কাউসার লাবীব: তাবলিগ জামাত। ১৯২০এর দশকে হযরতজি ইলিয়াস রহ. এর হাত ধরে এ জামাতের পথচলা। সে থেকে আজ অব্দি এক শতাব্দী ধরে ইসলামের মৌলিক মূল্যবোধ প্রচার ও মানুষের মাঝে ইসলামের সৌন্দর্য ছড়িয়ে দেওয়ার কাজে নিবেদিত এ জামাতের অনুসারী, অনুগামী ও শুভাকাঙ্ক্ষীগণ।
স্বেচ্ছাসেবামূলক ইসলামের দাওয়াতের এ কাজ ও মিশন মন কেড়েছে উত্তর থেকে দক্ষিণ মেরুর অনেক জ্ঞানী বা গবেষক। তাবলিগের মেহনত শুরু হওয়ার পর থেকেই উপমহাদেশের আলেম ওলামাগণ অভিনব এ পদ্ধতিকে স্বাগত জানান।
হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভী রহ. তাবলিগ জামাত ও হযরতজি ইলিয়াস রহ.কে নিয়ে নিজের মত প্রকাশ করতে গিয়ে উচ্ছসিত কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘দলিলের প্রয়োজন নেই। দলিল-প্রমাণ তো কোনো কিছুর যাচাই-বাছাই ও সত্যতা প্রমাণের জন্য পেশ করা হয়। আমিতো বাস্তব ময়দানের আমল থেকেই এ মেহনতের ওপর পূর্ণ আশ্বস্ত।
এখন আর কোনো দলিলের প্রয়োজন নেই। হে ইলিয়াস! মাশাআল্লাহ! তুমি তো আমার নিরাশাকে আশায় পরিণত করেছ। বদলে দিয়েছ আমার হতাশা।’
আর চেতনার বাতিঘর মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভী তো তার নিপুন হাতের ছোঁয়ায় গ্রন্থ রচনা করেন ‘হযরত মাওলানা মুহাম্মদ ইলিয়াস আওর উনকি দীনি দাওয়াত’। যেখানে তিনি তাবলিগের অকৃত্রিম মেহনত, অরূদ্ধ চেতনা ও মানুষকে কাছে টেনে নেওয়ার ছন্দিত শক্তির কথা তুলে ধরেন।
তাবলিগের অক্লন্ত মেহনতে বিমোহিত হয়ে উপমহাদেশের সীমানা পেড়িয়ে আরব মুলকের মুহাক্কিক আলেম ও প্রথিতযশা ব্যক্তিগণও নিজেদের কথামালায় বইয়েছেন প্রশংসার ফল্গুধারা।
আরব আজমের খ্যাতিমান আলেম, রাবেতা আলমে ইসলামির কিসমুল জালিয়াত‘র প্রধান সমন্বয়ক শায়খ মুহাম্মদ ইবরাহিম আবেগঘন কণ্ঠে তাবলিগে তার কাটানো দিনগুলির বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, আমি ইমান-ইয়াকিনের এ দাওয়াতের বিভিন্ন ইজতেমা দেখেছি। কাছে থেকে তাদের কার্যক্রম নিরীক্ষা করেছি। অনুধাবন করেছি তাদের কার্যসরলতা। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ইলমের নুর এবং ইমানের আলো এখান থেকেই অর্জিত হয়।
আমি পবিত্র কালামুল্লাহ এর আগে শত শত বার পড়েছি। তাফসির অধ্যয়ন করেছি। কিন্তু দাওয়াতের এ ময়দানে আমি কুরআনের এমন অসংখ্য আয়াতের অর্থ বুঝেছি, যা এর পূর্বে অনুধাবন করতে পারিনি। ইমান-আকিদা ও আল্লাহর মুহাব্বত-প্রেম উদ্বুদ্ধকরণে এর চাইতে কার্যকরী কোনো দাওয়াত আমি দেখিনি। আল্লাহর কসম, সত্যের প্রতি এ আমার সরল অভিব্যক্তি।’
হযরতজি ইলিয়াস রহ. এর নিরলস পরিশ্রমের ফসল তাবলিগ।ইসলামি দাওয়াতের অনিন্দ ও বহুল বিস্তৃত এ জামাত সাধারণ মানুষকে ঈমান বানানো, আমল করা ও আখিরাতের জন্যে উদ্বুদ্ধ করার কথা বলে সর্বনিম্ন তিন দিনের জন্য উদ্বুদ্ধ করেন। এর পর যথাক্রমে সাতদিন, দশদিন, বিশদিন, চল্লিশদিন (এক চিল্লা), ১২০দিন (তিন চিল্লা)-এর জন্য আল্লাহর রাস্তায় দাওয়াতের কাজে মানুষকে সম্পৃক্ত করেন।
তাবলিগের এ মেহনতে আলেমদেরকে সর্বোচ্চ সমর্থণ জানিয়ে সম্পৃক্ত হওয়ার আহ্বান করে সৌদি আরবের গ্র্যান্ড মুফতি, বিদগ্ধ ইসলামি চিন্তাবিদ ও সংস্কারক আলেম শায়খ আবদুল আজিজ বিন আবদুল্লাহ বিন বায রহ. বলেন, ‘এ জামাতের মধ্যে অনেক উত্তম কাজ রয়েছে। তাদের কর্মকাণ্ডে রয়েছে প্রচণ্ড উদ্যম-উদ্দীপনা। তাদের ধৈর্য-সবরও অতুলনীয়।
তারা তাদের দাওয়াত ও মজলিসগুলোতে নামাজ, যিকির, ইলম অর্জন এবং এ পথে বের হওয়ার কথা বলে। যারফলে নামাযে অমনোযোগী মুসলমানদের অনেক উপকার হয়, তারা সৎপথে ফিরে আসে। ইসলামের সহিহ আকিদা-বিশ্বাসে সমৃদ্ধ আলেমরা এ পথে এগিয়ে এসে তাদেরকে ইলম শিক্ষা ও হেদায়াতের পথে আনতে চেষ্টা করতে পারেন।’
সৌদি সরকারের দাওয়া, ইরশাদ ইফতা ও ইসলামি গবেষণা বিভাগের বিশেষ প্রতিনিধি শায়খ সালেহ বিন আলী সুয়াইমান তাবলিগের সাথীদের সৌহার্দ, সম্প্রীতি, প্রণয় ও মহব্বতের কথা নিজের ভালবাসার শব্দে উচ্চারিত করতে গিয়ে বলেন, ‘এটি এমন একটি মুবারক জামাত, যারা দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের বাসিন্দা হলেও সকলের একই সুরত, একই স্বভাব, একই কথা আর একটিই লক্ষ্য।
যেন তারা সকলেই একই বাবার অনেক সন্তান। অথবা বলা যায়, আল্লাহ তাআলা একটি হৃদয় সৃষ্টি করেছেন আর তা তাদের সকলের মাঝে বণ্টন করে দিয়েছেন।
তাদের সকলের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য একটিই, দীনকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরা, মুসলমানদের সংশোধন করা আর অমুসলিমদের আল্লাহর রাস্তা বাতলে দেওয়া। এমন মানুষগুলোকে নিয়ে শায়েখ আব্দুল মাজিদ যিনদানী কতই না সুন্দর বলেছেন, তাঁরা তো আসমানের মাখলুক, যারা যমিনে বিচরণ করছে।’
তাবলিগ জামাত যে অনন্য কিছু বিষয় নিয়ে মানুষের মাঝে দীনের আলো বিলিয়ে দেয় এর মধ্যে অন্যতম ছয় সিফত। যার মধ্যে রয়েছে, ‘ কালিমা, নামায, এলম ও জিকির, একরামুল মুসলিমিন বা মুসলমানদের যেমন মর্যাদা তেমন কদর করা, সহিহ নিয়ত বা মনোবাঞ্ছাকে পরিশুদ্ধ করা এবং দাওয়াত ও তাবলিগ বা ইসলামের দাওয়াত।
তাবলিগের সাথীদের বিশ্বাস, যদি কেউ এ ছয় সিফতকে নিজের জীবনে নিয়ে আসতে পারে। তাহলে তার জন্য পুরো দীনের ওপর চলা সহজ হয়ে যাবে।
তাদের এ কথার মূল্যায়ন করতে গিয়ে আরবের বিদগ্ধ আলেম, ইসলামি স্কলার শায়খ মুহাম্মদ বিন সালেহ উসাইমিন রহ. বলেন, আমার মতে, এ জামাতে অনেক উত্তম আমল রয়েছে। এই দাওয়াতের প্রভাবও খুবই সুদূরপ্রসারী। এর চাইতে দ্রুত ও বেশি প্রভাব সৃষ্টিকারী কোনো জামাত নেই।
কত কাফের তাদের দাওয়াতের ফলে ইমান এনেছে! কত গুনাহগার এর দ্বারা মুত্তাকি ও মুমিন বান্দায় পরিণত হয়েছে। এতো সকলের সামনে সুস্পষ্ট। আর ছয়টি গুণ যার কথা তাবলিগ জামাতের ভাইয়েরা বলে থাকে। নিঃসন্দেহে তা সুন্দর ও উত্তম গুণাবলি। তবে এ জামাতে ইলমের চর্চা আরো বাড়ানো উচিত বলে আমি মনে করি।’
মিসরের আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের তাফসির ও শরিয়া ফ্যাকালিটির অধ্যাপক ড. শায়খ মুহাম্মদ বকর ইসমাইল দাওয়াত ও তাবলিগ সম্পর্কে মত প্রকাশ করতে গিয়ে বলেন, ‘এ জামাতটি তাবলিগ জামাত নামে প্রসিদ্ধ। বাস্তব অর্থে নামের সঙ্গে তাদের কাজের যথার্থ মিল রয়েছে।
এ জামাতটিকে আমি কাছ থেকে দেখেছি। তাদের সঙ্গে জামাতেও বের হয়েছি। তাদের মধ্যে আমি এমন কোন কিছুই খুঁজে পাইনি, যা কুরআন ও সুন্নাহর সঙ্গে সাংঘর্ষিক। বরং আমি তাদের কাছ থেকে এমন অনেক কিছু শিখেছি, পেয়েছি, যা অন্য কোথাও পাইনি।’
মুহাক্কিক এ আলেমদের অভিমত শোনার পর কানে যেনো ভেসে আসে মহান প্রভুর সে বাণী, ‘তার চেয়ে ভাল কথা আর কি হতে পারে, যে মানুযকে আল্লাহর দিকে ডাকে, নিজে নেক আমল করে আর বলে যে, আমি সাধারণ মুসলমানদের মধ্য থেকে একজন।’ [সূরা হা মীম সিজদা আয়াত-৩৩]
সুতরাং ধর্মপ্রাণ সব মানুষ, আলেম উলামাদের উচিত এ কাজকে জোরকদমে এগিয়ে নেয়া। এতে যে চলমান বিবেধ সৃষ্টি হয়েছে তাকে দ্রুত নিরসন করে আগের গতিতে এগিয়ে দেয়া। আল্লাহ আমাদের সবাইকে তৌফিক দিন।
আরএম/