মাওলানা শহীদুল ইসলাম ফারুকী।।
ভারত উপমহাদেশে হিজরি বার শতকে একজন মহান মুজাদ্দিদ, সংস্কারক ও দার্শনিক আবির্ভূত হন। যার তাজদিদি, ইজতিহাদি ও সংস্কারমূলক কাজের গর্জন শুধু দেশীয় পর্যায়ে নয়, বরং বিশ্ব পরিমন্ডলে শোনা যাচ্ছিলো। তাঁর ইজতিহাদি ও তাজদিদি কাজ ভবিষ্যতের জন্য একটি রাহনুমা ও মাইলফলক প্রমাণিত হয়।
এই মহান ব্যক্তি হলেন হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী রহ.। যাকে ভারত উপমহাদেশের সকল ইসলামী মত ও পথের লোকেরা নিজেদের ইমাম এবং দাওয়াত ও চিন্তাধারার সূতিকাগার মনে করেন। এজন্যই তাঁকে ‘মুসনাদুল হিন্দ’ বলা হয়। তিনি দিল্লির অদূরে ফুলাত নামক গ্রামে ১১১৪ হিজরীতে জন্ম গ্রহণ করেন এবং ১১৭২ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন।
সম্রাট আওরঙ্গজেব আলমগীরের ইন্তেকালের পর যখন উপমহাদেশের মুসলমানরা পতনের শেষপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিলো এবং সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে ক্ষয় ও পঁচন ধরেছিলো; যা যে কোনো সময় পতনের ইঙ্গিত বহন করছিলো। এমন কঠিন পরিস্থিতিতে এই মহান মুজাদ্দিদ ও সংস্কারক ভারত উপমহাদেশে ইসলামের পুনর্জাগরণের জন্য একটি কালজয়ী দর্শন পেশ করেন। তাঁর পেশ করা দর্শনের পথ ধরেই পরবর্তীতে ভারত উপমহাদেশে সকল ইসলামী রেনেসাঁ ও পনুর্জাগরণ আন্দোলন পরিচালিত হয়েছে।
সামগ্রিক ইসলামী পুনর্জাগরনের জন্য তাঁর দর্শন ছিলো– ‘যে চলমান সকল ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙ্গে দিয়ে প্রথম যুগের মতো শুধু ইসলাম ও কুরআনের ব্যবস্থা কায়েম করতে হবে।’ এ লক্ষ্যে তিনি বহু গ্রন্থ রচনা করেন। তম্মধ্যে তাঁর বিশ্বখ্যাত গ্রন্থ হলো– ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা’।
তাঁর এই কিতাব শরিয়াহ’র মাকাসিদ, রহস্য, ভেদ, হিকমাহ সম্পর্কে। তিনি শরিয়াহ’র বিধি-বিধানের যৌক্তিক বিশ্লেষণ পেশ করেন এবং শরিয়াহ’র রহস্য ও ভেদ উন্মোচন করেন; যা প্রচলিত ব্যবস্থা ভেঙ্গে তার জায়গায় কুরআন-সুন্নাহ’র ব্যবস্থা পুনস্থাপিত করার জন্য তীব্র প্রয়োজন ছিলো। সুতরাং তিনি ইসলামকে যৌক্তিক দর্শনের উপর দাঁড় করানোর জন্য অসংখ্য গ্রন্থ রচনা করেন। ইমাম শাহ ওয়ালীউল্লাহ তাদের কঠোর সমালোচনা করেছেন, যারা মনে করেন, শরিয়াহ’র বিধি-বিধান শুধু মানুষের পরীক্ষার জন্য নাযিল হয়েছে, এর নিজস্ব কোনো উদ্দেশ্য বা কল্যাণ নেই।
শাহ ওয়ালিউল্লাহ রহ. প্রথম ব্যক্তি যিনি মুসলিম উম্মাহর শত বছরের নিষ্ক্রিয়তার পর কুরআন, সুন্নাহ ও সীরাতের আলোকে চিন্তা ও ধর্মক; যা হয়ে পড়েছিলো ব্যক্তির একান্ত নিজস্ব বিষয়- সকল যুগের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সমস্যা সমাধানের মাধ্যম হিসেবে পেশ করেন। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিলো- কুরআন নাজিলের মূল উদ্দেশ্য হলো, দুনিয়ার রাজনীতি ও সামাজিক বিষয়গুলো একচেটিয়াভাবে বিত্তশালীদের করতলে না রেখে ইনসাফপূর্ণ শূরার মাধ্যমে পরিচালিত করা।
তিনি বলেন– ‘যে সমাজে আদল ও ইনসাফ এবং অর্থনৈতিক সমতা থাকে না সে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে পাপ ও পঙ্কিলতা প্রবেশ করে। সে সমাজ প্রাণশূন্য দেহে পরিণত হয়। কুরআন মানবতাকে জুলুম ও স্বৈরতন্ত্রের শৃংখল থেকে মুক্তি দিয়েছে। কুরআনী বিধানের উদ্দেশ্যই ছিলো মানুষকে সব জালিমের হাত থেকে মুক্ত করা। এজন্য তিনি প্রচলিত সব সিস্টেম ভেঙ্গে দিয়ে নতুন সমাজ গঠনের দর্শন পেশ করেন।
তিনি প্রচলিত সকল ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে উপলব্ধি করেন। এ লক্ষ্যে তিনি একটি বিস্তারিত কর্মপরিকল্পনা তৈরি করেন। সে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উপযুক্ত মানুষ তৈরির কাজও শুরু করেছিলেন। এর মধ্যে তিনি ইন্তেকাল করেন। তাঁর ইন্তেকালের পর তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন তাঁরই সুযোগ্য সন্তান শাহ আব্দুল আযীয মুহাদ্দিসে দেহলভী রহ.।
তিনি এ কাজকে একটি বাস্তবরূপ দিয়ে সামনে এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেন। তিনি পিতার স্থলাভিষিক্ত হয়ে দেখেন ইংরেজরা ভারত উপমহাদেশের উপর জগদ্দল পাথরের ন্যায় চেঁপে বসেছে। ফলে পিতার দর্শনকে এগিয়ে নেয়ার পাশাপাশি তিনি স্বদেশকে মুক্ত করার লক্ষ্যে ইংরেজদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা আন্দোলনের ডাক দেন এবং ভারতকে ‘দারুল হারব’ ঘোষণা দেন। তাঁর তত্ত্বাবধানে তাঁর ঘনিষ্ঠ শাগরিদ সাইয়েদ আহমাদ শহীদ রহ., ভাতিজা শাহ ইসমাইল শহীদ রহ. ও মাওলানা আব্দুল হাই রহ. জিহাদের সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু করেন।
শাহ আব্দুল আযীয রহ. ইন্তেকাল করলে এ দায়িত্ব ন্যস্ত হয় তাঁরই সুযোগ্য শাগরিদ আমীরুল মুজাহিদীন সাইয়েদ শহীদ ও ভাতিজা শাহ ইসমাইল শহীদ রহ. এর উপর। তাঁরা শাহ ওয়ালীউল্লাহ ও শাহ আব্দুল আযীয রহ. এর দর্শন- ‘স্বাধীনতা সংগ্রাম ও চলমান সিস্টেম ভেঙ্গে নতুন সমাজ গঠন’– এ দুটি লক্ষ্য সামনে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। এ কাজের জন্য তাঁরা কর্মীবাহিনীও প্রস্তুত করছিলেন। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, ১৮৩১ সালে তাঁদের এ স্বাধীনতা সংগ্রাম নিজেদের গাদ্দারির পরিণামে বালাকোটের ময়দানে মুখ থুবড়ে পড়ে। তাঁরা শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করেন।
তাঁদের ইন্তেকালের পর শাহ আব্দুল আযীয রহ. এর নাতি শাহ ইসহাক রহ. এ আন্দোলনের নেতৃত্বভার গ্রহণ করেন। তিনি এ মিশনকে নতুন করে ঢেলে সাজান। এ সংকটপূর্ণ সময়ে হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী রহ., তাঁর দুই শাগরিদ হযরত গাঙ্গুহী রহ. ও হযরত নানুতবী রহ. এ আন্দোলনকে গতিশীল রাখার পিছনে অশেষ অবদান রাখেন। তাঁরা শামেলীর ময়দানের ইংরেজদের বিরুদ্ধে স্বশস্ত্র যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। কিন্ত এখানেও গাদ্দারীর কারণে তাঁরা ব্যর্থ হন।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এই দুই মহান বুযুর্গ স্বাধীনতাকামী মুসলিমদের মাঝে ইসলামী চিন্তা-চেতনা, শিক্ষা ও তারবিয়াহ বহাল রাখা এবং ওয়ালীউল্লাহ দর্শন– ‘প্রচলিত সব ব্যবস্থা ভেঙ্গে ফেলে কুরআন-সুন্নাহ’র ব্যবস্থা কায়েম করা’র লক্ষ্যে ১৮৬৬ সালে দারুল উলূম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠা করেন। দেওবন্দ আন্দোলনের মাধ্যমে তাঁরা ওয়ালীউল্লাহী দর্শনকে সামনে অগ্রসর করেন।
পরবর্তীতে এ কাজের দায়িত্বভার অর্পিত হয় হযরত নানুতবী ও হযরত গাঙ্গুহী রহ. এর হাতে গড়া শাগরিদ শাইখুল হিন্দ হযরত মাওলানা মাহমুদুল হাসান দেওবন্দী রহ. এর উপর। তিনি শাহ ওয়ালী উল্লাহ ও শাহ আব্দুল আযীয রহ. এর ইসলামী পুনর্জাগরণ দর্শন তথা প্রচলিত সব ব্যবস্থা ভেঙ্গে ফেলা এবং স্বাধীনতা সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিশ্বজোড়া স্বাধীনতা আন্দোলনের ডাক দেন। কিন্তু এখানেও নিজেদের গাদ্দারির কারণে তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। হযরত শায়খুল হিন্দ রহ. তাঁর শিষ্যসহ মাল্টা দ্বীপে বন্দি হয়ে যান। মাল্টা থেকে মুক্তি পাওয়ার পর অল্প সময়ের মধ্যে পরিবর্তিত অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে নতুন কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করেন।
যাতে মৌলিক তিনটি কর্মসূচি ছিলো— ‘১. দেশের অমুসলিমদেরকেও আযাদী আন্দোলনে শরীক করা, ২. আধুনিক শিক্ষিতদেরকে মহব্বতের সাথে কাছে টেনে নিয়ে নতুন যুগে তাদেরকে নিজেদের প্রতিনিধি বানানো এবং ৩. প্রচলিত সব ব্যবস্থা ভেঙ্গে ফেলে সামাজিক সমস্যার ক্ষেত্রে কুরআন সুন্নাহর আলোকে মানুষকে সমাধান দেয়া’– এ তিন দফার আলোকে তাঁর অনুসারীরা অমুসলিমদেরকে সাথে নিয়ে ব্যাপক জনমত গড়ে তুলে আযাদী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
অবশেষে ১৯৪৭ সালে এ আন্দোলন উপমহাদেশ স্বাধীন করার মাধ্যমে পূর্ণতা লাভ করে। উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা জানতে পারি যে, ইসলামের পুনর্জাগণের জন্য আমাদেরকে সর্বাগ্রে প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনতে হবে; যা ছিলো ইমাম শাহ ওয়ালী উল্লাহ রহ. এর দর্শন। পাশাপাশি সময়ের তাগূতী ও কুফরি শক্তিকেও মোকাবেলা করতে হবে।
সুতরাং শাহ ওয়ালী উল্লাহ রহ. এর দর্শন– ‘প্রচলিত সব সিস্টেম ভেঙ্গে ফেলে কুরআন-সুন্নাহর আলোকে নতুন সমাজ গঠনের’ কর্মসূচিই হলো– বর্তমান সময়ে ইসলামের পুনর্জাগণের সবচেয়ে কার্যকর কর্মসুচি। যে কর্মসুচি প্রণীত হবে– দাওয়াত, তা’লীম, তাযকিয়া, খেদমত, সাহিত্য ও বুদ্ধিবৃত্তির সমন্বয়ে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিংশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ ও মুফাক্কিরে ইসলামী সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী রহ. ছিলেন এ কর্মসূচির সফল রূপকার। তাঁর রচনাবলী আমাদেরকে এ পথের দিশা দিতে পারে।
লেখক : পরিচালক, শায়খ আবুল হাসান আলী নদভী ইসলামিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট ও আমীর, পয়ামে ইনসানিয়াত বাংলাদেশ।
আরএম