত আঞ্জাম দিচ্ছেন এবং ধর্মপ্রাণ মানুষের কাছে আলোচনায় রয়েছেন। একজন মাওলানা মুসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানী অপরজন মাওলানা আবুল খায়ের।
মাওলানা উবায়দুর রহমান খাঁন নদবী ও জাগ্রতকবি মুহিব খাঁন
প্রতিভাবান এ সহোদরের মধ্যে মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী বিশিষ্ট ইসলামিক স্কলার, লেখক, গবেষক, ইতিহাস, রাষ্ট্র ও সমাজতত্ত্ববিদ। প্রায় তিনযুগ ধরে তিনি সাংবাদিকতার পেশায় নিয়োজিত। বর্তমানে দৈনিক ইনকিলাবের সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন।
আর তার ছোট ভাই মুহিব খান বিশিষ্ট আলেম কবি ও লেখক। তিনি তার জাগ্রতকণ্ঠে যুবসমাজকে নিজেদের আত্মমোহ থেকে জাগিয়ে তুলতে সঙ্গীত গেয়ে থাকেন। বিগত তত্ত্বাবধায়ক আমলে তার গান ইঞ্চি ইঞ্চি মাটি জাতীয়ভাবে সমাদৃত হয়। এছাড়াও আনসার ভিডিপির থিম সং তারই লেখা।
মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী একজন খ্যাতিমান লেখক। নিরপেক্ষভাবে সবার সঙ্গে মিশে কাজের অনন্য যোগ্যতা রয়েছে তার। প্রায় অর্ধশত গ্রন্থ রচনা করেছেন তিনি। যা সমাদৃত হয়েছে বিভিন্ন মহলে।
তিনি অসংখ্য সংগঠনের উপদেষ্টা হিসেবে তরুণদের গাইডলাইন দিয়ে যাচ্ছেন। লেখালেখি ও সাংবাদিকতায় তার রয়েছেন উজ্জ্বল উদাহরণ। দেশ অধ্যয়ন কেন্দ্র নামে গড়ে তুলেছেন পাঠ প্রতিযোগিতার অনন্য সংগঠন।
কবি মুহিব খান সারাদেশে তরুণদের মধ্যে আলোচিত। তার ১ম কাব্যগ্রন্থ লাল সাগরের ঢেউ ব্যাপক আলোচিত হয়েছিল। এছাড়াও তিনি সম্পূর্ণ কুরআনের কাব্যানুবাদ করছেন যা বাংলাদেশে ইতোপূর্বে আর কেউ করেননি।
এ দুজনের আরেকজন ভাই রয়েছেন তিনি মাওলানা ওলিউর রহমান খান। যিনি ইসলামিক ফাউন্ডেশনের তাফসির বিভাগে কর্মরত রয়েছেন। এছাড়াও বায়তুল মোকাররমের সহকারী ইমামও তিনি।
মুফতি হাবিবুর রহমান মিছবাহ ও মাওলানা হাফিজুর রহমান সিদ্দীকী
এ আলেম সহোদর খ্যাতিমান ওয়ায়েজ এবং ইসলামি চিন্তাবিদ। রাজধানী ঢাকায় তাদের আলাদা আলাদা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে।
মাওলানা হাফিজুর রহমান সিদ্দিকী জামিয়া তা’লিমিয়া মাদরাসা নামে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন।
আর তার ভাই হাবিবুর রহমান মিছবাহ মারকাযুত তাকওয়া ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার নামে একটি উচ্চতর ইসলামি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন।
দুই ভাই-্ই সারা বছর দেশে ছয় শতাধিক মাহফিল করে থাকেন। যেসব মাহফিলে উপচে পড়া ভিড় সবসময় লক্ষণীয়ভাবে চোখে পড়ে।
মাওলানা হাফিজুর রহমান সিদ্দিকী মধ্যবাড্ডা লেকপাড় বাইতুল মামুর জামে মসজিদে খতিবের দায়িত্বও পালন করছেন। আর হাবিবুর রহমান মিছবাহ খতিবের দায়িত্বে রয়েছেন মিরপুর ১ নম্বর মুক্তবাংলা জামে মসজিদে।
মুফতি হাবিবুর রহমান মিছবাহ লেখালেখিও করেন। তার নববী আদর্শ বইটি পাঠক মহলে বেশ সমাদৃত হয়েছে।
আরএম/