আয়েশা আক্তার ।।
ছোটখাটো অসুখবিসুখ ও কাটাছেড়ার ক্ষেত্রে যে প্রাথমিক চিকিৎসা দরকার সেগুলো আমরা কমবেশি জানি। জ্বর এলে মাথায় পানি দেওয়া, পুড়ে গেলে পানিতে ভিজিয়ে ঠান্ডা করা ইত্যাদি। কিন্তু আমরা যে প্রাথমিক চিকিৎসাটি প্রয়োগ করি সেটা কি সঠিক? আমাদের মধ্যে প্রচলিত কিন্তু পদ্ধতিগতভাবে ভুল কিছু প্রাথমিক চিকিৎসার কথা আজ জানা যাক, সাথে সঠিক পদ্ধতিও।
১. ঠান্ডায় কাঁপুনি দিয়ে জ্বর বাড়লে কাপড় জড়িয়ে শরীর আরো উষ্ণ রাখা
জ্বরের সময় ছাড়াও মাঝে মাঝে এমন হয় যে, একদিকে ঠান্ডায় শরীর কাঁপছে আবার গরমে গা ঘামছে। এসময় শরীরের তাপমাত্রা দ্রুত উঠানামা করে। এ অবস্থায় বেশিরভাগ সময় আমরা ঠান্ডায় কাঁপুনি এড়াতে গায়ে কম্বল বা কাঁথা দিই যা একটি মারাত্মক ভুল।
আমাদের শরীর জীবাণু প্রতিহত করে জন্য এ সময় তাপমাত্রা বেড়ে যায়। কিন্তু শরীরের তাপমাত্রা ৩৮ ডিগ্রী সেলসিয়াস বা ১০০ ডিগ্রী ফারেনহাইট ছাড়ালে তা শরীরের জন্য হয়ে ওঠে মারাত্মক ক্ষতিকর। তাই ঠান্ডায় কাঁপুনি লাগার সাথে যদি দেহের তাপমাত্রা বেড়ে যায় তখন গায়ের জামা খুলে বাতাস চলাচলের অর্থাৎ শরীরের তাপমাত্রা কমানোর ব্যাবস্থা করতে হবে।
২. অজ্ঞান হওয়া ব্যক্তির মুখে শক্ত কিছু দেওয়া
মৃগী রোগীদের প্রধান সমস্যাই হলো হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যাওয়া। এসময় রোগীর দাঁতের নিচে অনেকসময় জিহ্বা চলে আসে জন্য অনেকে মনে করেন এতে রোগীর জিহ্বা কেটে যাওয়ার সম্ভবনা রয়েছে। এজন্য তারা ব্যক্তির অজ্ঞান হওয়ার সাথে সাথে দাঁতের নিচে শক্ত কিছু দেওয়ার চেষ্টা করেন। বরং এতে শক্ত কিছু কামড়াতে গিয়ে অজ্ঞান ব্যক্তির দাঁত ভাঙার সম্ভাবনা থাকে। তার চেয়ে অজ্ঞান হওয়ার পর যদি রোগীর মাথার নিচে বালিশ বা নরম কিছু দেওয়া যায় তাতে রোগী মাথায় আঘাত থেকে রক্ষা পায়।
৩. পোড়া জায়গায় সাথে সাথে মলম ব্যবহার করা
যখন ত্বকের কোনো স্থান পুড়ে তখন ঐ স্থানের অনেক গভীর পর্যন্ত কোষে তাপ ছড়িয়ে পড়ে। অত্যাধিক তাপে কোষগুলো ক্ষতিগ্রস্থ হয়, এজন্য বেশিক্ষণ পুড়লে ঐ স্থান ঝলসে যায়। এমতাবস্থায় যে স্থান পুড়েছে সেখানকার তাপমাত্রা কমিয়ে আনা হবে প্রথম কাজ। সেজন্যে পোড়া জায়গা কমপক্ষে ১৫ মিনিট ঠান্ডা পানিতে ডুবিয়ে রাখতে হবে। তারপরে পোড়ার ধরণ অনুযায়ী চিকিৎসা নিতে হবে। অল্প আঁচে পুড়লে ঠান্ডা পানিতে ভিজিয়ে ঠান্ডা করে তারপরে মলম লাগানো উচিত। ত্বক ঠান্ডা না করে কোনভাবেই মলম দেওয়া উচিত নয়।
৪. দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তিকে টেনে বের করা
সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তিকে দুর্ঘটনার স্থান থেকে সাথে সাথেই টেনে বের করা মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ নয়। আগে দেখতে হবে সে বেঁচে আছে কিনা আর রক্তপাত হচ্ছে কিনা। রক্তপাত যদি হয় তবে আক্রান্ত স্থান চেপে ধরে রক্তপাত থামাতে হবে। যদি না গাড়িতে আগুন লাগার সম্ভাবনা থাকে তবে যত দ্রুত সম্ভব এম্বুলেন্সে খবর দিতে হবে।
যদি সম্ভব হয় গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করে দিতে হবে। ইমারজেন্সি মেডিকেল টিম এসে সঠিক কৌশলে আহতকে বের করবে। নয়তো নিজেরা গাড়ি থেকে টেনে বের করতে গেলে আহত ব্যক্তির অবস্থা আরো খারাপ হতে পারে। এমনকি বের করার সময় নতুন কোথাও আঘাত পেতে পারে। আক্রান্ত ব্যক্তির জ্ঞান থাকলে তাকে যথাসম্ভব শান্ত রাখতে হবে।
৫. শ্বাসনালীতে খাবার আটকালে বুক-পিঠ চাপড়ে দেওয়া
প্রায়শই খাওয়ার সময় আমাদের শ্বাসনালীতে খাবার আঁটকে শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। এমন অবস্থায় আমরা বুক ও পিঠ চাপড়ানোকে সমাধান মন করলেও এটি মোটেও সমাধান হতে পারে না। বরং এতে খাবার শ্বাসনালীর আরো ভেতরে চলে যায়। এর পরিবর্তে আক্রান্ত ব্যক্তিকে একটু নিচু হয়ে ধীরে ধীরে শ্বাস নিতে সাহায্য করা যেতে পারে। এতে আঁটকে থাকা খাবার বেরিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক হতে পারে।
৬. যেকোনো কাটা ছেঁড়ায় ব্যান্ডেজ ব্যবহার
সাধারণত ধমনিতে রক্তপ্রবাহের চাপ বেশি আর শিরায় কম থাকে। যখন কোনো অঙ্গ কেটে ফোয়ারার মত রক্ত ঝরবে ফিনকি দিয়ে, বুঝতে হবে এখানে ধমনি কেটে গেছে। এমন অবস্থায় মোটা কাপড়ের বিশেষ ব্যান্ডেজ বেঁধে রক্তপাত বন্ধ করতে হবে। প্রয়োজনে কাটা জায়গার উপরে বেল্ট দিয়ে শক্ত করে বেঁধে রক্তপ্রবাহ বন্ধ করতে হবে।
আর টপ টপ করে রক্ত ঝরলে সেখানে চাপ দিয়ে রক্ত পড়া বন্ধ করে হালকা ব্যান্ডেজ দিলেই চলবে। এছাড়া বিষাক্ত প্রাণীর কামড়, চামড়া ছিলে যাওয়া, কেটে গর্ত হয়ে যাওয়া- এধরণের ক্ষতের ক্ষেত্রে ব্যান্ডেজ ব্যবহার করা উচিত নয়।
৭. ঠান্ডায় জমে যাওয়া হাত হঠাৎ গরম পানিতে দেওয়া
তুষার পরিষ্কার করতে গিয়ে বা বরফ নিয়ে কাজ করতে গিয়ে অনেকসময় হাত একদম জমে যায়। বেশি ঠান্ডায় রক্তপ্রবাহে বাধা পেয়ে হাত অবশ হয়ে আসে। এই সমস্যা কাটাতে অনেকে সরাসরি গরম পানিতে হাত ডোবান।
এতে হাতের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কেননা অতি দ্রুত তাপমাত্রার এমন পরিবর্তনে রক্তপ্রবাহে মারাত্মক সমস্যা হয়। আবার গরম পানিতে হাতের টিস্যু ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে। হাত ঠান্ডায় জমে যাওয়ার উপক্রম হলে প্রথমে ঠান্ডা পানিতে হাত ডুবিয়ে এরপর একটু করে অপেক্ষাকৃত গরম পানিতে হাত ডুবিয়ে হাতে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক করা যেতে পারে। সবচেয়ে ভাল হয় আগুনের আঁচের কাছে হাত নিয়ে গরম করা গেলে।
৮. নিজের সক্ষমতা না বুঝে আক্রান্ত ব্যক্তিকে সাহায্য করতে যাওয়া
অন্যের বিপদে এগিয়ে যাওয়ার মানসিকতা আছে বলেই মানুষ অন্যান্য প্রাণীর চেয়ে শ্রেষ্ঠ। তবে আক্রান্ত ব্যক্তির দিকে সাহায্যের হাত বাড়ানোর আগে যথাসম্ভব ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখতে হবে নিজে আদৌ সাহায্য করতে পারবেন কিনা। নয়তো অন্য কাউকে সাহায্যের জন্য ডাকা যেতে পারে।
ঘটনার আকস্মিকতায় আগ-পিছ না ভেবে সাহায্য করতে গিয়ে আক্রান্ত ব্যক্তির দলে নিজেকেও ফেলবেন না। এই যেমন ইলেকট্রিক শক পাওয়া একজনকে খালি হাতে বাঁচাতে গেলে আপনি নিজেও শক পাবেন। এক্ষেত্রে ঘটনাটি বুঝেশুনে যদি বিদ্যুৎ অপরিবাহী বস্তু যেমন- কাঠের কিছু দিয়ে শক পাওয়া মানুষটির সাহায্য করতে পারেন।
সূত্র : ইয়ুথ কার্নিভাল
আরএম/