হারাম খাবার গ্রহণে ইসলামে রয়েছে কঠোর নিষেধাজ্ঞা। এজন্য প্রতিটি মুসলিমকে ইসলামের যাবতীয় হুকুম-আহকাম মেনে চলার পাশাপাশি খাদ্যদ্রব্য হালাল কি-না এ বিষয়টি বিশেষ বিবেচনায় আনা জরুরি। দেশে হালাল সার্টিফিকেট দেওয়ার ক্ষমতা রাখে একমাত্র ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ। যদিও কিছু কিছু অবৈধ প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন পণ্যকে অবৈধভাবে হালাল সার্টিফিকেট দিয়ে আসছে। ইসলামিক ফাউন্ডেশন তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করছে।
কীভাবে হালাল সার্টিফিকেট পাওয়া যায়, হালাল সনদ গ্রহণে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের আগ্রহ কেমন, কোন পণ্যকে হালাল সার্টিফিকেট দেয়া হয়েছে, কোন পণ্যকে দেয়া হয়নি, হালাল লোগোযুক্ত পণ্য কেনায় ক্রেতাদের চাহিদা কেমন- এসব বিষয়ে আমরা কথা বলেছি ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের ডেপুটি-ডিরেক্টর ও মুফাসসির ড. আবু সালেহ পাটোয়ারী’র সঙ্গে। কথা বলেছেন আওয়ার ইসলামের বিশেষ প্রতিবেদক সুফিয়ান ফারাবী।
আওয়ার ইসলাম: কীভাবে হালাল সার্টিফিকেট গ্রহণ করা যায়?
ড. আবু সালেহ পাটোয়ারী: বাংলাদেশে উৎপাদিত পণ্যের গায়ে হালাল লোগো ব্যবহারের জন্য প্রথমে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক বরাবর এপ্লিকেশন করতে হয়। মহাপরিচালকের অনুমোদনের পর ইসলামিক ফাউন্ডেশন একটি এক্সপার্ট কমিটি গঠন করে। অ্যাপ্লিকেশনের সঙ্গে সংযুক্ত করতে হয় প্রতিষ্ঠানের ট্রেড লাইসেন্স, ভ্যাট সার্টিফিকেট, বিএসটিআই অনুমোদন, পণ্যের নাম ও উপকরণ। এছাড়াও পণ্যটির উৎপাদনের প্রসেসের বিষয়টিও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা হয়।
এ বিষয়ে ইফার সুনির্দিষ্ট নীতিমালা রয়েছে। নীতিমালাটি গঠন করা হয়েছে আন্তর্জাতিক হালাল সনদের নীতিমালা অনুসরণে। বিশেষ করে ওআইসির নীতিমালা অনুসরণ করা হয় হালাল সনদ নীতিমালা-২০১৫ তে।
আমাদের সার্টিফিকেট গ্রহণ করে এ পর্যন্ত প্রায় ৩৬টি পণ্য উৎপাদনকারী কোম্পানি বহির্বিশ্বে তাদের পণ্য রপ্তানি করছে। দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে- মধ্যপ্রাচ্য, নেপাল, মালোশিয়া এবং সার্কভুক্ত আটটি দেশ।
বিদেশি কোম্পানিগুলো এ দেশের বাজার ব্যবসার জন্য আমাদের হালাল সার্টিফিকেট গ্রহণ করছে। এভাবে দিন দিন এর সংখ্যা বাড়ছে। এ পর্যন্ত আমরা প্রায় ৯৫টি কোম্পানিকে হালাল সার্টিফিকেট দিয়েছি। ৯৫টি কোম্পানি হালাল সার্টিফিকেট গ্রহণ করেছে তাদের পণ্যের অনুকূলে।
আওয়ার ইসলাম: কীভাবে হালাল সার্টিফিকেট দেয়া হয়?
ড. আবু সালেহ পাটোয়ারী: পণ্যের অনুকূলে হালাল সার্টিফিকেট দেওয়া হয়, প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে নয়। তবে আবেদন করলেই আমরা হালাল সার্টিফিকেট দিয়ে দিই না। আবেদনের পর আমরা একটি এক্সপার্ট কমিটি গঠন করে তাদের পণ্যের উপকরণ ও প্রসেসিং বিবেচনা করে আমাদের হালাল লোগো ব্যবহার করার অনুমোদন দিয়ে থাকি।
পণ্যের প্রত্যেকটি উপকরণ আমরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করি। এরজন্য আমাদের নিজস্ব ল্যাব রয়েছে। এর মাধ্যমে আমরা পণ্যের উপকরণগুলো যাচাই-বাছাই করি এবং বিশেষ প্রয়োজন মনে করলে আমরা পরীক্ষার জন্য বিসিএসআইয়ে পাঠাই। আমরা সর্বপ্রথম লক্ষ্য করে থাকি পণ্যটিকে বিএসটিআই বাজারজাতের অনুমোদন দিয়েছে কি না। তারা যদি বাজারজাতের অনুমোদন দেয়, তখন আমরা পণ্যটিকে হালাল সনদের বিবেচনায় আনি। অন্যথায় আমরা হালাল সনদ দিই না।
এক্সপার্টরা পণ্যের ওপর একটি প্রতিবেদন তৈরি করেন। প্রতিবেদন তৈরি হওয়ার পর আমরা আরেকটি বিশেষ এক্সপার্ট-কমিটি গঠন করি। তাতে বিএসটিআইসহ প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের এক্সপার্টরা থাকেন। এই সার্টিফিকেটের জন্য প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে গুনতে হয় ০.০৮ শতাংশ ভ্যাট। অর্থাৎ এক কোটি টাকায় আট হাজার টাকা।
আওয়ার ইসলাম: কী ধরনের কোমল পানীয়কে হালাল সার্টিফিকেট দেওয়া হয়?
ড. আবু সালেহ পাটোয়ারী: কোমল পানীয়র মধ্যে আমরা বাছাই করে কিছু ফ্রুট জুসকে হালাল সনদ দিয়েছি। কার্বোনেটেড বেভারেজের নামে আমাদের দেশে দুই ধরনের কোমল পানীয় প্রচলিত আছে। বেভারেজ আইটেম অর্থাৎ সেভেন আপ, কোকাকোলা, মোজো এগুলোকে আমরা সার্টিফিকেটের আওতায় আনি। তবে কোকাকোলাকে এখনো আমরা হালাল সার্টিফিকেট দিইনি। তারা আমাদের কাছে অ্যাপ্লিকেশন করেছিল, কিন্তু ফুল এপ্লিকেশন না করায় আমরা এখনো তাদেরকে হালাল সার্টিফিকেট দিইনি। তেমনিভাবে পেপসিকে এখনো হালাল সার্টিফিকেট দেয়া হয়নি।
স্পিড, টাইগার, গিয়ারসহ এজাতীয় কোমল পানীয়গুলোর প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বলা হয়- এতে আমরা কার্বনেটেড বেভারেজ ইউজ করি। তারা বলে এগুলো সাধারণ এনার্জি ড্রিংকস। কিন্তু আমরা যাচাই করে দেখেছি, এগুলোর মধ্যে অনেক সময় তারা ক্যাফেইনের মাত্রা কম-বেশি করে। এজন্য আমরা এগুলোকে এখনো হালাল সার্টিফিকেট দিইনি। তারা যখন এসব পণ্য ইন্ডিয়া নেপাল বা ভুটানে রপ্তানি করে; তখন তারা ক্যাফেইনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। অর্থাৎ তারা তাদের পণ্যের মাঝে ক্যাফেইনের মাত্রা নির্দিষ্ট রাখে না। এজন্য আমরা তাদেরকে হালাল সার্টিফিকেট দিইনি। দীর্ঘদিন যাবত তারা প্রসেস চালাচ্ছে কিন্তু আমরা এখনো আমাদের লোগো ব্যবহারের অনুমোদন দিইনি।
যেসব কোমল পানীয়কে আমরা হালাল সার্টিফিকেট দিয়েছি- মোজো, ফ্রুটিকা, ক্লেমন, সজীবের শেজান জুস, একমি কোম্পানির একমি জুসসহ এজাতীয় আরও কিছু পণ্যকে আমরা হালাল সার্টিফিকেট দিয়েছি। কিন্তু কোনো ধরনের এনার্জি ড্রিংকসকে আমরা হালাল সার্টিফিকেট দিইনি।
আওয়ার ইসলাম: হালাল সার্টিফিকেট গ্রহণে কোম্পানিগুলোর আগ্রহ কেমন?
ড. আবু সালেহ পাটোয়ারী: আমাদের হালাল সার্টিফিকেট গ্রহণে পণ্য উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর আগ্রহ আছে। তবে যেহেতু পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে উত্তীর্ণ পণ্যগুলোকেই শুধু হালাল সার্টিফিকেট দেয়া হয় তাই এ বিষয়ে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর অলসতা রয়েছে।
যেসব পণ্য বহির্বিশ্বে রপ্তানি হয় সেসব পণ্য হালাল সার্টিফিকেট গ্রহণে বাধ্য হচ্ছে। কারণ সে দেশের বাজারে আমাদের হালাল সার্টিফিকেট ছাড়া পণ্য বিক্রি অসম্ভব। এজন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মাঝে আমাদের সার্টিফিকেট গ্রহণে আগ্রহ দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু অভ্যন্তরীণ বাজারে হালাল, নন হালাল এর প্রশ্ন না উঠায় দেশীয় বাজার দখলে তাদের সেরকম আগ্রহ নেই। পর্যাপ্ত জনসচেতনতা তৈরি হলে একটা পর্যায়ে ব্যবসায়ীরা হালাল সার্টিফিকেট গ্রহণে বাধ্য হয়ে যাবে।
যেহেতু বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানরা সুতরাং প্রতিটি পণ্য বাজারজাত করার পূর্বে হালাল সনদ নেয়া বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু কিছু আইনি জটিলতা থাকার কারণে এখনো সেভাবে প্রেসার ক্রিয়েট করা যাচ্ছে না প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর।
বাংলাদেশে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের বসবাস রয়েছে যারা হালাল পণ্য খাওয়ার জন্য বাধ্য নয়। এই কারণে প্রতিটি পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে হালাল সনদ গ্রহণে বাধ্য করা যাচ্ছে না। তবে আমরা আমাদের আইনি প্রক্রিয়া চালু রেখেছি আশা করি অল্প কিছুদিনের মধ্যে আইনি জটিলতা কেটে যাবে। তখন পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে হালাল সনদের আওতায় আনা সহজ হবে।
আওয়ার ইসলাম: ক্রেতারা কেন হালাল সার্টিফিকেটপ্রাপ্ত পণ্য দেখে কিনছে না?
ড. আবু সালেহ পাটোয়ারী: আমাদের দেশের মানুষের একটি ধারণা হলো এদেশে যা কিছু পাওয়া যায় সবকিছুই হালাল। যেহেতু সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান। তবে ক্রেতাদের উচিত হালাল সার্টিফিকেটপ্রাপ্ত পণ্যগুলো কেনা। এজন্য তাদেরকে আরও সচেতন হতে হবে। যখন তারা হালাল সার্টিফিকেটবিহীন পণ্যগুলোকে বর্জন করতে শুরু করবে তখন প্রতিষ্ঠানগুলো এমনিতেই হালাল সার্টিফিকেট গ্রহণে বাধ্য হবে। একজন মুসলিম হিসেবে আমি কি খাচ্ছি এটা আইডেন্টিফাই করা উচিত।
কোনো অসাধু কোম্পানির যদি হালাল সার্টিফিকেট না পেয়েও তাদের পণ্যের গায়ে হালাল লোগো ব্যবহার করে সে ক্ষেত্রে আমরা আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারি। এতটুকু আমাদের অধিকার রয়েছে- আমরা ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে তাদেরকে শাস্তি দিতে পারবো।
প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে আমাদের হালাল সার্টিফিকেট গ্রহণে বাধ্য করা যাচ্ছে না। কারণ নন মুসলিমদের পক্ষ থেকে আপত্তি করা হয়, আমরা তো হালাল খাদ্য গ্রহণে বাধ্য নই সুতরাং যদি প্রতিটি পণ্যকে হালাল সার্টিফিকেটের আওতায় আনা বাধ্য করা হয়; তখন তাদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ হয়ে যায়। এজন্য আমরা বিএসটিআইয়ের মতো প্রতিটি পণ্যকে হালাল সার্টিফিকেটের আওতায় আনতে পারছি না।
আওয়ার ইসলাম: হালালের ব্যাপারে জনসাধারণকে সচেতন করতে আপনারা কী উদ্যোগ নিচ্ছেন?
ড. আবু সালেহ পাটোয়ারী: জনসচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে প্রতি বছর হালাল পণ্যের মেলার আয়োজন করে ইফা। ২০১৭ সাল থেকে বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গণে হালাল পণ্যের মেলার আয়োজন করে আসছি। এছাড়াও ব্যবসায়ী, আলেম-উলামা ও সমাজের বিশিষ্টজনদের সঙ্গে মতবিনিময় করছি। যাতে করে ব্যবসায়ীরা হালাল সার্টিফিকেট নিতে আগ্রহী হয়।
আওয়ার ইসলাম: আমাদেরকে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ।
ড. আবু সালেহ পাটোয়ারী: আপনাদেরকেও ধন্যবাদ।
আরএম/