জুনাইদ জামশেদ। উপমহাদেশের অত্যন্ত পরিচিত একটি নাম। তাকে চিনে না, উপমহাদেশে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। ‘দিল দিল পাকিস্তান’ থেকে ‘মেরা দিল বদল দে’ পর্যন্ত বহু জনপ্রিয় সঙ্গীতের স্রষ্টা তিনি। তিনি জীবনের শুরুটায় ছিলেন পপস্টার। পরে হয়েছেন ইসলামি সংগীত শিল্পী ও দীনের দায়ী । দুই জায়গাতেই ছিলেন আকাশ স্পর্শী জনপ্রিয়। সেই সাথে তিনি ছিলেন একজন ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তা। একদম শূন্য থেকে শুরু করে সফল বিজনেসম্যান হওয়ার গল্প তার নিজের মুখে শোনা যাক। তার বয়ান অবলম্বনে জীবন কথাটি লিখেছেন ওমর আলফারুক
‘আমি মিউজিক ছেড়ে দিয়েছিলাম৷ ভাবছিলাম কী করব! এক পর্যায়ে আমার অবস্থা এমন হলো যে আমি একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেলাম৷ আমি আমার সর্বশেষ ১০০ রুপি আমার স্ত্রীকে দিয়ে বললাম৷ আমার কাছে এই ১০০ রুপি ছাড়া আর কিছুই নাই৷ আগামী কাল থেকে কী হবে একমাত্র আল্লাহ তাআলা জানেন!
কিন্তু আমি মাওলানা তারিক জামিল সাহেবের কাছে একটি হাদিস শুনেছিলাম, ‘আপনি যদি আল্লাহর জন্য কিছু কুরবানি করেন, আল্লাহ তায়ালা আপনাকে অবশ্যই তার চেয়ে উত্তম কিছু দান করবেন৷
কিন্তু তবু আমি নিজের ভেতরে শান্তি পাচ্ছিলাম না৷ আমি নফসের ধোকার শিকার হয়ে যাচ্ছিলাম৷ মনে মনে বলতে লাগলাম, হায় সবকিছু ছেড়ে-ছুড়ে এ আমি কী করলাম! আমি পথের ফকির হতে চলেছি!
তবু হৃদয়ের কোথায় থেকে যেন একটা অপার্থিব আওয়াজের গুঞ্জন আসছিল, ‘আল্লাহর রাসুলের কথা মিথ্যা হতে পারে না,আল্লাহর রাসুলের কথা মিথ্যা হতে পারে না’ আমি আল্লাহর উপরই ভরসা করে থাকতে লাগলাম৷
২০০২ সাল৷ আমি মসজিদে বসা৷ আমার এক বন্ধু এসে বলল- কী করছো আজকাল?-কিছুই না৷ ভাবছি কী করা যায়?
:চলো আমরা দুজনে মিলে কিছু করি!
-কী করতে চাও? আইডিয়া কী?
: তুমি বলো কী করা যায়?
- কিছুক্ষণ ভেবে আমি বললাম চলো কাপড় ব্যবসা শুরু করি!
: দেখো জামশেদ ভাই, তুমি দিবে পঁচিশ লাখ, আমি দিব পঁচিশ লাখ। প্রাথমিকভাবে আমরা পঞ্চাশ লাখ দিয়ে শুরু করি।
-আচ্ছা দেখি!
অথচ আমার কাছে তখন কিছুই নেই। গতকালই আমার স্ত্রীকে সর্বশেষ একশ টাকা দিয়ে এসেছি, আক্ষরিক অর্থেই আমি যাকে বলে একেবারে রিক্তহস্ত। তবু তাকে বললাম, !
এরপর তাকে কথা দিয়ে এসে পড়লাম মহামসিবতে কোত্থাও এমন কাউকে পাচ্ছিলাম না যে আমার সাহায্যে এগিয়ে আসবে। তখন আমি বুঝতে পারলাম, বন্ধুু কাকে বলে।
শেষমেশ আমার সবকিছু বিক্রি করে পঁচিশ লাখ জোগাড় করলাম। তারপর আমরা পঞ্চাশ লাখ টাকার কাপড় কিনে ফেললাম। এরপর আমরা কাপড়ের প্যাটার্ন বানাতে শুরু করলাম। ঠিক তখনই আমরা এক ভয়াবহ বিপদে পড়ি।
কাপড়ের প্যাটার্ন দুর্ভাগ্যবশত ছোট হয়ে যায়। আমি তখন দুচোখে অন্ধকার দেখছিলাম। আর মনে মনে বলতে লাগলাম, হায় আল্লাহ! এ আমি কোন পাপের সাজা পাচ্ছি!
তখন আমাদের উভয়ের অবস্থা একই ছিলো, দুজনেই ভাবছিলাম, এখন কী হবে? কিন্তু আমাদের জানা ছিলো কিছুই হবার নেই এখন আর। প্রয়োজনের চেয়ে ছোট প্যাটার্নের কাপড় ফ্রিতে দিলেও কেউ কিনবে না।
তখন আমরা সরাসরি আল্লাহর সাহায্য দেখতে পেলাম। এক বাংলাদেশি পার্টি দেখা করতে এলেন, তার কিছু কাপড় লাগবে। কিন্তু কাপড়ের প্যাটার্ন ছোট হতে হবে। তখন আমি বললাম ছোট প্যাপার্নের কস্ট কিন্তু বেশি আসবে। তারা এক্সট্রা কস্ট দিতেও তৈরি।
বলতে গেলে নষ্ট কাপড়গুলোই আমরা তখন তুলনামূলক বেশি দামে মাত্র দুই দিনের মধ্যে বিক্রি করে ফেললাম। রিজিক যে আসলে আল্লাহ তাআলার হাতে তখন তা যেন আমি দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট দেখতে পেলাম।
তখন আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কি আমার সাথে আরও কাজ করতে চাও? না এই পর্যন্তই?
- আরও কাজ করতে চাই।
: তাহলে মুফতি তাকি উসমানি সাহেবের কাছে চলো, তার পরামর্শ মোতাবেক আমরা আমাদের কাজ নিয়ে সামনে আগাবো।
তাকি উসমানি সাহেব আমাদের তিনটি কথা বললেন,
এক, আগে ঠিক করো, এই কাজ শেষ হবে কীভাবে।
দুই, প্রতিজ্ঞা করো, তোমরা একে অপরকে ধোকা দিবে না।
তিন, সবচেয়ে বড় কথা, প্রতিজ্ঞা করো এই ব্যবসার মাধ্যমে তোমরা মানুষের উপকারের কথা ভাববে সবার আগে।
তিনি বললেন, তোমরা যদি এই তিনটি কথা ঠিক মত পালন করো, তাহলে তোমাদের তৃতীয় পার্টনার হবেন আল্লাহ তায়ালা।
তখন আমরা প্রথমে আমাদের লক্ষ্য ঠিক করলাম। এরপর কুরআন মাজিদে হাত রেখে একে অপরকে ধোকা না- দেয়ার শপথ করলাম। এরপর ভাবতে লাগলাম, কীভাবে মানুষের উপকার করা যায়।
এরপর আমরা সূতি কাপড় বানানো শুরু করলাম। এতে করে মৃতপ্রায় তাঁত শিল্প পুনর্জীবন লাভ করল। এবং প্রায় দশ হাজার মানুষের কর্ম সংস্থান হলো।আমাদের কাপড়গুলো একবার আপনি পরলে আপনার দ্বারা আর অন্য কাপড় পরা সম্ভব হবে না। এমন অসম্ভব রকমের সফট এবং কমফোর্টেবল এই কাপড়গুলো।
আমরা চাইলে এই কাপড়ের যত ইচ্ছা মূল্য নির্ধারণ করতে পারতাম। কিন্তু আমরা তা করিনি। আমরা তুলনামূলক কম মূল্যে অপেক্ষাকৃত ভালো প্রডাক্ট আনতে শুরু করলাম। এবং মানুষও তা গ্রহণ করতে শুরু করলো। আমরা তখন চাইলে যেমন ইচ্ছা তেমন ইনকাম করতে পারতাম। কিন্তু আমরা তা করিনি। কারণ আমরা চাইনি আমাদের তৃতীয় পার্টনার আল্লাহ তায়ালা আমাদের ছেড়ে চলে যান।
ব্যবসায় আমরা প্রায় সবাই যেখানে ধরা খেয়ে যাই, তা হলো ইমানদারি। আমরা মাল্টি-ন্যাশনাল কোম্পানির অজুহাত দিই। অথচ সততা দেখাতে পারি না। আমি বিশ্বাস করি, আমরা যদি পাক্কা ইমানদারির সাথে ব্যবসা করি, তাহলে মাল্টি-ন্যাশনালই নয়, বরং মানুষ চীন জাপানকেও ভুলে যাবে।
আমরা চাঞ্চ পেলে আরেকজনকে ঠকানোর কোন সুযোগই মিস করি না। একবার এক সাহাবির গোলাম একটি ঘোড়া নিয়ে এসে বলল, হজরত এই লোক এই ঘোড়া মাত্র তিন শত দিরহামে দিয়ে দিচ্ছে।
কিন্তু সাহাবি এর দাম বাড়াতে বাড়াতে আটশত দিরহাম দিয়ে কিনলেন। গোলাম কারণ জানতে চাইলে বললেন, নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, কেউ যদি তোমার কাছে কম দামে কোন জিনিস বিক্রি করতে চায়,আর তোমার যদি ন্যায্য মূল্য দিয়ে ক্রয়ের ক্ষমতা থাকে তাহলে তা ন্যায্য মূল্যেই ক্রয় করাে।
এ ঘোড়ার আসল দাম হবে এক হাজার দিরহাম। আমি তো তা-ও দুই শত দিরহাম কম দিচ্ছি।
এই ছিল আমাদের ইতিহাস। এই সিলসিলা জারি থাকার কারণেই ওমর ইবনে আব্দুল আজিজের সময়ে লোকেরা জাকাত নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত, কিন্তু জাকাত গ্রহীতা পাওয়া যেত না।
আমরা কার কাছে কত টাকা সঞ্চিত আছে তা নিয়ে গর্ব করি। অথচ হজরত ওমর, ওসমান, আলির সময়ে বাইতুল মাল ঝাড়ু দিয়ে সব দিয়ে দেয়া হতো। অথচ আজ আমরা কোন দেশের রেভিনিওতে কত বিলিয়ন এবং কোন বাংকে কত বিলিয়ন জমা আছে তা নিয়ে রীতিমত প্রতিযোগিতা করি।
অথচ অজস্র মানুষ তখনও অনাহারে অর্ধাহারে দারিদ্র সীমার নিচে চরম মানবেতর জীবন- যাপন করছে। আমাদের এই কথিত সভ্য সমাজের সূদি সিস্টেম এমন যে, এখানে গরিব আরও গরিব হতে থাকে এবং ধনী আরও ধনী হতে থাকে। এবং এভাবে দিনে দিনে সমাজে কেবল বৈষম্য বৃদ্ধি পেতে থাকে।
কিন্তু আমরা সর্বতোভাবে আল্লাহর আইনের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলাম৷ তিনি বলেন, وَ فِيْ السَّمَاءِ رِزْقُكُمْ وَمَا تُوْعَدُوْنَ আমরা এই আয়াতে পূর্ণভাবে বিশ্বাস করতাম৷ তাই আমাদের সাথে আল্লাহ তাআলার মোয়ামালাও ছিলো ভিন্ন রকম৷
একবার আমি আর আমার বন্ধু পেশোয়ারের আরবাব রোডের দোকানে দোকানে ব্যাগ ভর্তি কাপড় নিয়ে ধর্ণা দিচ্ছিলাম কিন্তু কেউ আমাদের কাপড় কিনতে আগ্রহী হচ্ছিল না।
আমরা যখন হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত গেলাম, তখন এক লোক এসে আমাকে বলল, আমার বাবা আপনাকে খুবই পছন্দ করেন, তার কাছে চলেন। আমরা তার সাথে সাথে গেলাম। দেখলাম এক বয়োবৃদ্ধ খান সাহেব বসে আছেন। আমাকে দেখে তিনি বললেন-
:তুমি কি গান ছেড়ে দিয়েছাে?
- জি
: সত্যি গান ছেড়ে দিয়েছো?
- জি হজরত, দেখতেই পাচ্ছেন, কাপড় নিয়ে দোকানে দোকানে ঘুরছি!
: আচ্ছা, এই দোকানটা কি তোমার পছন্দ হয়?
আমি দেখলাম আরবাব রোডের একদম সেন্টার পয়েন্টে দোতালা দোকান। কম করে হলেও এর ভাড়া হবে লাখ তিনেক।
কিন্তু আমার মাসে পঁচিশ হাজার দেওয়ারও ক্ষমতা নাই। তাই তখন আমি বললাম, হজরত আপনার এই দোকান তো প্রত্যেকেরই পছন্দ হবে কিন্তু এত টাকা ভাড়া দেওয়ার মত ক্ষমতা তো আমার নাই।
:তুমি কত দিতে পারবে বল...
- আপনি আগে কত ভাড়া নিতেন?
: আড়াই লাখ।
আমার যা সাহস ছিল এই কথা শোনার পর তা-ও আর বাকি থাকল না। আমার নীরবতা দেখে তিনিই বললেন-
: পঁয়ষট্টি হাজার দিতে পারবে?
- পঞ্চাশ হাজার দিতে পারব হজরত! আমি কোন রকমে বললাম।
: ডান। বিনা বাক্যব্যয়ে তিনি তিন লাখের দোকান পঞ্চাশ হাজারে দিয়ে দিলেন!
আমাদের তখনও সব কিছু স্বপ্নের মত লাগছিলো, বিশ্বাসই হচ্ছিল না মেইন পয়েন্টে এত ভিআইপি দোকানের মালিক এখন আমরা। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি, চার-পাঁচ বছরে আমি মোটামুটি সেটেল হয়ে গেলাম। পাঁচ বছর পরে একদিন খান সাহেব আমাকে কল করে বললেন-
: তোমার মনে আছে, কী অবস্থায় তোমাকে আমি দোকান দিয়েছিলাম?
-জি, ভালোমত মনে আছে হজরত!
:তখন তুুুমি ভাড়া বলেছিলে, এখন আমি বলব
- বলুন হজরত,কত ধরবেন?
: তিন লাখ
- ডান। আমার অবস্থা যখন খুবই খারাপ ছিলো, তখন আপনি আমাকে সাহায্য করেছিলেন। এখন আমি যদি আপনার কোন কাজে আসতে পারি, তাহলে খুবই ভালো লাগবে।
তো যারা আল্লাহর জন্য সব কিছু ত্যাগ করে, আল্লাহ তাদেরকে অলৌকিকভািবে সাহায্য করবেন। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই”।
ভিডিওটি নীচে দেয়া হলো-