বশির ইবনে জাফর ।।
অন্ধকার বর্বর যুগ থেকে মানুষকে আলোর পথে ফিরিয়ে এনেছিলো যে ঐশী গ্রন্থ, অন্ধকারাচ্ছ্বন্ন দিক্বিদিক হারা মানুষকে আলোয় উদ্ভাসিত করে শান্তির বার্তা শুনিয়েছিলো যে গ্রন্থ, সে হলো পবিত্র আল কুরআন।
মানবতার মুক্তির দিশারী মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আ. এর কাছে হযরত জিবরাইল এর মাধ্যমে যে গ্রন্থটি মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের দিয়েছেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন শিখিয়েছেন হযরত জিবরাইলকে তারপর জিবরাইল শিখিয়েছেন রাসূল সা. কে। রাসূল আবার শিখিয়েছেন তাঁর সাহাবায়ে কেরামদের।
কুরআন শিক্ষার এ ধারা অব্যহত থেকে সেই সাড়ে চৌদ্দশত বছর পূর্ব থেকেই মানুষ তার বুকে ধারণ করে এসেছে পবিত্র এ গ্রন্থের প্রতিটি বাণী। কুরআনের এই ধারাবাহিকতা তথা শিক্ষা করা এবং অন্যকে শিক্ষা দেয়া সম্পর্কে হাদিসে এসেছে ‘তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তি সর্বোত্তম যে কুরআন শিখে এবং অন্যকেও শেখায়।’
কুরআন শেখা এবং শেখানোর সেই পথ ও পদ্ধতি আজো অম্লান এ ধরার বুকে। পৃথিবীর সব মুসলিম দেশগুলোতেই মসজিদ ভিত্তিক কুরআন শিক্ষার আসর আজো চলমান। যার সূচনা স্বয়ং রাসূল সা. করে গিয়েছিলেন।
শতকরা নব্বই ভাগ মুসলমানের এ দেশ বাংলাদেশেও কুরআনের শিক্ষা আজো জীবন্ত ও প্রাণবন্ত যেমনটি রাসূল সা. এর যুগে ছিলো। একসময় সারা দেশের প্রতিটি মসজিদেই ফজরের নামাজের পরপর ছোটছোট সোনামণিদের ভিড় দেখা যেত। কায়দা, আমপারা কিংবা কুরআন বুকে যারা ছুটে আসতো মসজিদের ইমাম সাহেবের কাছ থেকে কুরআন শিখবে বলে।
বর্তমানে যুগের আধুনিকায়নে যদিও সে চিত্র শহুরে এলাকায় খুব একটা দেখা মিলে না। কমে এসেছে গ্রামগঞ্জেও। শহুরে এলাকাগুলোতে ফজরের পরপরই বিভিন্ন স্কুল কিন্ডারগার্টেন এর কার্যক্রম শুরুর ফলে সোনামণিদের কুরআন শেখার সেই দলবদ্ধ প্রয়াস এখন খুব একটা দেখা যায় না। তার মানে কি কুরআন শিক্ষার সেই নববী কার্যক্রম আজ স্থিমিত হয়ে গিয়েছে? মসজিদের ইমাম সাহেবরা কি তবে এখন ছোট ছোট শিশুদের কুরআন শেখানোর সেই ধারাবাহিকতাকে অবসর জানিয়েছেন?
কিংবা শহুরে রাস্তাঘাটে দৃশ্যমান ‘কুরআন পড়াতে চাই’ এরকম দেয়াল লিখনগুলো কি তবে কুরআন শিক্ষার ধারাবাহিকতাকে বিলুপ্তির পথে ঠেলে দিয়েছে.? এ ধরনের নানা শঙ্কা ও নানা প্রশ্নের জবাব জানতে কথা বলেছিলাম সুদূর জামালপুর জেলার জামেউল উলুম হাক্কানিয়া মাদরাসার দীর্ঘ ২৭ বছর যাবৎ মুহতামিমের দায়িত্বপালন করে আসা প্রবীণ শায়খুল হাদিস মাওলানা জাফর আহমদ কাসেমীর সঙ্গে।
তার বক্তব্য ছিলো এমন, মফস্বলসহ শহুরে মসজিদগুলোতে মোটেও ছাত্রছাত্রী কমে যায়নি বা কুরআন শিক্ষার সে নববী ধারা বিলুপ্তির পথ বেঁছে নেয়নি বরং এখনো প্রতিটি মসজিদেই কুরআন শিক্ষার জন্য শিক্ষার্থীরা আসেন।
আগে এক বেলা সকালে আসতো এখন নানা স্কুল ও কিন্ডারগার্টেন চালুর দরুন যেসব বাচ্চা সকালে যেতে পারে না তাদের জন্য বিকেলেও ব্যবস্থা করা হয়েছে যেটাকে বৈকালিক মক্তব বলে চিনে থাকবেন।
শুধু তাই নয় আগে বৃদ্ধদের জন্য কোন মক্তব তেমন ছিলো না অথচ এখন শহরের প্রায় মসজিদগুলোতেই বয়স্ক মাদরাসা নামে কুরআন শিক্ষার মক্তব চালু হয়েছে এবং সেগুলোতে বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষেরা তাদের কাজ শেষে কুরআন শিখতে উপস্থিত হচ্ছে।
শহরে বিভিন্ন ধরনের লিফলেট প্রচার করে কুরআন শিক্ষা দেয়ার ব্যপারটি সম্পর্কে তিনি বলেন, এটাও আমার দৃষ্টিতে একটি ভালো দিকই বটে। কারণ এটাকে বাণিজ্য হিসেবে দেখার কোনই অবকাশ নেই। একটা ছেলে বাড়ি বাড়ি কুরআন শিখিয়ে কত টাকাই বা ইনকাম করে। অথচ তাদের সেই বাসা বাড়িতে গিয়ে কুরআন শেখানোর চেষ্টা আছে বলে হয়ত যেসব ফ্যামিলির ছেলে মেয়েরা মসজিদের মক্তবে আসতে পারছে না তারা ঘরে বসেই কুরআন শিখতে পারছে।
তাছাড়া দেশে এখন মাদরাসা বেড়েছে বহুগুণ। সেগুলোতে ছাত্ররা কুরআনের হাফেজ হচ্ছে এবং সারা বিশ্বে বাংলাদেশের হাফেজদের সমাদর রয়েছে। তারা একের পর এক শ্রেষ্ঠত্বের সাক্ষর রেখে চলেছে কুরআন শিক্ষার প্রতিযোগিতায়। এসব ঘটনাই প্রমাণ করে কুরআনের সেই নববী প্রচেষ্টা আজো অব্যহত রয়েছে। যদিও সময় ও যুগের আধুনিকায়নের ফলে শেখা ও শেখানোর কৌশলে এসেছে পরিবর্তন।
একই বিষয় নিয়ে কথা বলেছিলাম এমন একজন মানুষের সাথে যিনি মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে কুরআন শেখাচ্ছেন ছোটছোট বাচ্চাদের এমনকি বয়োজ্যেষ্ঠ বৃদ্ধাদেরও যাদের অনেকেই বয়সের কথা ভেবে লজ্জায় মসজিদের মক্তবে যেতে পারছেন না লোকে কী বলবে ভেবে।
কথা বলেছিলাম হাফেজ মাহফুজ সালেহিনের সাথে, যিনি ঢাকার শনিরআখড়া এলাকায় একটি মসজিদে মুয়াজ্জিনের দায়িত্ব পালন করে আসছেন দীর্ঘ ৮ বছর যাবৎ। তার ভাষ্য ছিলো, এক সময় জেনারেল শিক্ষা ব্যবস্থায় কোচিং প্রাইভেট বলে কিছু ছিলো না।
মানুষের শিক্ষার একমাত্র স্থান ছিলো স্কুল কলেজ। দূর-দূরান্ত থেকে হেঁটে যারা শিক্ষালয়ে এসে বিদ্যার্জন করেছিলো তাদের সন্তানরাই আজ বাসায় টিউটর রেখে কোচিং বা প্রাইভেট পড়াচ্ছেন। এটা দোষণীয় কিছু নয় বরং শিক্ষা ব্যবস্থায় অভাবনীয় পরিবর্তন ও সহজিকরণ বলা যায়।
আর আমরা যারা বিভিন্ন মসজিদের সাথে সম্পৃক্ত রয়েছি তারাও নিজেদের সময় সুযোগ তৈরি করে দুএকটি বাসায় গিয়ে কুরআন শিক্ষা দিয়ে আসলাম তাতে আমারও সওয়াব হলো এবং যে শিখছে সেও ঘরে বসেই কুরআন পড়া শিখতে পারছে। এতে কি উপকার হলো না.?
তাছাড়া শহরের প্রায় প্রতিটি মসজিদেই তো মক্তব আছে। হয় বিকেলে না হয় সকালে বা সন্ধ্যার পর।
হয়ত শহর এলাকা বলে দলবেঁধে শিশুদের কুরআন বুকে মক্তবে যাওয়ার দৃশ্য দেখা যায় না তাই বলে যে কুরআনের শিক্ষা চলছে না একথা ভাববার সুযোগ নেই।
এ বিষয়ে কথা বলেছিলাম কলেজ পড়ুয়া দনিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের শিক্ষার্থী মেহেদি হাসানের সাথে। যে কিনা কলেজ, কোচিং, প্রাইভেট ইত্যাদি পড়ার পাশাপাশি সময় সুযোগ করে বাসায় একজন আরবি শিক্ষকের থেকে কুরআনও শিখছে।
দীর্ঘক্ষণের আলাপচারিতায় জানা গিয়েছিলো তার মতো এমন আরো বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী রয়েছে যারা বিভিন্ন মসজিদের ইমাম বা মুয়াজ্জিনদের থেকে আলাদাভাবে কুরআন শিখে। মসজিদে মক্তবে যাওয়ার সুযোগ তাদের হয় না তাই বাসায় বা মসজিদে গিয়ে আলাদাভাবে শেখার ব্যবস্থা করেছে এমনটিই জিনিয়েছিলো সে।
তাদের সবার কথা ও অভিমত জেনে পবিত্র কুরআনের একটি বাণী আমার বারবার মনে হচ্ছিলো; ‘ইন্না নাহনু নায্যালনায যিকরা ওয়া ইন্না লাহু লাহাফিজুন’ তথা, আমিই আল্লাহ এই কুরআন নাজিল করেছি এবং আমিই তার সংরক্ষণ করবো। -আল কুরআন।
সত্যিই আপাতদৃষ্টিতে কুরআনের সেই মক্তব ভিত্তিক কার্যক্রম নেই মনে হলেও কুরআন চর্চা থেমে নেই। হয়তো পদ্ধতিগুলো পরিবর্তন হচ্ছে বা হবে।
যে চর্চার ফসল হাফেজ নাজমুস সাকিব, ও হাফেজ তরিকুল ইসলামের মতো বিশ্বজয়ী হাফেজরা। আর আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এভাবেই তাঁর ঐশী বাণিকে সংরক্ষণ করে নিচ্ছেন যুগের পর যুগ।
আরএম/