সম্প্রতি বিশিষ্ট লেখক শরীফ মুহাম্মদের একটি দীর্ঘ আত্মজৈবনিক সাক্ষাৎকার নেন জহির উদ্দিন বাবর। সেই সাক্ষাৎকারটির অংশবিশেষ প্রকাশিত হয়েছে লেখা ও লেখকের কথা নিয়ে প্রকাশিত লেখকপত্রের তৃতীয় সংখ্যায়। আওয়ার ইসলামে পুরো সাক্ষাৎকারটি পর্যায়ক্রমে গদ্য আকারে প্রকাশিত হচ্ছে। আজ প্রকাশিত হলো পঞ্চদশ ও শেষ পর্ব
একটা সময় তো ছিল এমন, ইসলামি ধারার লেখালেখিগুলোকে সাহিত্য হিসেবে ওরা স্বীকারই করতে চাইত না। অথবা ইসলামি ধারার যারা সাহিত্যের পাঠক ছিল তাদেরও গণ্য করতো না। এখন একটা সময় এসেছে আলেম লেখকদের মধ্যে আমি যদি বলি কুড়ির বেশি হবে এমন লেখক যাদের লেখায় সাহিত্যপ্রসাদ আছে, উপাদান তো আছেই, ইসলাম তো আছেই, সাহিত্যও আছে। আর তরুণ লেখকদের মধ্যে শতাধিক হবে এমন যাদের লেখায় ইসলামও আছে, সাহিত্যও আছে, আমি আশাবাদী।
যদি পথপরিক্রমা ঠিক থাকে, ইসলামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে আনুকূল্য দেয়া হতে থাকে, প্রাতিষ্ঠানিক নানামাত্রিক সহযোগিতার দরজাগুলো খোলা থাকে, ইসলামি মিডিয়ার সংখ্যা বাড়ে, তাহলে দশ বছর, বারো বছর, পনের বছর পর ঠিক টেক্কা দিতে না পারলেও সাহিত্যের একটা সমান্তরাল জায়গায় গিয়ে আলেমদের বইপত্রগুলো এক র্যাপকে রাখা হতে থাকবে। বইয়ের সেলফে একসঙ্গে উঠতে থাকবে।
পাঠকরা যিনি সৈয়দ মুজতবা আলীর সফরনামা পড়েন তারা একসঙ্গে আবু তাহের মেসবাহ সাহেবের সফরনামাও পড়বেন। যাইনুল আবিদীনের সফরনামাও পড়বেন, জহির উদ্দিন বাবরের সফরনামাও পড়বেন। যিনি সৈয়দ শামছুল হকের আত্মজীবনী পড়েন উনি আবার আমাদেরই আরেকজন আলেম-লেখকের আত্মজীবনী পড়বেন।
এই জায়গাগুলোতে আজকে থেমে যাওয়ার বিষয় নেই। আমার মনে হয়, আমরা যদি বৈচিত্র্য নিয়ে সাহিত্যে এগিয়ে যাই, ভ্রমণকাহিনি, গল্প, গদ্য, ফিচার, প্রবন্ধ, ইতিহাস, ইসলামি মাসায়েল, সিরাত, তাফসির, বিচিত্র মাত্রার সাহিত্য আমাদের নবীণেরা করে, মানোত্তীর্ণ সাহিত্য করার চেষ্টা করে; ১০/১২ বছর পরে অন্তত একই সেলফে একটা অবস্থানের জায়গায় আমি আশা করি ইসলামি সাহিত্য চলে যাবে। আমি এটাকে খুব দূরের বা অসম্ভব কিছু মনে করি না।
আমরা ইনস্টিটিউট অব জার্নালিজম অ্যান্ড দাওয়াহ নামে একটি ইনস্টিটিউট করেছি। ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠানটির দুই বছর পার হয়েছে। এর কার্যক্রম আপাতত পরিমাণের দিক থেকে খুব কম। আমরা আসলে এটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে করিনি। অনেকগুলো জিনিস, এক হলো জেনারেল বা বেসিক সাংবাদিকতা শেখার ক্ষেত্রে কিছু কাজ করা। সাংবাদিকতার সঙ্গে ইসলাম বা দাওয়াহর বিষয়টা কীভাবে আসে এটা নিয়ে কিছু কাজ করা।
সাংবাদিকতায় ইসলামবিরোধী যে উপাদানগুলো যুক্ত হয় এটা থেকে সংবাদকর্মীরা কীভাবে নিজেদের উত্তীর্ণ রাখবেন সেটা ধরিয়ে দেওয়া, সেইসঙ্গে গণমাধ্যমের ভুল প্রবণতা থেকে জনসাধারণকে কীভাবে সতর্ক করা যায় এই কাজগুলো করা। সাংবাদিকতার ব্যাপারে ক্রিটিসিজমের একটা মানসিকতা মানুষের ভেতরে তৈরি করা। কারণ মিডিয়ায় যা প্রকাশ হয়, পত্রিকায় যা ছাপা হয় এটাকে ‘ওহির বাক্য’ মনে করার একটা প্রবণতা আছে আমাদের সমাজে।
এই কারণে বাংলাদেশের ইসলামপ্রিয় মানুষ বা ইসলামপ্রিয় প্রতিষ্ঠান, ইসলামি ধারণা অনেক সময় অবহেলার শিকার হয়, আক্রান্ত হয়। গণমাধ্যম নিয়ে, সাংবাদিকতা নিয়ে মানুষের ভেতরে প্রশ্ন সৃষ্টি করা, এই কাজটাও আমাদের ইনস্টিটিউশনের একটা বিষয়। আমরা আসলে যেভাবে চেয়েছি সেভাবে এখনও পারিনি। কিন্তু আমরা কাজ ধরে রেখেছি, অন্তত বছরে আটটা-দশটা প্রোগ্রাম করার চেষ্টা করি। আর তরুণ সাংবাদিকদের যাদের সঙ্গেই যখন আমাদের বৈঠক হয় তখন সাংবাদিকতার এই কলাকৌশলগুলো নিয়ে মতবিনিময়ের চেষ্টা করি। সামনে পরিস্থিতি এবং সহযোগিতার আনুকূল্য পেলে এটা নিয়ে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে দেশব্যাপী এবং রাজধানীকেন্দ্রিক প্রোগ্রাম এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা আছে।
ব্যক্তিগতভাবে আমি লেখালেখি, বয়ান এবং শিক্ষকতা তিনটির সঙ্গেই টুকটাক জড়িত। কোন পরিচয়টা আমার মুখ্য এটা নিয়ে আমিই অনেক সময় রহস্যের মধ্যে পড়ে যাই। আসলে এখন তিনটা পরিচয়েই পরিচিত। একটা সময় বক্তব্যদাতা বা আলোচক ছিলাম না। প্রয়োজনীয় আলোচনা করতে করতে এই পরিচয়টাও যুক্ত হয়ে গেছে। এই মুহূর্তে আলোচক সত্তাটাকে একদম বাদ দিয়ে দেয়া আমার পক্ষে কঠিন। আর লেখালেখি থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করলে আমি বাঁচব না। মানে লেখালেখির সত্তাটা থেকে, ভাবনাটা থেকে সরে যেতে পারব বলে মনে হয় না। অনেক সময় ভালো একটা লেখা লিখতে এক বছরও পার হয়ে যায়। শিক্ষকতাটায় আমি একটা লম্বা সময় ধরে অনুপস্থিত। এর মধ্যে আলহামদুলিল্লাহ গত কয়েক বছর যাবত মারকাযুদ দাওয়াহর দাওয়া বিভাগে দাওয়া ও গণমাধ্যম সংশ্লিষ্ট কিছু আলোচনা মাসে দুই-এক বার করে করা হয় ক্লাসের মতো, এটা করার চেষ্টা করি। আমি আসলে কোনো অবস্থাতেই কোনো পরিচয় থেকেই নিজেকে আলাদা করতে চাই না।
গত কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন মাহফিলে গিয়ে দেখেছি এটি একটা বিশাল জগৎ। ওয়াজ মাহফিল দীন প্রচারের একটা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ মাধ্যম। এই জগৎ সম্পর্কে সামগ্রিক মূল্যায়নের জন্য যে অভিজ্ঞতা দরকার সেটা আসলে আমার নেই। আমি গত দুই-তিন বছর যে যাচ্ছি এই যাওয়া দ্বারা আমার একটা মূল্যায়ন হয়েছে, সেটা হলো, মাহফিলে অনেক ধরনের দীনি কথাবার্তাই হয়। একশ্রেণির শ্রোতা শুধু দীনের কথা শুনতে আসেন, আবার এক শ্রেণির মানুষ কথাগুলো একটু উপভোগের সঙ্গেও শুনতে আসেন। মজা লাগার সঙ্গে শুনতে আসেন। এজন্য অনেক রকমের উত্তাপ, অনেক রকমের সুরের কারুকাজ থাকে মাহফিলে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে বোদ্ধা শ্রোতাদের একটা অংশও বাড়ছে, এবং মাহফিলে কিছুটা উপভোগ্য করে হলেও আসলে ভালো আলোচক এমন মানুষের মনোযোগ দেয়া দরকার বলে মনে হয়েছে।
এটা জেলায় জেলায়, শহরে শহরে হওয়া দরকার। তাহলে এই মাহফিলগুলোর মাধ্যমে ফায়দাটা আরও বেশি হবে। মাহফিলের যারা আয়োজক থাকবেন তারাও দাওয়াত দেয়ার ক্ষেত্রে একটু বিন্যাস করে নিতে পারেন, যারা মাহফিল জমাবেন এমন দুই-একজনকে দাওয়াত দিলেন, আর যারা মাহফিলের জন্য উপকারী কথা বলবেন এমন দুই-একজনকে দাওয়াত দিলেন; এভাবে কম্বিনেশন করে দাওয়াত দিলে উপকারের দিকটা বাড়বে। এবং একই সঙ্গে আলোচকদের মধ্যে বিষয় ভাগ করে দেয়া যায়। সামাজিক এবং দীনি বিভিন্ন প্রয়োজন সামনে নিয়ে সেখান থেকে তারা দীনের রাহনুমায়ি করবেন, তাহলে আমার মনে হয় মাহফিলের ফায়দাটা আরও বাড়বে, ধারাটা আরও উন্নত হবে। ঐতিহ্যবাহী এই দ্বীনী সংস্কৃতির কল্যাণকর বিকাশটা আরও বড় পরিসরে হবে। (সাক্ষাৎকার-গদ্য এখানে সমাপ্ত হলো।)