মুহাম্মদ ছফিউল্লাহ হাশেমী ।।
পেঁয়াজের বাজারে চলছে অস্থিরতা। একশ্রেণির ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট নিজেদের মতো করে নিত্যপ্রয়োজনীয় এই পণ্যটির মূল্য দিনে দিনে বাড়িয়েই চলেছে। সরকারের নানামুখী নজরদারি কিংবা কঠোর হুঁশিয়ারি—কোনও প্রচেষ্টাই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না এর মূল্য। বরং প্রতিদিন বাজারে বাড়ছে পেঁয়াজের মূল্য। উঠতে উঠতে এক কেজি দেশি পেঁয়াজ শুক্রবার বিক্রি হয়েছে ২৮০ টাকা দরে। কারও কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। কারও কোনও নির্দেশনাও মানছেন না ব্যবসায়ীরা।
ইসলাম ব্যবসায়-বাণিজ্যকে উৎসাহিত করেছে। কিন্তু খাদ্য সামগ্রী ও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি আটকে রেখে কৃত্রিম সংকট তৈরির মাধ্যমে অধিক মুনাফা অর্জনের মানসিকতাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। দুনিয়া ও আখিরাতে মজুদদারির ভয়াবহ শাস্তির কথা পবিত্র কুরআন মাজিদে বর্ণনা করা হয়েছে।
মজুদদারী সম্পর্কে মহান আল্লাহ রাব্বুল বলেন, “যারা সোনা-রূপা (ধন-সম্পদ) জমা করে এবং আল্লাহর রাস্তায় খরচ করে না তাদের জন্য আপনি যন্ত্রণাদায়ক আযাবের সংবাদ দিন। সে দিন এসব ধন-সম্পদ আগুনে গরম করা হবে। অত:পর তা দিয়ে তাদের কপাল, পাঁজর আর পিঠে দাগ দেয়া হবে। (বলা হবে), তোমরা যা কিছু নিজেদের জন্য জমা করে রেখেছিলে এগুলো তো সেসব ধন-সম্পদ। সুতরাং তোমরা যা কিছু জমা করে রেখেছিলে, এখন তার স্বাদ আস্বাদন করো।" ( সুরা আত-তাওবাহ, আয়াত নং-৩৪-৩৫)।
ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগতভাবে অতি মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রী মজুদ করে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষকে কষ্ট দেয়া ইসলামের দৃষ্টিতে জঘন্য অপরাধ।
মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পণ্য মজুদ করাকে কঠোরভাবে নিষেধ করেন। তিনি বলেছেন, "যে লোক চল্লিশ দিন খাদ্য শস্য মজুদ করে রাখলো, সে আল্লাহ থেকে নি:সম্পর্ক হয়ে গেলো এবং আল্লাহও নি:সম্পর্ক হয়ে গেলেন তার থেকে।" (মুসনাদে আহমাদ)।
অধিক মুনাফা অর্জনের জন্য পণ্যদ্রব্য মজুদ করা থেকে বিরত থাকতে মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নির্দেশ দিয়েছেন। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, "অধিক মূল্যে বিক্রয় করার উদ্দেশ্যে খাদ্যদ্রব্য আটক করে রাখতে নবি কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিষেধ করেছেন।"
যে ব্যক্তি খাদ্যদ্রব্য মজুদ করে রাখে সে চরম অপরাধী। এ প্রসঙ্গে মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, "অপরাধী ব্যক্তি ছাড়া কেউ পণ্য মজুদ করে রাখে না”। (সহিহ মুসলিম)।
ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত উমর রা. ব্যবসায়ীদের পণ্য মজুদকরণ সম্পর্কে ঘোষণা করেছিলেন, "আমাদের বাজারে কেউ যেন পণ্য মজুদ করে না রাখে। যাদের হাতে অতিরিক্ত অর্থ আছে তারা যেন বহিরাগত ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সমস্ত খাদ্যশস্য কিনে তা মজুদ করে না রাখে। যে ব্যক্তি শীত-গ্রীষ্মের কষ্ট সহ্য করে আমাদের দেশে খাদ্যশস্য নিয়ে আসে সে উমরের মেহমান। অতএব সে তার আমদানীর খাদ্যশস্য যে পরিমাণে ইচ্ছা বিক্রি করতে পারবে, আর যে পরিমাণে ইচ্ছা রেখে দিতে পারবে।" (মুয়াত্তা ইমাম মালিক)।
তৃতীয় খলিফা হজরত উসমান রা. ও তাঁর খিলাফত কালে পণ্য মজুদ নিষিদ্ধ করেছিলেন। চতুর্থ খলিফা হজরত আলী রা. মজুদদারির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন। তিনি তাঁর খিলাফাতকালে মজুদকৃত খাদ্যদ্রব্য আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন।
যেহেতু মজুদদারি জনসাধারণের স্বার্থের পরিপন্থী তাই ইসলামে তা নিষিদ্ধ। বর্তমানে পেঁয়াজের দাম যেভাবে লাগামহীনভাবে বেড়ে চলেছে বাজারের এ নিয়ন্ত্রণহীন আচরণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের সীমিত আয়ের গরিব মানুষ।
পেঁয়াজের পাগলা ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরতে শুধু অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট ভাঙলেই চলবে না, প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য দেশে উৎপাদনেরও ব্যবস্থা করতে হবে। সেইসঙ্গে বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে মধ্যস্বত্বভোগীদের চিরতরে বিতাড়িত করতে হবে। তবেই পেঁয়াজসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য জনগণের নাগালের মধ্যে আনা সম্ভব। জনমনে স্বস্তি প্রতিষ্ঠার জন্য পেঁয়াজের মূল্য সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনার কোনো বিকল্প নেই। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদেরকে সেই তাওফিক দান করুন। আমিন!
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলেজ শিক্ষক
আরএম/