রকিব মুহাম্মদ: আল্লাহ তায়ালা বলেন, আর আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করব কিছু ভয়, ক্ষুধা এবং জান, মাল ও ফলফলাদির ক্ষতির মাধ্যমে। আর তুমি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দাও। যারা, নিজেদের বিপদ-মুসিবতের সময় বলে, “নিশ্চয় আমরা আল্লাহর জন্য এবং নিশ্চয় আমরা আল্লাহরই দিকে প্রত্যাবর্তনকারী”, তাদের ওপরই রয়েছে তাদের রবের পক্ষ থেকে মাগফিরাত ও রহমত এবং তারাই হিদায়াতপ্রাপ্ত। (সুরা-২ [৮৭] বাকারা, রুকু: ১৯, আয়াত: ১৫৫-১৫৭; পারা: ২)।
প্রকৃতির যাবতীয় নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা তারই অধীনে। কখনো প্রকৃতি বিরূপ রূপ ধারণ করে। রূঢ় ও রুষ্ট হয়, যাকে আমরা প্রাকৃতিক দুর্যোগ বলি। যেমন ঘূর্ণিঝড়, কালবৈশাখী ঝড়, শিলাবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, জলোচ্ছ্বাস, ভারী বর্ষণ, বন্যা, খরা, দাবানল, শৈত্যপ্রবাহ; দুর্ভিক্ষ, ভূমিকম্প, সুনামি প্রভৃতি।
প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় কিছু সুন্নত আমল করার মাধ্যমে ক্ষয়ক্ষতি থেকে বাঁচার সুযোগ রয়েছে। আজ কয়েকটি জরুরি ও সুন্নত আমলের কথা তুলে ধরা হলো।
দুর্যোগে আল্লাহর রাসুল সা. ও সাহাবী রাযি. যা করতেন: হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, প্রচণ্ড ঝড়ো হাওয়া বইলে রাসুলুল্লাহ সা. মসজিদে যেতেন এবং নামাজে মশগুল হতেন। (মিশকাত শরিফ: ৬৯৬)।
হজরত আয়েশা রা. বর্ণনা করেন, মেঘ দেখলে নবীজির চেহারা মোবারক বিবর্ণ হয়ে যেত এবং তিনি ভয়ে কখনও ঘরের ভেতর প্রবেশ করতেন, কখনও বাইরে আসতেন। আর যখন বৃষ্টি শুরু হয়ে যেত তখন তার চেহারায় আনন্দ প্রকাশ পেত।
আয়েশা রা. জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! সব লোকই যখন বৃষ্টির আলামত মনে করে মেঘ দেখে খুশি হয়, আপনার মধ্যে তখন এক ধরনের বিচলিত ভাব দেখতে পাই? নবীজি বললেন, ‘আয়েশা! এটা তো হতে পারে এমন, যেভাবে আদ সম্প্রদায় মনে করেছিল! অতঃপর তারা যখন শাস্তিকে মেঘরূপে তাদের উপত্যকা অভিমুখী দেখল, তখন বলল, এ তো মেঘ, আমাদের বৃষ্টি দেবে। বরং এটা সেই বস্তু; যা তোমরা তাড়াতাড়ি চেয়েছিলে। এটা বায়ু; এতে রয়েছে মর্মন্তুদ শাস্তি।’ -সুরা আহকাফ : ২৪; মুসলিম : ৮৯৯
হুদায়বিয়ার সন্ধিকালে নবীজি সা. একদিন বৃষ্টির পর সাহাবিদের নিয়ে ফজর আদায় করলেন। নামাজ শেষে সাহাবিদের দিকে ফিরে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কি জান তোমাদের প্রতিপালক কী বলেছেন?
সাহাবিরা বললেন, আল্লাহ এবং তাঁর রাসুলই বেশি জানেন। নবীজি বললেন, আল্লাহ বলেন, অবস্থা এমনও হয় যে, আমার বান্দাদের কেউ মোমিন হয়ে আর কেউ কাফের হয়ে ভোরে ওঠে। যে বলে, আল্লাহর অনুগ্রহে আমাদের ওপর বৃষ্টি বর্ষিত হয়েছে, সে আমার প্রতি বিশ্বাসী এবং নক্ষত্রের প্রতি অবিশ্বাসী প্রমাণিত হলো। আর যে বলল, অমুক অমুক নক্ষত্রের বদান্যতায় আমরা বৃষ্টি পেয়েছি, সে সেই নক্ষত্রের প্রতি বিশ্বাসী এবং আমার প্রতি অবিশ্বাসী সাব্যস্ত হলো।-বোখারি : ১০৩৮
সাহাবিদের জীবনে আমরা দেখি, বিপদে-মুসিবতে তাঁরা নামাজে দাঁড়াতেন ও ধৈর্য ধারণ করতেন। (মিশকাতুল মাসাবিহ: ৫৩৪৫)।
ঝড়-তুফানের প্রাদুর্ভাব ঘটলে তাকবির (আল্লাহু আকবার (আল্লাহ মহান) বলা ও আজান দেওয়া সুন্নত। (তবে এই আজানে ‘হাইয়া আলাছ ছলাহ’ (নামাজের জন্য আসো) ও ‘হাইয়া আলাল ফালাহ’ (সফলতার জন্য আসো) বাক্যদ্বয় বলার প্রয়োজন নেই।
দুর্যোগের সময় করণীয় সুন্নত আমল: প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় কিছু সুন্নত আমল করার মাধ্যমে ক্ষয়ক্ষতি থেকে বাঁচার সুযোগ রয়েছে।
হাদিসে আছে, যখন কোথাও ভূমিকম্প সংঘটিত হয় অথবা সূর্যগ্রহণ হয়, ঝড়ো বাতাস বা বন্যা হয়, তখন সবার উচিত মহান আল্লাহর কাছে তওবা করা, তাঁর কাছে নিরাপত্তার জন্য দোয়া করা, মহান আল্লাহকে স্মরণ করা এবং ক্ষমা প্রার্থনা করা।
এ ক্ষেত্রে রাসুলুল্লাহ সা. নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, ‘দ্রুততার সঙ্গে মহান আল্লাহর জিকির করো, তাঁর নিকট তওবা করো।’ (বুখারি ২/৩০; মুসলিম ২/৬২৮)।
আল্লাহর জিকিরের সর্বোত্তম উপায় হচ্ছে নামাজ পড়া, কুরআন তেলাওয়াত বা দোয়া-দরুদ পাঠ করা। দুর্যোগের সময় জিকিরের আরও উপায় হতে পারে ইস্তিগফার, তসবি পাঠ ইত্যাদি।
সাধারণ বৃষ্টি-বাদলের সময় ও বৃষ্টির পর পড়ার সুন্নত দোয়া
হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রা. বর্ণনা করেন, বৃষ্টি হলে রাসুলুল্লাহ সা. এই দোয়া পড়তেন: اللَّهُمَّ صَيِّبًا نَافِعًا
উচ্চারণ: ‘আল্লাহুম্মা ছয়্যিবান নাফিআ’। অর্থ: হে আল্লাহ! এই বৃষ্টি যেন আমাদের জন্য উপকারী ও কল্যাণকর হয়।’ –বুখারী, হাদীস: ৯৮৫
হযরত যায়েদ ইবনে ছাবিত রা. বর্ণনা করেন, বৃষ্টির পর রাসুলুল্লাহ সা. বলতেন: مُطرنا بفضل الله ورحمته
উচ্চারণ: মুতিরনা বি-ফাদলিল্লাহি ওয়া রাহমাতিহি। অর্থ: ‘আল্লাহ তাআলার দয়া ও অনুগ্রহে আমরা বৃষ্টিস্নাত হয়েছি।’ –বুখারী ও মুসলিম, হাদীস: ৭১-মুসলিম
ভারী বর্ষণ ও অতিবৃষ্টির সময় পড়ার সুন্নত দোয়া
হযরত আনাস ইবনে মালিক রা. বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সা. অধিক বৃষ্টি ও ভারী বর্ষণের সময় এই দুয়া পড়তেন,
اللهم حوالينا ولا علينا، اللهم على الآكام والظِّرَاب وبطون الأودية ومنابت الشجر
উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা হাওয়ালাইনা ওয়া লা আলাইনা, আল্লাহুম্মা আলাল আ-কামি ওয়ায-যিরাবি ওয়া বুতুনিল আওদিয়াতি ওয়া মানাবিতিশ শাজারি।
অর্থ: হে আল্লাহ! এই ঝড়, তুফান ও ভারী বর্ষণ আমাদের আশপাশ থেকে সরিয়ে নিন, দয়া করে আমাদের ওপর ঝড়, তুফান ও ভারী বর্ষণ দেবেন না। হে আল্লাহ, এই ভারী বর্ষণ দিন টিলা-পর্বতে, উঁচু ভূমিতে, উপত্যকায়, বনভূমি ও চারণ ভূমিতে। –বুখারী ও মুসলিম, হাদীস: ৯৬৮-বুখারী
ঝড়-তুফানের সময় পড়ার সুন্নত দোয়া
হযরত আয়িশা সিদ্দিকা রা. বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সা. ঝড়-তুফানের সময় এর ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পেতে এই দুআ পড়তেন-
اللهم إني أسألك خيرها ، وخير ما فيها ، وخير ما أُرسلت به ، وأعوذ بك من شرها وشر ما فيها وشر ما أرسلت به
উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা ইন্নী আসআলুকা খাইরাহা ওয়া খাইরা মা ফী-হা ওয়া খাইরা মা আরসালতা বিহী, ওয়া আউযু বিকা মিন শাররিহা ওয়া শাররি মা ফী-হা ওয়া শাররি মা আরসালতা বিহী।
অর্থ: হে আল্লাহ! আমি আপনার নিকট প্রার্থনা করি এই ঝড়ের কল্যাণ, এর মধ্যস্থিত কল্যাণ, এর সঙ্গে প্রেরিত কল্যাণ। আমি আপনার নিকট পানাহ চাই এই ঝড়ের অনিষ্ট থেকে, এর মধ্যস্থিত অনিষ্ট থেকে, এর সঙ্গে প্রেরিত অনিষ্ট থেকে। –বুখারী ও মুসলিম, হাদীস: ১৫০২-মুসলিম
বজ্রপাত, ঝড়-তুফান ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে বাঁচার বিশেষ দোয়া
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. বর্ণনা করেন, বজ্রপাত ও বিজলি চমকানোর সময় এর ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পেতে রাসুলুল্লাহ (সা.) এই দুআ পড়তেন-
اللَّهُمَّ صَيِّبًا نَافِعًا، اللَّهُمَّ صَيِّبًا هَنِيئًا، اللهم لا تقتلنا بغضبك، ولا تهلكنا بعذابك، وعافنا قبل ذلك
উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা ছায়্যিবান নাফিআ, আল্লাহুম্মা ছায়্যিবান হানীআ। আল্লাহুম্মা লা তাকতুলনা বি-গদাবিকা, ওয়া লা তুহলিকনা বি-আযাবিকা ওয়া আ-ফিনা ক্বাবলা যা-লিকা।
অর্থ: হে আল্লাহ! গজব দিয়ে আমাদের নিঃশেষ করবেন না, আযাব দিয়ে আমাদের ধ্বংস করবেন না; এর পূর্বেই আমাদের ক্ষমা করে দিন। –বুখারী, হাদীস: ৭২১; মিশকাত, হাদীস: ১৫২১; তিরমিযী, হাদীস: ৩৪৫০; নাসাঈ, হাদীস: ৯২৭; আহমাদ, হাদীস: ৫৭৬৩।
পরিশেষ: পৃথিবীতে ঝড়-তুফান, ঘূর্ণিবার্তা, বন্যা এবং এ ধরনের বিপদ আসে, তখনই পরকালের মুক্তিকামী মানুষ সাবধান হয়, অন্যায় পথ পরিত্যাগ করে ন্যায়পথের অনুগামী হয। অন্যায়-অনাচার, জুলুম-অত্যাচার, পাপ-পংকিলতায় পূর্ণ জীবন, আল্লাহর নাফরমানি ও অবাধ্যতা এবং নির্লজ্জতা, অশ্লীলতার প্রতিক্রিয়া হিসেবে নেমে আসে আসমানী-যমিনী বালা-মুসিবত, ভয়াবহ ঝড়-তুফান, টর্নেডো এবং বন্যা দেখা দেয় দুর্ভিক্ষের কালো ছায়া অগ্নিকান্ড মহামারি, ভূমিকম্প আর ধ্বংস।
তখন সর্বাগ্রে আমাদের একান্ত কর্তব্য হলো, তওবা এস্তেগফারের পথ অন্বেষণ করা, কৃত অন্যায়ের জন্য আল্লাহর নিকট অনুতপ্ত হওয়া এবং ভবিষ্যতে অন্যায়-অনাচারে লিপ্ত না হওয়ার দৃঢ় অঙ্গীকার করা, আল্লাহর দরবারে অনুতপ্ত চিত্তে অশ্রুপাত আমাদের পাপ মোচনের জন্য সহায়ক হতে পারে।