শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


সমসাময়িক ও অনুজ যাদের লেখা আমাকে মুগ্ধ করে

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

সম্প্রতি বিশিষ্ট লেখক শরীফ মুহাম্মদের একটি দীর্ঘ আত্মজৈবনিক সাক্ষাৎকার নেন জহির উদ্দিন বাবর। সেই সাক্ষাৎকারটির অংশবিশেষ প্রকাশিত হয়েছে লেখা ও লেখকের কথা নিয়ে প্রকাশিত লেখকপত্রের তৃতীয় সংখ্যায়। আওয়ার ইসলামে পুরো সাক্ষাৎকারটি পর্যায়ক্রমে গদ্য আকারে প্রকাশিত হচ্ছে। আজ প্রকাশিত হলো চতুর্দশ পর্ব


আমার সমসাময়িকদের অনেকেই অত্যন্ত ভালো লেখেন। এক্ষেত্রে আমাকে কয়েকজনের কথা বিশেষভাবে বলতে বললে বলব, আমার বন্ধু, প্রায়-সহপাঠী বলা যায়, মাওলানা ইয়াহইয়া ইউসুফ নদভীর কথা। লেখায় শক্তিমান, যার লেখায় একধরনের স্বপ্নচারিতা থাকে, একধরনের কারুকাজ থাকে। আমার এক বছরের বড় ফরিদাবাদ মাদরাসায় মাওলানা মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন, যার লেখালেখির শুরুর পাঁচ-ছয় বছর বিশেষ কোনো বাঁক বদল ঘটেনি। কিছু অভ্যস্ত গদ্যই আমি দেখেছি। কিন্তু দিন যেতে যেতে, ১০ বছর পার হওয়ার পরে তার গদ্যের মধ্যে একটা অভূতপূর্ব উত্তরণ আমি লক্ষ্য করেছি। আমি এখন বলব, বাংলাদেশে চল্লিশোর্ধ শক্তিমান আলেম লেখক যারা, যাদের গদ্যের আধুনিক টেকনিকটা সবচেয়ে সুন্দরভাবে আসে তাদের মধ্যে মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন একজন।

আমি আমার একটু সিনিয়র ভাই মাওলান উবায়দুর রহমান খান নদভীর কথা বলব। একসময় আমি তাঁর গদ্যের দ্বারা প্রভাবিতও হতাম মুসলিম জাহানের যুগে। ইনকিলাবেও তাঁর কোনো কোনো গদ্য আমাকে মুগ্ধ করেছে। তাঁর গদ্যের মধ্যে সিরিয়াস আবার মুচমুচে ভাব দুটার সমন্বয় ঘটে। আমি খুব প্রভাবিত হই। একসময় আমাকে বলা হতো, তোমার লেখাগুলো কঠিন হয়ে যায়। আবদুল আজিজ আল আমান সাহেবের গদ্যের একটা প্রভাব এবং সিরিয়াস সিরিয়াস প্রবন্ধ পড়ারও একটা প্রভাব ছিল। তখন আমার মনে হতো মুচমুচে বা ঝরঝরে লেখাটা কীভাবে লিখতে পারি, যে লেখাটি পড়তে মজা লাগে। যে লেখাটি পড়তে দেমাগে চাপ বা কষ্ট লাগে না। আমি বেশ কয়েকজনের লেখার পাশাপাশি উবায়দুর রহমান খান নদভীর লেখাগুলির দিকে মনোযোগ দেয়া শুরু করি। অন্য আরও কিছু কলামের দিকেও মনোযোগ দিই। আমি তাঁর প্রতি ঋণ স্বীকার করি।

আমাদের আরেকটু সিনিয়র, একদম সহপাঠী না, মাওলানা হেমায়েত উদ্দীন সাহেব, তাঁর গদ্যও সুন্দর। তিনি যদিও ইলমি ও দীনি জরুরতকে সামনে নিয়ে সুন্দর সুন্দর কিছু পাঠকপ্রিয় কাজ করেছেন, কিন্তু তাঁর সাধারণ ও রম্য গদ্য দেখবেন খুব সুন্দর। মাওলানা ওয়াসেল ইন্তেকাল করেছেন, তাঁর গদ্য সুন্দর। তবে সে অভ্যস্ত লেখক ছিল না।

মাওলানা মাসউদুর রহমান ভাইয়ের কথা আমি বিশেষভাবে বলব, যিনি কয়েক দিন আগে ইন্তেকাল করেছেন, তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সবই অনুবাদ, কিন্তু তাঁর গদ্য সুন্দর। যে কেউ তারবিয়াতুস সালিক পড়ুক, কী কঠিন একটি কিতাব, সুওয়ারুম মিন হায়াতিস সাহাবা, সুওয়ারুম মিন হায়াতিত তাবিয়িনের অনুবাদ পড়ে দেখুন, অনেক উন্নত গদ্য।

এরকম আরও অনেকেই আছেন। আরেকজন হচ্ছেন রশীদ জমীল। কথাশিল্প বা গল্পগদ্যের এক প্রাণবন্ত নাম। ফেসবুকের বাইরে অনেকদিন তার বই পড়া হয় না। এক প্রশ্নের উত্তরে বা এক বসায় সবার কথা মনেও পড়ে না। হঠাৎ করে একবসায় সবার প্রসঙ্গ মাথায় আসে না। এজন্য এ প্রসঙ্গের আলোচনাটাকে সিরিয়াস কোনো মূল্যায়ন হিসেবে না নিলে আমার জন্য সহজ হবে।

আর আমার পরবর্তী জেনারেশন বা ৩০ থেকে ৪০ অথবা ২৫ থেকে ৪০ এরকম বয়সের লেখক যারা; যাদেরকে আমাদের পরবর্তী ধাপ বলতে পারি; এখানে আমি একদল লেখকের আগুয়ান ঝাঁক দেখি। এখানে দুটি ভাগ করতে পারি। একটি হলো যারা নিয়মিত সাহিত্য করেন। বইপত্র লেখেন, পত্রপত্রিকায় লেখেন, আরেকটি যারা ফেসবুকে লেখেন। ফেসবুকে যারা লেখেন তাদের কথা পড়ে বলছি। যারা বইপত্র করছেন তাদের মধ্যে আমি একটা উত্তীর্ণ ঝাঁক দেখছি যারা ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে আছেন।

আমি সালাহউদ্দিন জাহাঙ্গীরের কথা বলব। তার হাত খুব মজবুত। সে যদি আরও সচেতন হয়ে লেখে, ভাব ও রুচির সঙ্গে সমন্বয় করে ভাষা প্রয়োগের ব্যাপারে যদি আরও সচেতন হয়, তাহলে আমার কাছে মনে হয় তার কাজ আরও সুন্দর হবে। আমি জহির উদ্দিন বাবরের কথা বলব। যার প্রথম দিককার পাঁচ-ছয় বছরের লেখাকে আমার কাছে টাইপড মনে হয়েছে, একধরনের লেখার ধারা মনে হয়েছে। কিন্তু এখনকার তার গদ্যগুলো দেখলে, বিশেষ করে মৌলিক গদ্য, আমার কাছে মনে হয় পরিণত সাংবাদিকের গদ্য। একটা উত্তীর্ণ গদ্য আমি দেখি তার লেখায়। আমি আলী হাসান তৈয়বের লেখার মধ্যেও এক ধরনের উত্তীর্ণ গদ্য দেখি। মুফতি এনায়েতউল্লাহর গদ্য সুন্দর। তবে বই তৈরি করেছে কম।

হুমায়ুন আইয়ুব প্রবন্ধ ও ফিচারের গদ্য নিয়ে কাজ করছে। তার গদ্য ঝরঝরে। মাসউদুল কাদিরের কথা বলা যায়। গদ্যের পাশাপাশি ছড়া নিয়েও তার কাজ আছে। রোকন রাইয়ানের প্রতিবেদনের গদ্য সুন্দর, কিশোরসাহিত্যেও তার কাজ আছে।

আতাউর রহমান খসরুর প্রতিবেদনের গদ্য বেশ সুন্দর। সুন্দর হাম্মাদ রাগিবের প্রতিবেদনগদ্য। চট্টগ্রামের মাওলানা হাবিবুল্লাহ, একটু সিরিয়াস ভঙ্গিতে লেখে, তার গদ্য সুন্দর। মাওলান মুহাম্মদ আতিকুল্লাহ, মাকতাবাতুল আযহার থেকে বেশ কিছু বই বের হয়েছে, তার গদ্যটাও আমার কাছে আধুনিক ও ঝরঝরে মনে হয়।

মাসিক আলকাউসারে আমরা সহকর্মী ছিলাম মাওলানা যাকারিয়া আবদুল্লাহ, তাঁর লেখাও আমার কাছে ইলম ও গদ্যের সৌন্দর্যের সমন্বয় মনে হয়। অনেক চমৎকার লাগে তার গদ্য। শামীম আহমদ, মুসলিম বাজার মাদরাসার শিক্ষক। তার গল্পের গদ্য এবং সাধারণ গদ্য খুব সুন্দর। সে একটা উত্তীর্ণ জায়গায় যাবে বলে আমার কাছে মনে হচ্ছে।

আবদুল্লাহ আল ফারূক অল্প সময়ে অনুবাদের ক্ষেত্রে অনেক কাজ করছেন, কাজ করছেন কাজী আবুল কালাম সিদ্দিক। রাজশাহীর ড. মাওলানা ইমতিয়াজ আহমদের কথা বলতে পারেন, একদম তরুণ আলেম আবদুল্লাহ আল মাসউদ ইলমি সাহিত্যের কাজে লেগে আছে। রেজাউল করীম আবরার দুই হাতে লিখছে। বই কম, কাজ উন্নত একজন আলেম আনসারুল্লাহ হাসান। সাইফ সিরাজের গদ্য ও লিরিকও প্রশংসা কুড়িয়েছে। মাওলানা মুনীরুল ইসলাম বেশকিছু শিশু-কিশোর সাহিত্যের কাজ করেছে। শাকের হোসাইন শিবলীর কথা বলব। এখন তার লেখা চোখে পড়ে না। প্রতিবেদন ও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাগন্ধী লেখায় সে একটি জায়গা করে নিয়েছে।

আমি স্নেহ করি মাওলানা সাদ আবদুল্লাহ মামুনকে, আমি মনে করি আরও কিছুদিন পরে তার গদ্যটা আরও উত্তীর্ণ হবে। সে মনোযোগী পাঠক এবং লিখছে। রুহুল আমীন সাদী বা সাইমুম সাদীর নামটা ভুলে যাবার মতো নয়। সেই নব্বই দশক থেকেই গল্প লেখেন। এখনও ফেসবুকে গল্পের আঙ্গিকে লিখছেন। তিনি আসলে আমাদের বয়সী বা সমকালীন মানুষ।

এ পর্যায়ের আরও দুজেন মানুষের কথা বলব, লাবীব আবদুল্লাহ ও ড. গোলাম রব্বানী। শব্দভাষা তাদের ভিন্ন, কিন্তু তারাও লেখায় লেগে আছেন তাদের পাঠকদের জন্য। গদ্যের ঝরঝরে রূপের জন্য সিলেটের নোমান বিন আরমানের কথা বলতে পারেন। সাব্বীর জাদিদের গল্প ও গদ্যভাষা উন্নত। মাসিক মুঈনুল ইসলামের সাবেক নির্বাহী সম্পাদক মুনির আহমদ ভাইয়ের বিশ্লেষণী লেখাগুলোও সুন্দর।

এছাড়া ফেসবুকে লেখেন এমন অনেকেই আছেন। এই মুহূর্তে সবার নাম মনে পড়ছে না। তবু কয়েকটি নাম বলি। ইফতিখার জামিল, আবুল কাসেম আদিল, নেসারউদ্দিন রুম্মান, সাঈদ হোসাইন, মঈনুল ইসলাম তুহিন, সগির আহমদ চৌধুরী, সাবের চৌধুরী, মনযুরুল হক, আরজু আহমেদ, মাহদি আশরাফ, মঈনুদ্দীন খান তানভীর নুরুজ্জামান নাহিদ। এদের অনেকেই চিন্তা ও অভিব্যক্তির দিক দিয়ে এবং গদ্যের শক্তিমত্তায় অসাধারণ। কারও কারও বই-ও আছে। আশানুরূপ উত্তীর্ণ লেখা আমি দেখি এদের মধ্যে। এদের ছাড়াও আরও অনেকে আছেন, তাৎক্ষণিকভাবে মনে পড়ছে না।

আবার ফেসবুকে অনেক নেতিবাচক প্রবণতাও দেখি। অনেক মেধাবী একেকজন মানুষকে ট্রলবাজির পেছনে দীর্ঘ মেহনত করে যেতে দেখি। আমি বলব, যে খাতগুলো অপচয়মূলক খাত সেগুলো বাদ দিয়ে চিন্তার, সাহিত্যের এবং গদ্যের যেন উন্নতি হয় সেই চেষ্টা তারা করে গেলে তারা এবং তাদের চারপাশ উপকৃত হবে।

-এএ


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ